৭৪তম অধ্যায়
সাত্যকি-ভূরিশ্রবার যুদ্ধ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর সমরপ্রিয় সাত্যকি ভারসহ [আকর্ষণসহিষ্ণু-পূর্ণ আকর্ষণেও যাহা ভগ্ন হয় না] শরাসন আকর্ষণ করিয়া পাণিলাঘব প্রদর্শনপূর্ব্বক পুঙ্খসংযুক্ত আশীবিষসদৃশ শরনিকর পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। তিনি কখনো কামুক আস্ফালন, কখনো শরপ্রয়োগ, কখনো অন্য শরগ্রহণ ও সন্ধান, কখনো বা উহা নিক্ষেপ করিয়া শত্রুবিনাশ করিতে প্ৰবৃত্ত হইলে তাঁহার রূপ বর্ষণশীল জলধরের ন্যায় নিরীক্ষিত হইতে লাগিল। অনন্তর রাজা দুৰ্য্যোধন সাত্যকিকে স্বীয় সৈন্যসংহারে প্রবৃত্ত দেখিয়া তাঁহার অভিমুখে দশসহস্র রথী প্রেরণ করিলেন। সত্যবিক্রম সাত্যকি দিব্যাস্ত্ৰজাল প্রয়োগ করিয়া তাঁহাদিগকে বিনাশ করিতে লাগিলেন। অনন্তর তিনি দারুণ কাৰ্য্য সমাধান করিয়া ভূরিশ্রবাকে আক্রমণ করিলেন। ভূরিশ্রবা সাত্যকিকে কৌরবসেনাগণ নিহত করিতে দেখিয়া ইতিপূর্ব্বে ক্ৰোধাভরে তাঁহার প্রতি ধাবমান হইয়াছিলেন, এক্ষণে ইন্দ্রায়ুধসদৃশ কৰ্ম্মক আস্ফালন করিয়া পাণিলাঘব প্রদর্শনপূর্ব্বক আশীবিষসদৃশ বজ্রসঙ্কাশ শরনিকর পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। তখন সাত্যকির অনুযায়ী বীর সকল সেই মৃত্যুসংস্পৰ্শ [যমসদৃশ], শরনিকর সহ্য করিতে না পারিয়া সাত্যকিকে পরিত্যাগপূর্ব্বক সমস্তাৎ ধাবমান হইল।
“অনন্তর সাত্যকির মহারথ দশপুত্র বিচিত্র বর্ম্ম, ধ্বজ ও আয়ুধে শোভিত হইয়া মহারথ ভূরিশ্রবার নিকট গমনপূর্ব্বক ক্ৰোধাভরে কহিলেন, “হে কৌরবদায়াদ! এস, তুমি আমাদের এক এক জন বা এককালে সকলের সহিত যুদ্ধ কর। হয় তুমি আমাদিগকে পরাজিত করিয়া যশস্বী হইবে, না হয় আমরা তোমাকে পরাজিত করিয়া প্রীতিলাভ করিব।” তখন ভূরিশ্রবা কহিলেন, “হে বীরগণ! তোমরা আস্ফালন করিয়া যে কথা কহিতেছ, তাহা উত্তম; এক্ষণে তোমরা সমবেত হইয়া পরমযত্নসহকারে যুদ্ধ কর, আমি তোমাদিগকে বিনাশ করিব, তাহাতে সন্দেহ নাই।” অনন্তর বীরগণ ভূরিশ্রবার প্রতি অনবরত শরপ্রয়োগ করিতে লাগিলেন। ভূরিশ্রবা একাকী হইয়াও সমবেত বহু বীরের সহিত অপরাহ্ণে তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন। যেমন বর্ষাকালীন জলদজাল মহাশৈলের উপর বারিবর্ষণ করিয়া থাকে, তদ্রূপ বীরগণ সেই একমাত্র ভূরিশ্রবার উপর শরবৃষ্টি করিতে লাগিলেন। ভূরিশ্রবা যমদণ্ডতুল্য অশনিনির্ঘোষসদৃশ শব্দায়মান শর সকল উপস্থিত হইতে না হইতেই খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। অনন্তর বীরগণ তাঁহাকে বেষ্টিত করিয়া বিনাশ করিবার উপক্রম করিবামাত্র ভূরিশ্রবা ক্রোধাবিষ্ট হইয়া বহুবিধ শরদ্বারা শরাসন ছেদনপূর্ব্বক তাঁহাদিগকে বিনাশ করিলেন। তখন তাঁহারা বজ্রভগ্ন বৃক্ষের ন্যায় ভূতলে নিপতিত হইলেন। বীরবর সাত্যকি পুত্ৰগণকে নিহত নিরীক্ষণ করিয়া ঘোরতর সিংহনাদ পরিত্যাগপূর্ব্বক ভূরিশ্রবার প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন উভয়ে রথদ্বারা উভয়ের রথ নিপীড়িত, ভগ্ন ও অশ্বসকল বিনষ্ট করিতে লাগিলেন, পরে বিরথ হইয়া খড়্গগ্রহণপূর্ব্বক পরস্পর সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন। তখন তাঁহাদিগের এক অনির্ব্বচনীয় শোভা সমুদ্ভূত হইল। এই অবসরে ভীমসেন সত্বর তথায় আগমন করিয়া নিস্ত্রিংশধারী সাত্যকিকে স্বরথে আরোপিত করিলেন। এদিকে মহারাজ দুর্য্যোধনও সকল ধনুর্দ্বারীদিগের সমক্ষে ভূরিশ্রবাকে আপনার রথে আরোহণ করাইলেন।
“অনন্তর পাণ্ডবেরা ক্রোধাবিষ্ট হইয়া মহারথ ভীষ্মের সহিত ঘোরতর যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। ভগবান মরীচিমালী লোহিতবর্ণ ধারণ করিলেও অর্জ্জুন সত্বর হইয়া পঞ্চবিংশতিসহস্র মহারথকে বিনষ্ট করিলেন। যেমন পতঙ্গেরা অনলশয্যায় নিপতিত হইয়া বিনষ্ট হয়, তদ্রূপ ঐ সমস্ত মহারথীগণ অর্জ্জুনবিনাশার্থ রাজা দুৰ্য্যোধনকর্ত্তৃক আদিষ্ট হইয়া অর্জ্জুনসন্নিধানে গমন করিবামাত্র বিনষ্ট হইলেন। তখন মৎস্য ও কেকয়গণ সপুত্ৰ মহারথ পার্থকে বেষ্টন করিয়া রহিলেন। এ দিকে দিবাকর তিরোহিত হইলেন; সৈন্যসকল অন্ধকারে আবৃত হইয়া ভ্রান্ত হইতে লাগিল। তখন মহাবীর ভীষ্ম অবহার করিলেন। বাহনসকল ক্লান্ত ও ভীত হইয়া স্বস্ব আবাসে গমন করিল। পাণ্ডব, সৃঞ্জয় ও কৌরবগণ স্ব স্ব শিবিরে প্রতিগমন করিলেন।”