৭৪তম অধ্যায়
রাজ্যের বৃদ্ধি ও রক্ষা—মুচুকুন্দ কুবের-সংবাদ
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! রাজ্যের বৃদ্ধি ও রক্ষা রাজা ও রাজপুরোহিতের আয়ত্ত। যে রাজ্যে ব্ৰহ্মতেজোদ্বারা প্রজাগণের অপ্রত্যক্ষ ভয় এবং রাজার বাহুবলে প্রত্যক্ষ ভয় নিরাকৃত হয়, সেই রাজ্যই যথার্থ উপদ্রবশূন্য হইয়া থাকে। মহারাজ মুচুকুন্দ ও কুবেরের কথোপকথন এই বিষয়ের একটি উদাহরণস্বরূপ। আমি এক্ষণে সেই পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। মহীপাল মুচুকুন্দ সমুদয় পৃথিবী জয় করিয়া আপনার বল পরীক্ষা করিবার নিমিত্ত অলকাধিপতি কুবেরকে আক্রমণ করিতে গমন করিলেন। যক্ষরাজ তদ্দর্শনে মুচুকুন্দের সৈন্যসংহারার্থ অচিরাৎ অসংখ্য রাক্ষস প্রেরণ করিলেন। নিশাচরগণ মহারাজ মুচুকুন্দের সৈনিকদলে প্রবিষ্ট হইয়া তাহাদিগকে বিনষ্ট করিতে লাগিল। তখন মুচুকুন্দ অদ্বিতীয় বিদ্বান স্বীয় পুরোহিত বশিষ্ঠের নিন্দা করিতে আরম্ভ করিলেন। মহর্ষি বশিষ্ঠ রাজার নিন্দাশ্রবণে ক্রুদ্ধ হইয়া কঠোর তপানুষ্ঠানপূর্ব্বক রাক্ষসগণের বিনাশসাধনে প্রবৃত্ত হইলেন।
“রাক্ষসসৈন্য বিনষ্ট হইতে আরম্ভ হইলে ধনাধিপতি মহারাজ মুচুকুন্দের সমীপবর্তী হইয়া কহিলেন, ‘মহারাজ! পূৰ্ব্বে অনেক ভূপতি তোমার ন্যায় বলবান্ ও পুরোহিত-সাহায্যসম্পন্ন ছিলেন; কিন্তু এক্ষণে তুমি আমাকে যেরূপ আক্রমণ করিয়াছ, এরূপ আর কেহই করেন নাই। সেই পূর্ধ্বতন ভূপতিগণ অস্ত্রশস্ত্রবিশারদ ও সমধিক বলশালী হইয়াও আমাকে সুখদুঃখের অধীশ্বর বিবেচনা করিয়া প্রতিনিয়ত আমার উপাসনা করিতেন। যাহা হউক, এক্ষণে যদি তোমার বাহুবল থাকে, প্রকাশ কর। ব্রাহ্মণবল আশ্রয় করিয়া কি নিমিত্ত বৃথা বলবত্ত্ব প্রকাশ করিতেছ?’
‘তখন মহারাজ মুচুকুন্দ ক্রুদ্ধ হইয়া অকুতোভয়ে ন্যায়ানুগত বাক্যে ধনেশ্বরকে কহিলেন, ‘ভগবান! ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় উভয়েই ব্রহ্মা হইতে উৎপন্ন হইয়াছেন। ভগবান্ ব্রহ্মা উঁহাদিগের সৃষ্টি করিয়া লোকপালনার্থ, ব্রাহ্মণগণকে মন্ত্র ও তপোবল এবং ক্ষত্রিয়গণকে অস্ত্র ও বাহুবল প্রদান করিয়াছেন। ব্রহ্মবল ও ক্ষত্রিয়বল পৃথক পৃথক হইলে প্রজাগণ কখন সুরক্ষিত হইতে পারে না, অতএব ঐ উভয় বল একত্র করিয়া প্রজাপালন করাই বিজ্ঞলোকের কর্ত্তব্য। আমি সেই অনুসারেই ব্রহ্মবল অবলম্বনপূর্ব্বক কাৰ্য্য করিতেছি, তবে আপনি কি নিমিত্ত আমার নিন্দা করিতেছেন ‘
“তখন যক্ষরাজ রাজা মুচুকুন্দকে কহিলেন, “মহারাজ! আমি কদাচ একজনের রাজ্য অন্যকে প্রদান বা নিজে অপহরণ করি নাই। এক্ষণে তোমাকে সমুদয় পৃথিবী প্রদান করিলাম; তুমি নিঃশঙ্কচিত্তে উহা শাসন কর।’
“মহারাজ মুচুকুন্দ ধনেশ্বরকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া কহিলেন, “ভগবন্! আপনার প্রদত্ত রাজ্য ভোগ করিতে আমার বাঞ্ছা নাই। আমি স্বীয় বাহুবলে সমুদয় ধরিত্রী জয় করিয়া ভোগ করিব, ইহাই আমার বাসনা।’
“তখন ধনাধিপতি কুবের মহারাজ, মুচুকুন্দকে অসম্ভ্রান্ত ক্ষাত্ৰধৰ্ম্মে নিতান্ত অনুরক্ত দেখিয়া যারপরনাই বিস্ময়াপন্ন হইলেন। অনন্তর মহারাজ মুচুকুন্দ কুবেরের সমীপ হইতে বিদায় লইয়া আপনার রাজধানীতে প্রত্যাগমনপূৰ্ব্বক ক্ষাত্রধর্ম্মানুসারে স্ববাহুবলনির্জ্জিত বসুন্ধরা শাসন করিতে লাগিলেন। হে ধৰ্ম্মরাজ! যে ধৰ্ম্মপরায়ণ নরপতি ঐরূপে ধৰ্ম্মবল আশ্রয় করিয়া কৰ্ম্মানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হয়েন, তিনি নিশ্চয়ই সমুদয় পৃথিবী জয় ও যশোলাভ করিতে পারেন। ব্রাহ্মণ প্রতিদিন উদকক্রিয়া সম্পাদন ও ক্ষত্রিয় প্রতিনিয়ত অস্ত্রবল অবলম্বন করিলে পৃথিবীর যাবতীয় বস্তু তাঁহাদের আয়ত্ত হয়, সন্দেহ নাই।”