৭৪তম অধ্যায়
নলান্বেষণার্থ দময়ন্তীর দূতীপ্রেরণ
“দময়ন্তী কেশিনীকে আহ্বান করিয়া কহিলেন, ‘কেশিনি! ঐ যে হ্রস্ববাহু বিকৃতকলেবর সারথি রথােপান্তে উপবেশন করিয়া আছেন, তুমি সাবধানে বিনীতভাবে উহার সমীপবর্ত্তী হইয়া পরিচয় জিজ্ঞাসা কর। উহাকে অবলোকন করিয়া আমার অন্তঃকরণ যেরূপ সন্তুষ্ট ও পরিতৃপ্ত হইতেছে, ইহাতে বোধ হয়, উনি উগ্ৰসেনসূত নালরাজ হইতে পারেন। তুমি সমুচিত সম্ভাষণপূর্ব্বক কথাপ্রসঙ্গে পর্ণাদের বাক্যগুলি উহার শ্রবণগোচর করিবে এবং উনি যে-সকল প্ৰত্যুত্তর প্রদান করেন, তাহা হৃদয়ঙ্গম করিয়া রাখিবে।” দময়ন্তী এই সকল উপদেশ প্রদানপূর্ব্বক কেশিনীকে প্রেরণ করিলেন ও স্বয়ং প্রাসাদে আরোহণপূর্ব্বক পৰ্য্যবেক্ষণ করিতে লাগিলেন।
ছদ্মনল-বাহুক-কেশিনীর কথোপকথন
“কেশিনী বাহুক-সমীপে গমন করিয়া স্বাগত ও কুশল জিজ্ঞাসানন্তর কহিল, “মহাশয়! আপনারা কোন সময়ে নিজ নগর হইতে যাত্ৰা করিয়াছিলেন ও এ স্থানেই বা কি নিমিত্ত আগমন করিয়াছেন? এই সকল বৃত্তান্ত জানিবার নিমিত্ত ভর্ত্তৃদারিকা [রাজমহিষী] দময়ন্তীর সাতিশয় অভিলাষ জন্মিয়াছে, অতএব এ বিষয়ের যাথার্থ্য সমুদয় বর্ণন করুন।”
দময়ন্তীর দ্বিতীয়-স্বয়ংবর হইবে শ্রবণ করিয়া শতযোজনগামী মনোজবগতি বাজিসমূহের সাহায্যে আগমন করিয়াছেন; আমি তাহারই সারথি ।”
“কেশিনী কহিল, “মহাশয়! এই তৃতীয় ব্যক্তি কে, কাহার অধীন ও আপনিই বা কাহার অধিকৃত, আর আপনার প্রতিই বা কি নিমিত্ত এই কর্ম্মের ভার সমৰ্পিত হইয়াছে?”
“বাহুক কহিলেন, ভদ্রে! এই তৃতীয় ব্যক্তি পুণ্যশ্লোক নলরাজের সারথি, ইনি বার্ঞ্চেয় বলিয়া বিখ্যাত। নলরাজ প্রস্থান করিলে, ইনি ঋতুপর্ণের নিকট উপস্থিত হইয়া সারথ্য-কর্ম্ম স্বীকার করিয়াছেন। আমি অশ্বকুশল বলিয়া রাজা ঋতুপর্ণ আমাকেও সারথ্যকর্ম্মে প্রতিষ্ঠিত ও রন্ধনব্যাপারে নিযুক্ত করিয়া রাখিয়াছেন।”
“কেসিনী কহিল, “মহাশয়! নলরাজ কোথায় গমন করিয়াছেন, বার্ঞ্চেয় কি তাহা অবগত আছেন? অথবা তিনি আপনার নিকটে তাঁহার বৃত্তান্ত কি কহিয়াছেন?”
“বাহুক কহিলেন, ‘যশস্বিনি! বার্ষ্ণেয় পুণ্যাত্মা নলরাজের সন্তানদ্বয়কে এই স্থানে সমর্পণ করিয়া যথাভিলাষ প্ৰস্থান করিয়াছিলেন; ইনি ইহা ব্যতীত তাঁহার আর কোন বৃত্তান্ত অবগত নহেন এবং অন্য কেহও তাহার বার্ত্তা কহিতে সমর্থ হইবে না। তিনি সৌন্দৰ্য্যভ্রষ্ট হইয়া ছদ্মবেশে দেশে দেশে পর্যটন করিতেছেন। তিনিই স্বয়ং তাঁহার তদানীন্তন অবস্থা অবগত আছেন, তদ্ভিন্ন আর কেহই তাহার সেই অবস্থা অবগত নহে; তিনি কোন স্থানেই আপনার লক্ষণসকল প্রকাশ করেন নাই।”
“কেশিনী কহিল, “মহাশয়! প্ৰথমে যে ব্রাহ্মণ অযোধ্যায় গমন করিয়া আপনার নিকট ভর্ত্তৃদারিকা দময়ন্তীর এই সকল কথা কহিয়াছিলেন যে, “হে কিতাব! ত্বদীয় প্রণয়িনী তোমাতে নিতান্ত অনুরক্ত, তিনি অরণ্যমধ্যে নিদ্রাবস্থায় তাহার বস্ত্ৰাৰ্দ্ধ ছেদনপূর্ব্বক তাহাকে একাকিনী পরিত্যাগ করিয়া কোথায় পলায়ন করিয়াছ? তুমি তাহাকে যেরূপ আদেশ করিয়াছিলে, সে তাহাই প্রতিপালন করিয়া তোমার প্রতীক্ষায় কালক্ষেপণ করিতেছে। সেই কামিনী অৰ্দ্ধবস্ত্র পরিধানপূর্ব্বক দিনযামিনী কেবল শোকসত্তপ্ত-চিত্তে রোদন করিতেছে; অতএব তুমি প্রসন্ন হইয়া তাহার বাক্যের প্রত্যুত্তর প্রদান কর। হে মহামতে! দময়ন্তীর প্রিয়সংবাদ বল।” এই সকল শ্রবণ করিয়া সেই ব্ৰাহ্মণের সমক্ষে আপনি যে-সকল প্রত্যুত্তর প্রদান করিয়াছিলেন, ভর্ত্তৃদারিকা বৈদর্ভী পুনরায় আপনার নিকট তাহা শ্রবণ করিতে সমুৎসুক হইয়াছেন।”
“কেশিনীর বাক্য শ্রবণ করিয়া নলরাজের হৃদয় নিতান্ত কাতর ও নয়নযুগল অশ্রুজলে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। তিনি অযোধ্যাতে দময়ন্তীর পুনঃস্বয়ংবর শ্রবণ করিয়া সেই বার্ত্তাবহ ব্ৰাহ্মণের নিকট যাহা কহিয়াছিলেন, এক্ষণে দাহ্যমান হইয়াও দুঃখাবেগ সংবরণপূর্ব্বক পুনরায় তাহা কহিতে আরম্ভ করিলেন; ‘কুলকামিনীরা বিষম সঙ্কটে পতিত হইলেও স্বয়ং আপনাকে রক্ষা করে; এই নিমিত্ত ঐ সকল পতিপ্ৰাণা সতীরা নিঃসন্দেহ স্বৰ্গলাভ করিয়া থাকে। তাহারা স্বামীকর্ত্তৃক পরিত্যক্ত হইলেও কদাচ কোপপরায়ণা হয় না, বরং সদাচারস্বরূপ কবচো আবৃত হইয়া আপনার জীবন রক্ষা করে; অতএব সেই নলরাজ তাদৃশ বিষমদশাগ্ৰস্ত ও সুখপরিভ্রষ্ট হইয়া মুগ্ধ হৃদয়ে তাঁহাকে যে পরিত্যাগ করিয়াছেন, তদ্বিষয়ে তাঁহার জাতক্ৰোধ হওয়া কোনক্রমে উচিত নহে। নল-নৃপতি পক্ষিগণকর্ত্তৃক হৃতবসন ও মনঃপীড়ায় নিতান্ত ব্যথিত হইয়া অতিকষ্টে জীবনযাত্ৰানির্ব্বাহ করিতেছেন; এক্ষণে তাঁহার উপর ক্ৰোধ করা দময়ন্তীর উচিত নহে। নলরাজ দময়ন্তীর প্রতি আদরই প্রকাশ করুন, বা অনাদরই প্রকাশ করুন, তথাচ তাহাকে রাজ্যভ্রষ্ট, শ্ৰীহীন, ক্ষুধিত ও একান্ত দুঃখিত নিরীক্ষণ করিয়া ক্ৰোধ করা কোনক্রমেই দময়ন্তীর উচিত নহে।’ নলরাজ এই সকল কথা কহিতে কহিতে এরূপ দুর্ম্মনায়মান হইলেন যে, বাস্পবেগ সংবরণ করিতে না পারিয়া রোদন করিতে লাগিলেন।
“কেশিনী বাহুকের বাক্য শ্রবণ ও তাঁহার চিত্তবিকার অবলোকন করিয়া বৈদর্ভী-সমীপে গমনপূর্ব্বক সেই সমুদয় বৃত্তান্ত নিবেদন করিল।”