৭৩তম অধ্যায়
ভীমের অভাবনীয় সান্ত্ববাদ
ভীমসেন কহিলেন, “হে মধুসূদন! তুমি কুরুসভায় গমন করিয়া যাহাতে আমাদের উভয় পক্ষের শান্তিলাভ হয়, এরূপ কথা কহিবে; যুদ্ধের কথা উত্থাপন করিয়া কদাচ কৌরবগণকে ভীত করিও না; দুৰ্য্যোধনের প্রতি কটুক্তি করিও না। সান্ত্ববাদদ্বারা তাহাকে সন্তুষ্ট করিও, সে সাতিশয় ক্রুদ্ধস্বভাব, শেয়োদ্বেষী, পাপপরায়ণ, দস্যুতুল্যচেতাঃ, ঐশ্বৰ্য্যমদমত্ত, অদীর্ঘদর্শী, নিষ্ঠুর, ক্রুরকর্ম্ম, পাপাত্মা ও শঠ। সে প্ৰাণ পৰ্য্যন্ত পরিত্যাগ করিবে, তথাপি কাহারও নিকট নত হইবে না এবং আপনার মতও কদাচ পরিত্যাগ করিবে না; বিশেষতঃ সে আমাদের সহিত শক্রতা করিয়াছে। ঐ দুরাত্মা সুহৃজনের মতের বিপরীত কাৰ্য্য করে, ধর্ম্ম পরিত্যাগ করিয়াছে, মিথ্যা ব্যবহার সাতিশয় প্রিয় বলিয়া জ্ঞান করে ও সুহৃদ্বর্গের বাক্যে অবজ্ঞা-প্রদর্শনপূর্ব্বক তাহাদের মনঃপীড়া উৎপাদন এবং ক্রোধবশতঃ দুষ্টস্বভাব অবলম্বন করিয়া অধর্ম্মাচরণ করিয়া থাকে। অতএব তাহার সহিত সন্ধিসংস্থাপন করা আমার মতে নিতান্ত দুষ্কর।
“হে মধুসূদন! দুৰ্য্যোধনের সৈন্যসংখ্যা, স্বভাব, বল ও পরাক্রমের বিষয় তোমার অবিদিত নাই। পূর্ব্বে সমুদয় কৌরবগণ ও আমরা জ্যেষ্ঠভ্রাতাকে ইন্দ্ৰতুল্য বোধ করিয়া পুত্র ও বন্ধুবান্ধবগণসমভিব্যাহারে আমোদ-প্রমোদে কালযাপন করিতাম; কিন্তু এক্ষণে যেমন নিদাঘকালে হুতাশন বন্যসকল দগ্ধ করে, তদ্রূপ দুৰ্য্যোধনের ক্রোধানলে সমুদয় ভরতবংশ ধ্বংস হইবে।
“হে মহাত্মন! মহাতেজস্বী অসুরদিগের কলি, হৈহয়দিগের উদাবর্ত্ত, নীপদিগের জনমেজয়, তালজঙঘদিগের বহুল, ক্ৰমীদিগের উদ্ধতবসু, সুবীরদিগের অজবিন্দু, সুরাষ্ট্রদিগের রুষর্দ্ধিত, বলীহাদিগের অর্কজ, চীনদিগের ধৌতমূলক, যা বিদেহদিগের হয়গ্ৰীব, মহৌজাদিগের বরয়ূ, সুন্দরবংশীয়দিগের বাহু, দীপ্তাক্ষদিগের পুরূরবা, চেদিমৎস্যদিগের সহজ, প্রবীরদিগের বৃষধ্বজ, চন্দ্ৰবংশদিগের ধারণ, মুকুটদিগের বিগাহন ও নন্দিবোগদিগের সম, এই অষ্টাদশ ভূপতিবংশের কলঙ্কস্বরূপ; ইহারা যুগান্তে জন্মগ্রহণ করিয়া স্বীয় জ্ঞাতি ও বন্ধুবান্ধবদিগকে এককালে উচ্ছিন্ন করিয়াছে। আমার বোধ হয়, পাপাত্মা কুলাঙ্গার দুৰ্য্যোধনও সেইরূপ কুরুকুসংহারের নিমিত্ত যুগান্তে কৌরববংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছে। অতএব তাহার সমীপে মৃদু, ধর্ম্মার্থযুক্ত ও তাহার স্বার্থের অবিরোধী বাক্য প্রয়োগ করাই কর্ত্তব্য; কটু বাক্য কদাপি বক্তব্য নহে। যদি দুৰ্য্যোধনের নিকট আমাদের সকলকেই হীনভাবে কালযাপন করিতে হয়, তাহাও শ্ৰেয়ঃ; কিন্তু ভরতবংশ বিনাশ করা কদাপি কর্ত্তব্য নহে। বরং যাহাতে কৌরবগণের সহিত আমাদের কোন সম্পর্ক না থাকে, তুমি এরূপ কাৰ্য্য করিও; কিন্তু যদ্বারা কৌরবগণ কুলক্ষয় নিবন্ধন দারুণ দোষে দূষিত হয়, এরূপ চেষ্টা কখন করিও না। তুমি আমাদের পিতামহ ভীষ্ম ও অন্যান্য সভাসদগণকে বলিবে যে, যাহাতে আমাদের পরস্পর সৌভ্রাত্র জন্মে ও দুৰ্য্যোধন প্রশান্ত হয়, তাহারা এমন কোন উপায় নিৰ্দ্ধারিত করুন। হে মধুসূদন! আমার এই মত; ধর্ম্মরাজও ইহাতে অভিনন্দন করিতেছেন; আর পরমদয়ালু অর্জ্জুনেরও যুদ্ধে অভিলাষ নাই।”