৭২তম অধ্যায়
সন্ধির অসম্ভাবনায় ভবিষ্যৎ কর্ত্তব্যনির্দ্দেশ
বাসুদেব কহিলেন, “হে ধৰ্মরাজ! আমি সঞ্জয়ের বাক্য শ্রবণ করিয়াছি, এক্ষণে আপনার কথাও শুনিলাম এবং আপনার ও কৌরবগণের অভিপ্রায়ও সবিশেষ অবগত আছি। আপনার বুদ্ধি ধর্ম্মানুগত ও কৌরবগণের বুদ্ধি বৈরাচরণে নিরত। বিনা যুদ্ধে যাহা লাভ হয়, আপনি তাহারই বহুমান [সমাদর-সমধিক লাভ বিবেচনা] করিয়া থাকেন।
“হে মহারাজ! ব্রহ্মচৰ্য্যাদি কাৰ্য্য ক্ষত্ৰিয়ের পক্ষে বিধেয় নহে। সমুদয় আশ্রমীরা ক্ষত্ৰিয়ের ভৈক্ষ্যাচরণ নিষেধ করিয়া থাকেন। বিধাতা সংগ্রামে জয়লাভ বা প্ৰাণপরিত্যাগ ক্ষত্ৰিয়ের নিত্যধর্ম্ম বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়াছেন, অতএব দীনতা ক্ষত্ৰিয়ের পক্ষে নিতান্ত নিন্দনীয়। হে অরতিনিপাতন যুধিষ্ঠির! আপনি দীনতা অবলম্বন করিলে কখনই স্বীয় অংশ লাভ করিতে পরিবেন না; অতএব বিক্রম প্রকাশ করিয়া শত্ৰুগণকে বিনাশ করুন। ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণ অতি লুব্ধ, তাহারা বহুকাল একত্র বাস করিতেছে; তাহাদের পরস্পর বিলক্ষণ স্নেহ জন্মিয়াছে; বিশেষতঃ এক্ষণে তাহারা বহুতর সুহৃৎ ও সৈন্য সংগ্ৰহ করিয়াছে এবং ভীষ্ম, দ্রোণ ও কৃপ প্রভৃতি বীরপুরুষগণ স্বপক্ষে থাকাতে আপনার বলবত্তার [বীৰ্য্যের-ক্ষমতার] অভিমান করিয়া থাকে; সুতরাং তাহারা যে আপনাদের সহিত সন্ধিসংস্থাপন করিবে, এমন বোধ হয় না। আপনি মৃদুভাব অবলম্বন করিলে তাহারা আর রাজ্য প্ৰদান করিবে না। আপনি কৃপা, দৈন্য, ধর্ম্ম অথবা অর্থই প্রদর্শন করুন, তাহারা কদাচ আপনার অভিলাষ পূর্ণ করিবে না।
“হে পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ! আপনি যখন কৌপীন পরিধান করিয়া বনে গমন করেন, তখন কৌরবগণ কিছুমাত্র অনুতপ্ত হয় নাই। তাহারা ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর, ধৃতরাষ্ট্র, অন্যান্য কুরুপ্রধান ব্যক্তিগণ, ব্রাহ্মণগণ ও নাগরিক জনগণের সমক্ষে দূতক্ৰীড়ায় আপনাকে বঞ্চনা করিয়াও কিছুমাত্র লজ্জিত হয় নাই। ইহাতে স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, আপনার সহিত আত্মীয়তা করা তাহাদের অভিপ্রেত নহে। হে মহারাজ! ধৃতরাষ্ট্রতনয়গণ যেরূপ অসৎস্বভাবসম্পন্ন, তাহাতে তাহাদিগের সহিত প্রণয় করা আপনার কদাপি বিধেয় নহে। আপনার কথা দূরে থাকুক, তাহারা ভূমণ্ডলস্থ সমস্ত লোকেরই বধ্য। দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন সভামধ্যে আপনার প্রতি বহুবিধ কটুক্তি প্রয়োগ করিয়া ভ্রাতৃগণসমভিব্যাহারে প্রহৃষ্টচিত্তে আত্মশ্লাঘা করিয়া কহিয়াছিল যে, ‘পাণ্ডবগণের ধনসম্পত্তি আর কিছুই নাই; উহারা কালক্রমে হীনবীৰ্য্য হইয়া আমার নিকট পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইবে; তাহা হইলে উহাদের নাম ও গোত্র আর কিছুই থাকিবে না।”
“হে অজাতশত্ৰো! দ্যূতক্রীড়াসময়ে দুরাত্মা দুঃশাসন দ্রুপদনন্দিনীকে অনাথার ন্যায় কেশাকর্ষণপূর্ব্বক রাজসভায় আনয়ন করিয়া ‘গরু গরু [“যেন সর্ব্বভোগ্য”-এই প্রকারের উপহাস]’ বলিয়া সম্বোধন করিয়াছিল। তৎকালে আপনার ভ্রাতৃগণ কেবল ধর্ম্মপালন ও আপনার প্ৰতিষেধবাক্য রক্ষার নিমিত্তই ঔদাসীন্য অবলম্বন করিয়াছিলেন। দুরাত্মা দুঃশাসন আপনার বনবাসসময়ে উক্তপ্রকার ও অন্যান্য বহুবিধ পরুষবাক্য প্রয়োগ করিয়া জাতিসমাজমধ্যে আত্মশ্লাঘা করিয়াছিল। তৎকালে ঐ সভাস্থ সমস্ত মহাত্মারা আপনাকে অপরাধ-শুন্য বিবেচনা করিয়া বাষ্পপূর্ণকণ্ঠে রোদন করিতে লাগিলেন। ভূপতিগণ ও ব্রাহ্মণগণ দুঃশাসনের বাক্যে অভিনন্দন করিলেন না। সভাসদগণ সকলেই দুৰ্য্যোধনকে নিন্দা করিতে লাগিলেন। হে মহারাজ! নিন্দা অপেক্ষা সৎকলসম্ভূত ব্যক্তির মৃত্যুই শ্রেয়স্কর। দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন ভূমণ্ডলস্থ সমস্ত ভূপতিগণকর্ত্তৃক নিন্দিত ও জনসমাজে লজ্জিত হইয়া তৎকালেই নিহত প্ৰায় হইয়াছে। দুৰ্য্যোধনসদৃশ ও সচ্চরিত্রসম্পন্ন জনগণকে ছিন্নমূল। তরুর ন্যায় বিনাশ করা অনায়াসসাধ্য।
“হে রাজন! অনাৰ্য্য ব্যক্তি সৰ্পের ন্যায় সমুদয় লোকের বধ্য; অতএব আপনি নিঃসন্দেহচিত্তে দুৰ্য্যোধনকে সংহার করুন। আমার মতে ধৃতরাষ্ট্র ও ভীষ্মের নিকট পণিপাতপরতন্ত্র হওয়া আপনার কদাচ কর্ত্তব্য নহে। যাহা হউক, যাহাদের দুৰ্য্যোধন সাধু কি অসাধু এই সন্দেহ আছে, আমি কুরুসভায় উপস্থিত হইয়া তাহাদের সংশয়চ্ছেদ করিব। হে মহারাজ! আমি তথায় সমস্ত ভূপতিগণসমক্ষে আপনার পুরুষোচিত গুণ ও দুৰ্য্যোধনের দোষ কীর্ত্তন করিব। তত্রস্থ নানা জনপদেশ্বর ভূপতিগণ আমার সেই ধর্ম্মার্থসংযুক্ত বাক্য শ্রবণ করিয়া আপনাকে ধর্ম্মাত্মা ও সত্যবাদী এবং দুৰ্য্যোধনকে লুব্ধ বলিয়া জানিতে পরিবেন। পুর ও জনপদবাসী ব্রাহ্মণ প্রভৃতি চারি বর্ণ সমাগত হইলে আমি আবালবৃদ্ধ সকলের সমক্ষে দুৰ্য্যোধনের নিন্দা করিব। কৌরবগণের নিকট শান্তি প্রার্থনা করিলে আমার কিছুই অধর্ম্ম হইবে না; প্রত্যুত সমুদয় ভূপতিগণ কৌরবদিগকে, বিশেষতঃ ধৃতরাষ্ট্রকে নিন্দা করিবে। দুরাত্মা দুৰ্য্যোধন সকল লোককর্ত্তৃক নিন্দিত ও পরিত্যক্ত হইলে মৃতপ্রায় হইবে; তখন তাহার পরাভাবের নিমিত্ত আপনাকে কোন প্রকার চেষ্টা করিতে হইবে না; আপনার যাহা ইচ্ছা তাহাই করিতে পরিবেন।
“হে ধৰ্মরাজ! আমি কুরুকূলে গমন করিয়া আপনাদের স্বার্থের অব্যাঘাতে শান্তিস্থাপন করিতে যত্ন করিব। কিন্তু নিশ্চয় বোধ হইতেছে কৌরবেরা তাহাতে সম্মত হইবে না; যুদ্ধপক্ষেই কৃতনিশ্চয় হইবে; তাহা হইলে আমিও আপনাদের জয়লাভার্থ পুনরায় এ স্থানে প্রত্যাগমন করিব। হে মহারাজ! যেরূপ দুর্নিমিত্ত অবলোকন করিতেছি, তাহাতে স্পষ্টই বোধ হইতেছে, শক্ৰগণের সহিত সংগ্রাম হইলে শান্তিলাভের সম্ভাবনা নাই। সায়ংকালে মৃগ ও পক্ষিগণ হস্তী ও অশ্বগণের মধ্যে ঘোরতর নিনাদ করিতে থাকে; আমি ঘোরতর রূপ ও নানাবিধ বৰ্ণ ধারণ করি। বোধহয়, মনুষ্যলোকক্ষয়কারী যমরাজের সমাগম হইয়াছে; নচেৎ এরূপ হইত না। যাহা হউক, যোদ্ধৃগণ এক্ষণে হস্তী, অশ্ব ও রথসমূহের তত্ত্বাবধানে যত্ন করুক; শস্ত্ৰ, যন্ত্র, কবচ, রথ হস্তী ও অশ্বসমুদয় সুসজ্জিত করিয়া রাখুক। হে মহারাজ! সংগ্রামে যে যে দ্রব্যের আবশ্যক, সত্বর তৎসমুদয় প্রস্তুত করিয়া রাখুন। দুৰ্য্যোধন যখন দ্যূতক্রীড়ায় আপনার সমৃদ্ধ রাজ্য অপহরণ করিয়াছে, তখন জীবন থাকিতে কখনই আপনাকে উহা প্ৰদান করিবে না।”