০৭২. প্রতিজ্ঞাপর্ব্বাধ্যায় – অর্জ্জুনের অন্তর শোকাকুল

৭২তম অধ্যায়

প্রতিজ্ঞাপর্ব্বাধ্যায় – অর্জ্জুনের অন্তর শোকাকুল

সঞ্জয় কহিলেন, মহারাজ! প্রাণিগণের ক্ষয়কর সেই ভয়ানক দিবা অবসান হইলে দিনকর অস্তগমন করিলেন। সন্ধ্যাকাল সমুপস্থিত হইল এবং সৈন্যগণ স্কন্ধাবারে গমন করিতে আরম্ভ করিল। ঐ সময় কপিকেতন ধনঞ্জয় দিব্যাস্ত্র জালে সংশপ্তকগণকে সংহার পূর্ব্বক সেই জয়শীল রথে আরোহণ করিয়া স্বশিবিরে গমন করিতে লাগিলেন। গমন কালে সাশ্রুকণ্ঠে গোবিন্দকে জিজ্ঞাসা করিলেন, কেশব? কেন অদ্য আমার হৃদয় ভীত, বাক্য স্খলিত, অঙ্গ স্পন্দিত ও গাত্র অবসন্ন হইতেছে? ক্লেশজনক অমঙ্গল চিন্তা আমার হৃদয় হইতে অপসারিত হইতেছে না, আমি চারিদিকে উৎপাত ও বহুবিধ অনিষ্টসূচক লক্ষ্মণ নিরীক্ষণ করিয়া নিতান্ত বিত্রাসিত হইয়াছি। হে মধুসূদন! এই সমুদায় অমঙ্গলসূচক ব্যাপার প্রত্যক্ষ করিয়া অমাত্য সমবেত মহারাজ যুধিষ্ঠিরের কুশল বিষয়ে আমার সংশয় জন্মিতেছে।

কৃষ্ণের অর্জ্জুন-সান্ত্বনা

বাসুদেব কহিলেন, ধনঞ্জয়! অমাত্য সমবেত মহারাজ যুধিষ্ঠির নিশ্চয়ই জয়লাভ করিবেন; তুমি দুৰ্ভবনা পরিত্যাগ কর; তোমাদের অতি অল্পমাত্ৰ অনিষ্ট হইবে।

অনন্তর মহাবীর বাসুদেব ও অর্জ্জুন সন্ধ্যোপাসনা করিয়া রথারোহণ পূর্ব্বক যুদ্ধ বৃত্তান্ত কথোপকথন করিতে করিতে শিবিরে উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, শিবির আনন্দ শূন্য, দীপ্তি শূন্য ও নিতান্ত শ্রীভ্রষ্ট হইয়া রহিয়াছে। তখন অরাতি নিপাতন ধনঞ্জয় আকুল হৃদয় হইয়া কেশবকে কহিলেন, হে জনার্দ্দন! আজি মঙ্গল তুৰ্য্যনিঃস্বন এবং দুন্ধুভিনাদ সহকৃত শঙ্খ ও পটহের শব্দ হইতেছে না; করতালসমবেত বীণা বাদন রহিত হইয়াছে এবং বন্দিগণ আমার নিকটে স্তুতি যুক্ত, মনোহর, মঙ্গল গীত সকল গান ও পাঠ করিতেছে না। যোদ্ধাগণ আমাকে দেখিয়াই অধোমুখে পলায়ন করিতেছে; উহারা পূর্ব্বের ন্যায় আমার নিকট স্ব স্ব অনুষ্ঠিত কার্য্যের পরিচয় প্রদান করিতেছে না। হে মাধব! আজি আমার ভ্রাতৃগণ কি কুশলে আছেন? আত্মীয়গণকে দেখিয়া আমার মনে বিরুদ্ধ ভাবের উদয় হইতেছে। হে মানদ! পাঞ্চালরাজ, বিরাট ও আমার যোদ্ধৃগণ সকলে কি কুশলে আছে? আমি সংগ্রাম হইতে আগমন করিতেছি, কিন্তু অভিমন্যু ভ্রাতৃগণের সহিত প্রফুল্লচিত্তে সহাস্যবদনে কেন আমার প্রত্যুদগমন করিল না?

অভিমন্যু-অদর্শনে অর্জ্জুনের সশোক আশঙ্কা

কৃষ্ণ ও বাসুদেব এইরূপ কথোপকথন করিতে করিতে শিবিরে প্রবিষ্ট হইয়া দেখিলেন, পাণ্ডবগণ নিতান্ত অসুস্থ ও বিচেতন-প্রায় হইয়া রহিয়াছেন। দুর্ম্মনায়মান ধনঞ্জয় শিবির মধ্যে সমুদয় ভ্রাতা ও পুত্রগণকে অবলোকন করিলেন কিন্তু অভিমন্যুকে দেখিতে পাইলেন না। তখন তিনি নিতান্ত বিষ হইয়া কহিলেন, হে বীরগণ! তোমাদের সকলেরই মুখবর্ণ অপ্রসন্ন হইয়াছে; এবং তোমরা কেহই আমাকে অভিনন্দন করিতেছ না। বৎস অভিমন্যু কোথায়? আমি শুনিয়াছি, দ্রোণ চক্রব্যূহ নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন। অল্প বয়স্ক অভিমন্যু বিনা তোমাদের মধ্যে এমন আর কেহই নাই যে, তাহা ভেদ করিতে সমর্থ হয়। কিন্তু আমি তাঁহাকে ব্যূহ হইতে বিনিৰ্গম বিষয়ে উপদেশ প্রদান করি নাই। তোমরা কি সেই বালককে ব্যূহে প্রবেশিত করিয়াছিলে? পরবীরহা, মহাধনুর্দ্ধর, সুভদ্রানন্দন কি শত্রুগণের বহুসৈন্য ভেদ করিয়া যুদ্ধে বিনষ্ট হইয়াছে? বল; লোহিতাক্ষ, মহাবাহু, পর্ব্বতজাত সিংহ সদৃশ, উপেন্দ্রোপম, মহাবীর অভিমন্যু কি প্রকারে যুদ্ধে নিহত হইল। কোন্ ব্যক্তি কালমোহিত হইয়া দ্রৌপদী, কেশব ও কুন্তীর নিরন্তর প্রীতিভাজন, সুভদ্রার প্রিয় পুত্রকে বিনাশ করিল? বিক্রম, শ্রুতি ও মাহাত্মে বৃষ্ণিবীর মহাত্মা কেশবের সমকক্ষ মহাবীর অভিমন্যু কি প্রকারে সংগ্রামে বিনষ্ট হইল? সুভদ্রার দয়াভাজন, আমার নিরন্তর লালিত শৌর্য্যশালী পুত্রকে যদি দেখিতে না পাই, নিশ্চয়ই যম লোক অবলোকন করিব। মৃদুকুঞ্চিত কেশান্ত, মৃগ শাবকাক্ষ, মত্তবারণবিক্রান্ত, শালপোত সদৃশ সমুন্নত, মহাবীর অভিমন্যু সতত সস্মিত, প্রিয়ভাষী, শান্ত, গুরু বাক্যের অনুগত, অমৎসর, মহোৎসাহ, ভক্তানুকম্পী, দান্ত, অনীচানুসারী, কৃতজ্ঞ, জ্ঞানসম্পন্ন, কৃতাস্ত্র, যুদ্ধাভিনন্দী, অরাতিগণের ভয়বর্দ্ধন, আত্মীয়গণের প্রিয় ও হিতাচরণে নিযুক্ত, পিতৃগণের জয়াভিলাষী, অভূতপূৰ্ব্ব যোদ্ধা ও সংগ্রামে নির্ভয় ছিল এবং বালক হইয়াও যুবজনের ন্যায় কাৰ্য্য করিত। আমি যদি সেই প্রিয় পুত্রের সন্দর্শন প্রাপ্ত না হই, তাহা হইলে নিশ্চয়ই প্রাণ পরিত্যাগ করিব। যদি প্রদ্যুম্ন, কেশব ও আমার নিরন্তর প্রীতিভাজন, রথীগণনায় মহারথ বলিয়া পরিগণিত, যুদ্ধে আমা অপেক্ষা অর্দ্ধগুণ অধিক তরুণ বয়স্ক, মহাবাহু পুত্রকে দেখিতে না পাই, নিশ্চয়ই জীবন পরিত্যাগ করিব। প্রিয় তনয়ের সেই সুন্দর নাসা, সুন্দর ললাট, সুন্দর চক্ষু, সুন্দর ভ্রূ ও সুন্দর ওষ্ঠ সমন্বিত মুখচন্দ্র নিরীক্ষণ, সেই তন্ত্রী শব্দের ন্যায়, পুংস্কোকিলরবের ন্যায় মনোহর বাণী শ্রবণ এবং সেই দেবগণ দুর্লভ, অপ্রতিম রূপ অবলোকন না করিলে আমার শান্তিলাভের সম্ভাবনা কোথায়? অভিবাদন দক্ষ, পিতৃগণের বাক্যে অনুরক্ত অভিমন্যুকে না দেখিলে আমার হৃদয় কোন মতেই সুস্থির হইবে না।

সুকুমার, মহাৰ্হ শয়নোচিত, মহাবীর অভিমন্যু অসংখ্য সহায় সম্পন্ন হইয়াও আজি অনাথের ন্যায় ভূমিতলে শয়ন করিয়া আছে, সন্দেহ নাই। যে বীর শয়ন করিয়া অমরাঙ্গনাগণ কর্ত্তৃক উপাসিত হইত, আজি অশিব শিবাগণ ভ্রমণ করিতে করিতে সেই বাণবিদ্ধ কলেবর মহাবীরকে আকর্ষণ করিতেছে। পূর্ব্বে সূত, মাগধ ও বন্দিগণ মধুরস্বরে স্তুতি পাঠ করিয়া যে মহাবীরকে প্রবোধিত করিত, আজি শ্বাপদগণ তাহার চতুর্দ্দিকে বিকৃত স্বরে চীৎকার করিতেছে। যে মুখচন্দ্র পূর্ব্বে ছত্রচ্ছায়ায় সমাবৃত থাকিত, আজি ধূলিপটল নিশ্চয়ই তাহা সমাচ্ছন্ন করিবে। হা পুত্র! আমি তোমায় বারংবার নিরীক্ষণ করিয়াও অবিতৃপ্ত থাকিতাম; এক্ষণে কাল এই ভাগ্য হীনের নিকট হইতে তোমাকে বল পূর্ব্বক অপহরণ করিল। আজি পুণ্যবানগণের আশ্রয়, স্বীয় প্রভায় প্রদীপ্ত, মনোহর যমপুরী তোমা দ্বারা অধিকতর শোভমান হইতেছে এবং যম, বরুণ, ইন্দ্র ও কুবের তোমাকে প্রিয় অতিথি লাভ করিয়া অর্চনা করিতেছেন, সন্দেহ নাই।

নৌকা ভগ্ন হইলে বণিক যেমন বিলাপ করে, ধনঞ্জয় সেইরূপ বিলাপ করিয়া নিতান্ত দুঃখিত চিত্তে যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা করিলেন, মহারাজ! অভিমন্যু কি শত্রু বিমর্দ্দন পূর্ব্বক মহাবীরগণের সহিত সংগ্রাম করত স্বর্গের অভিমুখীন হইয়াছে? অসহায় অভিমন্যু যত্নাতিশয় সহকারে মহাবল পরাক্রান্ত বীর পুরুষদিগের সহিত যুদ্ধ করিতে করিতে সাহায্য লাভার্থী হইয়া আমাকে চিন্তা করিয়াছিল, সন্দেহ নাই। বোধ হয়, আমার বালক পুত্র অভিমন্যু কর্ণ, দ্রোণ ও কৃপ প্রভৃতি নৃশংসগণ কর্ত্তৃক নানা চিহ্নে চিহ্নিত, সুধৌতাগ্র, তীক্ষ্ণ সায়নিকরে নিতান্ত নিপীড়িত হইয়া, ‘হা তাত! এক্ষণে আমাকে পরিত্রাণ কর’, এই বলিয়া বারংবার বিলাপ করিতে করিতে ভূমিতলে নিপাতিত হইয়াছে। অথবা মহাবীর অভিমন্যু আমার ঔরস, সুভদ্রার গর্ভসম্ভূত ও বাসুদেবের ভাগিনেয়; সে এরূপ আর্ত্তনাদ করিবার পাত্র নয়।

আমার হৃদয় বজ্রসারময় ও নিতান্ত কঠিন, সন্দেহ নাই, এই নিমিত্তই সেই দীর্ঘবাহু আরক্তলোচন পুত্রের অদর্শনে এখনও বিদীর্ণ হইতেছে না। নৃশংসগণ মহাধনুর্দ্ধর হইয়া কি প্রকারে বাসুদেবের ভাগিনেয়, আমার পুত্র সেই বা কের উপর মর্ম্মভেদী শরজাল নিক্ষেপ করিল! অদীনাত্মা অভিমন্যু প্রতিদিন প্রত্যুদগমন পূর্ব্বক আমাকে অভিনন্দন করিত। আজি আমি শত্রুগণকে সংহার করিয়া আগমন করিতেছি, কিন্তু সে কেন আমার সহিত সাক্ষাৎ করিতেছে না? নিশ্চয়ই সে রুধিরাক্ত কলেবরে সমরাঙ্গনে শয়ান হইয়া নি তিত আদিত্যের ন্যায় স্বীয় দেহ প্ৰভায় ধরাতল শোভমান করিতেছে। সুভদ্রার নিমিত্ত আমার যৎপরোনাস্তি সন্তাপ জন্মিতেছে; সে সমরে অপরাঙ্মুখ পুত্রকে নিহত শ্রবণ পূর্ব্বক শোকাকুল হইয়া নিশ্চয়ই প্রাণ পরিত্যাগ করিবে। হায়! অদ্য সুভদ্রা ও দ্রৌপদী অভিমন্যুকে না দেখিয়া আমাকে কি বলিবে এবং তাহারা দুঃখাৰ্ত্ত হইলে আমিই বা কি বলিয়া তাহাদিগকে সান্ত্বনা করিব। যদি বন্ধুকে শোককৰ্ষিত চিত্তে রোদন করিতে দেখিয়া আমার হৃদয় সহস্ৰধা হইয়া না যায়, তাহা হইলে ইহা বজ্রসারময় সন্দেহ নাই।

আমি গর্বিত ধাৰ্তরাষ্ট্রগণের সিংহনাদ শ্রবণ করিয়াছি। বাসুদেবও বৈশ্যানন্দন যুযুৎসুকে বীরগণের প্রতি এইরূপ তিরস্কার বাক্য প্রয়োগ করিতে শুনিয়াছেন যে, হে অধার্মিক মহারথগণ! তোমরা অর্জ্জুনকে পরাজয় করিতে অসমর্থ হইয়া এক বালকের প্রাণ সংহার পূর্ব্বক বৃথা আনন্দিত হইতেছ! অচিরাৎ পাণ্ডবগণের বল দেখিতে পাইবে। তোমরা যখন সংগ্রামে কেশব ও অর্জ্জুনের বিপ্রিয়াচরণ করিয়াছ, তখন তোমাদের শোক সময় সমুপস্থিত হইয়াছে, তবে কেন বৃথা প্রীতি প্রফুল্ল চিত্তে সিংহের ন্যায় গর্জ্জন করিতেছ? তোমরা অবিলম্বে এই পাপ কর্মের ফল প্রাপ্ত হইবে। অধর্মের ফল অতি সত্বরেই সমুৎপন্ন হইয়া থাকে। মহামতি যুযুৎসু কোপাবিষ্ট ও দুঃখান্বিত হইয়া তাঁহাদিগকে এই কথা বলিতে বলিতে, অস্ত্র পরিত্যাগ পূর্ব্বক অপসৃত হইলেন। হে কৃষ্ণ! তুমি যুযুৎসুর বাক্য শ্রবণ করিয়াছিলে, কিন্তু আমাকে কি নিমিত্ত জ্ঞাত কর নাই? আমি ঐ বৃত্তান্ত জানিতে পারিলে তৎক্ষণাৎ সেই নৃশংস মহারথগণের সকলকেই শরানলে দগ্ধ করিতাম।

কৃষ্ণ কর্ত্তৃক অভিমন্যুনিধনবার্ত্তা জ্ঞাপন

মহাত্মা বাসুদেব ধনঞ্জয়কে পুত্র শোকে নিতান্ত কাতর হইয়া সাশ্রুনয়নে চিন্তা করিতে দেখিয়া তাঁহাকে সান্ত্বনা করিয়া কহিলেন, হে ধনঞ্জয়! এরূপ হইও না; অপলায়ী শূরগণের, বিশেষত যুদ্ধোপজীবী ক্ষত্রিয়গণের সকলেরই এই পথ। ধর্ম্ম শাস্ত্ৰজ্ঞেরা অপরাঙ্মুখ, ষুধ্যমান শূরগণের এইরূপ গতিই বিধান করিয়াছেন; অতএব নিশ্চয়ই তাহাদিগকে সংগ্রামে প্রাণ পরিত্যাগ করিতে হইবে। অভিমন্যু পুণ্য কৰ্ম্মাদিগের লোকে গমন করিয়াছে, সন্দেহ নাই। সমুদায় বীরগণই সংগ্রামে অভিমুখ হইয়া প্রাণ পরিত্যাগ করিতে আকাঙ্ক্ষা করিয়া থাকেন, মহাবীর অভিমন্যু মহাবল পরাক্রান্ত রাজপুত্রগণকে সংগ্রামে সংহার করিয়া বীরজন-কাক্ষিত মৃত্যু প্রাপ্ত হইয়াছে; অতএব তুমি শোক করিও না। পূর্ধ্বতন ধর্ম্ম সংস্থাপকগণ যুদ্ধমৃত্যুই ক্ষত্রিয়গণের সনাতন ধর্ম্ম বলিয়া স্থির করিয়া গিয়াছেন। তুমি শোক সমাবিষ্ট হইয়াছ বলিয়া তোমার এই ভ্রাতৃগণ, সুহৃৎগণ ও ভূপতিগণ সকলেই দী মনা হইয়াছেন, তুমি শান্ত বাক্যে ইহাদিগকে আশ্বাসিত কর। বেদিতব্য বিষয় তোমার বিদিত হইয়াছে, অতএব তোমার শোক করা নিতান্ত অনুচিত হইতেছে।

অর্জ্জুনের অভিমন্যু-সমরক্রম শ্রবণেচ্ছা

মহাবীর ধনঞ্জয় অদ্ভুতকর্ম্মা বাসুদেব কর্ত্তৃক এইরূপ আশ্বাসিত হইয়া শোককর্ষিত ভ্রাতৃগণকে কহিলেন, হে ভ্রাতৃগণ! সেই দীর্ঘবাহু কমলায়তলোচন অভিমন্যু যে প্রকার যুদ্ধ করিয়াছিল, শ্রবণ করিতে আমার ইচ্ছা হইতেছে। তোমাদের সমক্ষে স্বীয় পুত্রের বৈরীগণকে হস্তী, রথ, অশ্ব ও পরিবারগণের সহিত সংহার করিব। তোমরা সকলে কৃতাস্ত্র ও শস্ত্রপাণি; তোমাদের সমক্ষে বজ্ৰপাণি সুররাজও কি অভিমন্যুকে যুদ্ধে বিনষ্ট করিতে পারে? হায়! যদি পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণকে আমার পুত্রের রক্ষণে অসমর্থ জানিতাম, তাহা হইলে আমি স্বয়ংই তাঁহাকে রক্ষা করিতাম। তোমরা রথারূঢ় হইয়া শরজাল বর্ষণ করিতেছিলে, তথাপি শত্রুগণ কি প্রকারে অন্যায় সংগ্রাম করিয়া অভিমন্যুর প্রাণ সংহার করিল। কি আশ্চর্য্য! এখন জানিলাম, তোমাদের কিছুমাত্র পৌরুষ বা পরাক্রম নাই, এই জন্য অভিমন্যু তোমাদের সমক্ষেই নিপাতিত হইয়াছে। অথবা সকলই আমার দোষ; কেন না, তোমাদিগকে নিতান্ত দুর্ব্বল, ভীরু ও অকৃতনিশ্চয় জানিয়াও আমি এ স্থান হইতে গমন করিয়াছিলাম। তোমরা যদি আমার পুত্রকেও রক্ষা করিতে অক্ষম হইলে, তবে তোমাদের বর্ম্ম, শন্ত্র ও আয়ুধ সকল কি ভুষণের নিমিত্ত এবং বাক্য কি সভা মধ্যে বক্তৃতা করিবার নিমিত্ত?

পুত্রশোকসন্তপ্ত ধনঞ্জয় এই কথা বলিয়া অপূর্ণ মুখে ধনু ও খড়্গহস্তে অবস্থান করত ক্রুদ্ধ কৃতান্তের ন্যায় মুহুর্মুহু নিশ্বাস পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। তৎকালে যুধিষ্ঠির ও বাসুদেব ব্যতীত আর কোন সুহৃদই তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিতে সমর্থ হইলেন না। ঐ দুইজন তাঁহাদিগকে অত্যন্ত সম্মান ও প্রীতি করিতেন, এই নিমিত্তই তাঁহারা তৎকালে তাঁহার সহিত আলাপ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। তখন যুধিষ্ঠির, পুত্রশোকাধিকাতর রাজীবনোচন ক্রোধসন্তপ্তচিত্ত অর্জ্জুনকে কহিতে লাগিলেন।