যুধিষ্ঠির বলে, পাপ রাক্ষস অধম।
বুঝিলাম আজি তোরে স্মরিলেক যম।।
অহিংসক জনেরে হিংসয়ে যেই জন।
অল্পকালে দণ্ড তারে করয়ে শমন।।
না বুঝিয়া কি কারণে করিস্ কুকর্ম্ম।
পাপেতে পড়িলি দুষ্ট, মজাইলি ধর্ম্ম।।
ধর্ম্ম নষ্ট করি যার সুখে অভিলাষ।
সর্ব্ব ধর্ম্ম নষ্ট হয়, নরকেতে বাস।।
ফলিবে এখনি দুষ্ট তোর দুষ্টাচার।
হইবি ভীমের হাতে সবংশে সংহার।।
দ্রুপদ নন্দিনী কৃষ্ণা এই সব দেখি।
পরিত্রাহি ডাকে দেবী মুদি দুই আঁখি।।
হা কৃষ্ণ করুণাসিন্ধু কৃপার নিধান।
করহ কমলাকান্ত কষ্টে পরিত্রাণ।।
তোমারে পাণ্ডব বন্ধু বলি লোকে কয়।
সেই কথা পালন করিতে যোগ্য হয়।।
কোথা গেলে ভীমসেন, করহ উদ্ধার।
তোমা বিনা এ দুস্তরে কে তারিবে আর।।
কোথায় রহিলে গিয়া বীর ধনঞ্জয়।
রক্ষা কর, পাণ্ডুবংশ মজিল নিশ্চয়।।
বিকলা হইয়া কৃষ্ণা কান্দে উচ্চরায়।
কত দূরে ভীমসেন শুনিবারে পায়।।
বুঝিল অমনি বীর, কান্দে যাজ্ঞসেনী।
ব্যগ্র হয়ে বীরবর ধাইল তখনি।।
দেখিল, পলায় দুষ্ট হরি চারি জনে।
ডাকিয়া কহিল ভীম আশ্বাস বচনে।।
তিলার্দ্ধ মনেতে ভয় না কর রাক্ষসে।
এখনি মারিব দুষ্টে চক্ষুর নিমিষে।।
এত বলি উপাড়িয়া দীর্ঘ তরুবর।
ডাকি বলে, রহরে পাপিষ্ঠ দুরাচার।।
ভীমের পাইয়া শব্দ বেগে ধায় জটা।
গগনমণ্ডলে যেন নবমেঘ ঘটা।।
অসুরের কর্ম্ম দেখি বেগে বীর ধায়।
ঘুরায়ে বৃক্ষের বাড়ি মারিল মাথায়।।
বৃক্ষাঘাতে ব্যথা পেয়ে অতি ক্রোধমনে।
ভীমেরে ধরিল দুষ্ট ছাড়ি চারি জনে।।
ধাইয়া ভীমের হাতে দিল এক টান।
চলিতে নারিল ভীম, পায় অপমান।।
ক্রোধে কম্পমান তনু, বৃক্ষ লয়ে হাতে।
প্রহার করিল দুষ্ট মারুতির মাথে।।
পরশি ভীমের মাথে বৃক্ষ হৈল চূর।
বক্ষেতে চাপড় ক্রোধে মারিল অসুর।।
করাঘাতে কম্পমান বৃকোদর বীর।
অঙ্গে বহে শ্রমজল, হইল অস্থির।।
মারিল জটার বুকে দৃঢ় মুষ্ট্যাঘাত।
পর্ব্বত উপরে যেন হৈল বজ্রাঘাত।।
ভীমের ভৈরব নাদ, অসুরের শব্দ।
কানন নিবাসী যত শুনি হৈল স্তব্ধ।।
বৃক্ষাঘাতে করাঘাতে আর পদাঘাতে।
দ্বিতীয় প্রহর যুদ্ধ হৈল হেনমতে।।
মল্লযুদ্ধে বিশারদ দোঁহে মহাবল।
সিংহনাদে প্রপূরিল সর্ব্ব বনস্থল।।
ধরাধরি করি দোঁহে ক্ষিতিমধ্যে পড়ি।
যুগল হস্তীর প্রায় যায় গড়াগড়ি।।
ক্ষণেক উপরে ভীম, ক্ষণেক রাক্ষস।
সমান শকতি দোঁহে সমান সাহস।।
তবে বীর বৃকোদর পেয়ে অবসর।
ত্বরিতে উঠিল জটাসুরের উপর।।
বুকের উপরে বসি পদে চাপে কর।
বাম হাতে গলা চাপি ধরিল সত্বর।।
তুলিয়া দক্ষিণ কর মুষ্ট্যাঘাত মারি।
ভাঙ্গিয়া ফেলিল তার দন্ত দুই সারি।।
পদাঘাতে শিরোদেশ করিলেক চূর।
ত্যজিল পরাণ পাপ দুরন্ত অসুর।।
দেখিয়া আনন্দযুক্ত ধর্ম্মের নন্দন।
শিরোঘ্রাণ করি ভীমে দেন আলিঙ্গন।।
কৌতুকে লোমশ ধৌম্য করে আশীর্ব্বাদ।
মরিল অসুর দুষ্ট, ঘুচিল বিষাদ।।
আসিয়া আশ্রমে সবে হরিষ বিধানে।
নিত্য নিয়মিত কাজ কৈল জনে জনে।।
পরদিন প্রাতঃকালে ধর্ম্ম অধিকারী।
কহেন লোমশ প্রতি করযোড় করি।।
মম এক নিবেদন, শুন মহাশয়।
অতঃপর এইস্থানে থাকা যোগ্য নয়।।
দেখ দুষ্ট জটাসুর মরিল পরাণে।
শুনিয়া রুষিবে আসি তার বন্ধুজনে।।
সে কারণে এই স্থান বাসযোগ্য নয়।
বুঝিয়া করহ কর্ম্ম উচিত যে হয়।।
লোমশ বলেন, সত্য কহিলে সুমতি।
এই যুক্তি সার বলি লয় মম মতি।।
ব্যাসের আশ্রম বদরিকা পুণ্যস্থানে।
তথায় চলহ, সবে থাকি প্রীত মনে।।
এতেক শুনিয়া সবে লোমশের স্থানে।
প্রশংসা করিয়া তথা যায় সর্ব্বজনে।।
পর্ব্বত উপরে বৃক্ষচ্ছায়া সুশীতল।
কমলে শোভিত রম্য সরোবর জল।।
দেখেন অনেকবিধ কৌতুক বিহিত।
বদরিকা পুণ্যাশ্রমে সবে উপনীত।।
আনন্দে রহেন তথা চারি সহোদর।
অর্জ্জুন বিচ্ছেদে সবে কাতর অন্তর।।
অমৃত সমান মহাভারতের কথা।
কাশীরাম রচিল পয়ার পুণ্য গাঁথা।।