৭১তম অধ্যায়
সৃঞ্জয়ের মৃতপুত্রপ্রাপ্তি – শোকশান্তি
ব্যাসদেব কহিলেন, হে ধর্ম্মরাজ! রাজা সৃঞ্জয় পুণ্য জনক, আয়ুষ্কর এই ষোড়শরাজিক উপাখ্যান শ্রবণ পূর্ব্বক তুষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিয়া রহিলেন। তখন দেবর্ষি নারদ তাঁহাকে তদবস্থ অবলোকন করিয়া কহিলেন, মহারাজ! আমি যে সমস্ত উপাখ্যান কীৰ্ত্তন করিলাম, তুমি ত তৎসমুদায় শ্রবণ ও তৎ সমুদায়ের মর্ম্মাবধারণ করিয়াছ? অথবা ঐ সকল উপাখ্যান শূদ্ৰাপতির শ্রাদ্ধের ন্যায় নিতান্ত নিষ্ফল হইয়া গেল।
তখন সৃঞ্জয় কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, হে তপোধন! পূর্ব্ব পূর্ব্বতন যাজ্ঞিক রাজর্ষিগণের উৎকৃষ্ট উপাখ্যান শ্রবণ করিয়া বিস্ময় বশত আমার সমুদায় শোক দিনকরকরাপসারিত অন্ধকারের ন্যায় অপনীত হইয়াছে; আমি বিগতপাপ ও ব্যথা শূন্য হইয়াছি; এক্ষণে আজ্ঞা করুন, আমাকে কি করিতে হইবে। নারদ কহিলেন, মহারাজ! তুমি ভাগ্য বলে বিগতশোক হইয়াছ; এক্ষণে স্বীয় অভিলষিত বর প্রার্থনা কর অবশ্যই তাহা প্রাপ্ত হইবে; আমরা মিথ্যাবাদী নহি। সৃঞ্জয় কহিলেন, ভগবন্! আপনি আমার প্রতি প্রসন্ন হওয়াতেই আমি কৃতার্থ ও পরমাহ্লাদিত হইয়াছি; আপনি যাহার প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করেন, তাহার কোন বিষয়ই অসুলভ হয় না। তখন নারদ কহিলেন, মহারাজ! দস্যুগণ তোমার পুত্রকে বৃথা নিহত করিয়াছে; আমি তাঁহাকে প্রোক্ষিত পশুর ন্যায় ঘোর নৱক হইতে উদ্ধার করিয়া তোমায় প্রদান করিতেছি।
অনন্তর প্রসন্ন চিত্ত দেবর্ষি নারদ প্রভাবে রাজা সৃঞ্জয়ের সেই কুবেরতনয় সদৃশ অদ্ভুত পুত্র প্রাদুর্ভূত হইল। সৃঞ্জয় পুত্রলাভে সাতিশয় প্রীত ও প্রসন্ন হইয়া প্রভূত দক্ষিণা দান সহকারে বহুবিধ যাগ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিলেন। হে ধর্ম্মরাজ! সেই সুবর্ণষ্ঠীবী অকৃতকার্য্য নিতান্ত ভীত, অযাজ্ঞিক ও অপত্য বিহীন ছিলেন এবং যুদ্ধেও বিনষ্ট হন নাই; এই নিমিত্তই পুনরায় তিনি জীবিত হইলেন। কিন্তু মহাবীর অভিমন্যু সৈন্যগণের অভিমুখীন হইয়া সহস্র সহস্র শত্রুগণকে সন্তপ্ত করত কৃতার্থতা লাভ করিয়া রণে নিহত হইয়াছেন। লোকে ব্রহ্মচর্য্য, প্রজ্ঞা, শাস্ত্র জ্ঞান ও প্রধান প্রধান যজ্ঞানুষ্ঠান দ্বারা যে সমস্ত অক্ষয় লোক লাভ করিয়া থাকে, মহাবীর অভিমন্যুরও সেই সমুদায় লোক প্রাপ্তি হইয়াছে। বিদ্বান্ লোকেরা পুণ্য কাৰ্য্য দ্বারা প্রতিনিয়ত স্বর্গ প্রাপ্তির প্রত্যাশা করিয়া থাকেন; কিন্তু স্বর্গবাসীরা কদাচ এই পৃথিবীতে অধিবাস করিবার প্রার্থনা করেন না অতএব সেই স্বৰ্গন্থ অর্জ্জুনাত্মজ অভিমন্যুকে অত্যল্প অপ্রাপ্য পার্থিব সুখ উপভোগের নিমিত্ত পৃথিবীতে আনয়ন করা কোন মতেই সুসাধ্য নহে। যোগীরা সমাধি বলে পবিত্র দর্শন হইয়া যে গতি লাভ করিয়া থাকেন এবং উৎকৃষ্ট যজ্ঞানুষ্ঠায়ী ও কঠোর তপস্বীদিগের যে গতি হইয়া থাকে, মহাবীর অর্জ্জুনতনয় অভিমন্যু সেই অক্ষয় গতি লাভ করিয়াছেন। মহাবীর অভিমন্যু দেহান্তে দেহান্তর লাভ করিয়া অমৃতময় স্বীয় রশ্মি প্রভাবে বিরাজিত হইতেছেন। ঐ মহাবীর এক্ষণে স্বীয় চান্দ্রমসী তনু লাভ করিয়াছেন; অতএব তাহার নিমিত্ত আর শোক করা কর্ত্তব্য নহে।
যুধিষ্ঠিরের শোকশান্তি
হে যুধিষ্ঠির! এক্ষণে তুমি এই সমস্ত অবগত হইয়া ধৈৰ্য্যাবলম্বন পূর্ব্বক শত্রু বিনাশে প্রবৃত্ত হও। বরং জীবিত ব্যক্তিদিগের নিমিত্ত শোক করা আমাদের কর্ত্তব্য; কিন্তু স্বর্গপ্রাপ্ত মহাত্মাদের নিমিত্ত অনুতাপ করা কদাপি বিধেয় নহে। শোক করিলে তাহার পাপ পরিবর্দ্ধিত হয়; এই নিমিত্ত পণ্ডিতেরা শোক পরিত্যাগ পূর্ব্বক মঙ্গল লাভার্থ যত্নবান হইবে। হর্ষ, অভিমান ও সুখ প্রাপ্তির অভিলাষ করা বিধেয়; বুধগণ এই রূপ অবধারণ করিয়া কদাচ শোকাকুল হন না। ফলত শোক শোকান্তরের উৎপাদন করিয়া থাকে। এক্ষণে তুমি এই সমস্ত সম্যক অবগত হইয়া উত্থিত ও যত্নবান হও; আর বৃথা শোকাকুল হইও না। তুমি মৃত্যুর উৎপত্তি, অনুপম তপ ও সৰ্ব্বভূত সমতা এবং সম্পত্তির অস্থৈর্য্য ও সৃঞ্জয়ের মৃত পুত্রের পুনরায় জীবন প্রাপ্তির বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত শ্রবণ করিলে; এক্ষণে আর শোক করিও না; আমি চলিলাম।’ এই বলিয়া ভগবান্ ব্যাস তথায় অন্তর্ধান করিলেন।
নিৰ্ম্মল নভোমণ্ডল সদৃশ শ্যামকলেবর ভগবান্ ব্যাস এইরূপ আশ্বাস প্রদান পূর্ব্বক অন্তর্হিত হইলে ধর্ম্মনন্দন মহারাজ যুধিষ্ঠির মহেন্দ্র প্রতিম তেজস্বী, ন্যায়োপার্জিত বিত্ত পূর্ব্বতন নৃপতিদিগের যজ্ঞ সম্পত্তির বিষয় শ্রবণে পরম পরিতুষ্ট হইয়া মনে মনে উহার সবিশেষ প্রশংসা করত শোক পরিত্যাগ করিলেন; কিন্তু অর্জ্জুনকে কি বলিব এই মনে করিয়া পুনরায় চিন্তাসাগরে নিমগ্ন হইলেন।
অভিমন্যুবধপর্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত