যুধিষ্ঠির বলে, মুনি কর অবধান।
ভীমের বিলম্বে মোর আকুল পরাণ।।
কেমন কুবুদ্ধি প্রভু হৈল মম মনে।
ভীমেরে পাঠানু আমি পুষ্পের কারণে।।
যখন বিপদকাল হয় উপস্থিত।
পাপযুক্ত বুদ্ধিতে আচ্ছন্ন হয় চিত।।
কুকর্ম্ম যতেক বুঝে সুকর্ম্মের প্রায়।
নহে প্রবর্ত্তিত কেন কপট পাশায়।।
আশ্চর্য্য দেখহ আর বিধির ঘটন।
পঞ্চ ভাই কৃষ্ণা সহ আইলাম বন।।
অস্ত্রশিক্ষা হেতু পার্থ স্বর্গেতে রহিল।
মিছা কার্য্যে পুষ্প হেতু ভীমসেন গেল।।
ব্যস্ত প্রাণ না দেখিয়া দোঁহাকার মুখ।
বিধি দেয় দুঃখের উপরে আর দুখ।।
এত বলি ঘটোৎকচে করেন স্মরণ।
স্মরণ করিবামাত্র ভীমের নন্দন।।
আসিয়া সবার পদে করিল প্রণতি।
আশীর্ব্বাদ করিয়া বলেন নরপতি।।
ভাগ্যে আজি দেখিলাম বদন তোমার।
মন দিয়া শুন বাপু কহি সমাচার।।
পুষ্প হেতু গেল ভীম জনক তোমার।
বহুদিন না পাই তাহার সমাচার।।
এই হেতু চিন্তা সদা হতেছে আমার।
ঘটোৎকচ এ সঙ্কটে করহ উদ্ধার।।
প্রাণের অধিক মম বৃকোদর ভাই।
শীঘ্রগতি চল সবে, তথাকারে যাই।।
আমারে লইবে আর ভাই দুই জন।
সকল বর্ণের গুরু লইবে ব্রাহ্মণ।।
দ্রুপদ নন্দিনী কৃষ্ণা জননী তোমার।
সে কারণে লইবারে, মোর অঙ্গীকার।।
ঘটোৎকচ বলে, দেব তোমার আজ্ঞায়।
পৃথিবী বহিতে পারি কত বড় দায়।।
মোর পৃষ্ঠে আরোহণ কর সব জনে।
তোমার প্রসাদে তথা যাব এইক্ষণে।।
এত শুনি তুষ্ট হয়ে ধর্ম্মের নন্দন।
প্রশংসা করিয়া বহু দেন আলিঙ্গন।।
আরোহণ কৈল আগে ব্রাহ্মণ মণ্ডলী।
কৃষ্ণা সহ তিন ভাই বৈসে কুতূহলী।।
চলিল ভীমের পুত্র ভীম পরাক্রম।
অনায়াসে গমনে তিলেক নাহি শ্রম।।
দেখিয়া বনের শোভা আনন্দিত সবে।
কুসুমিত কাননে কোকিল কলবরে।।
মধুপানে মত্ত হয়ে ভ্রমর ঝংঙ্কার।
অনঙ্গ মোহিত অঙ্গ রঙ্গে সবাকার।।
পশু পক্ষী মৃগেতে পূরিত বনস্থল।
দিব্য সরোবর, তাহে শোভিত কমল।।
বিহরে কৌতুকে রাজহংস চক্রবাক।
নানাবর্ন মৎস্য বিহরে লাখে লাখ।।
বিবিধ তড়াগ কৃপ বহু নদ নদী।
স্থাবর জঙ্গম যত, কে করে অবধি।।
প্রতি ডালে নানা পক্ষী করে কলবর।
কৌতুকে দেখিছে যেন মহামহোৎসব।।
লঙ্ঘিয়া উদ্যান সব উপবন যত।
উদ্দেশ পাইল গন্ধমাদন পর্ব্বত।।
নানা কথা কহিতে লাগিল মুনিগণ।
শুনিয়া সানন্দ বড় ধর্ম্মের নন্দন।।
এইমত অল্পক্ষণে রাজা যুধিষ্ঠির।
উপনীত যথা আছে বৃকোদর বীর।।
দেখিল অনেক সৈন্য কুবের কিঙ্কর।
যুদ্ধেতে লইল প্রাণ বীর বৃকোদর।।
দিব্য সরোবর দেখে অগাধ সলিল।
কমল কুমুদ রক্ত শ্বেত পীত নীল।।
জলজন্তু বিহঙ্গম অতি মনোহর।
কুসুম উদ্যান চারি তটের উপর।।
ক্রীড়ায় কৌতুকী মন ভীম মহামতি।
হেনকালে দেখিল আগত ধর্ম্মপতি।।
লোমশ ধৌম্যের কৈল চরণ বন্দন।
মাদ্রীপুত্র দুই জনে কৈল আলিঙ্গন।।
মধুর সম্ভাষে তুষ্টা কৈল যাজ্ঞসেনী।
ভীমে সম্বোধিয়া কহে ধর্ম্ম নৃপমণি।।
শুন ভাই, তব যোগ্য নহে এই কর্ম্ম।
দেব দ্বিজ হিংসা নহে ক্ষত্রিয়ের ধর্ম্ম।।
হেন কর্ম্ম কভু নাহি করিবে সর্ব্বথা।
কিছু না কহিয়া ভীম রহে হেঁট মাথা।।
বিদায় লইল তবে ঘটোৎকচ বীর।
দিন কত তথায় রহেন যুধিষ্ঠির।।
সুবর্ণ পঙ্কজ পুষ্প তুলি সর্ব্বজনে।
ইষ্টের অর্চ্চনা করে আনন্দিত মনে।।
ছায়া সুশীতল জল, স্থল মনোরম।
সহজে সুখের স্থান, দেবের আশ্রম।।
মৃগয়া করেন নিত্য ভীম মহাবল।
আনয়ে বনের ফল ব্রাহ্মণ সকল।।
ভক্তিভাবে দ্রুপদ নন্দিনী ভক্তিমনা।
ব্রাহ্মণ পালনে রতা জননী সমানা।।
এমনি কৌতুকযুক্ত আছে সর্ব্বজন।
একদিন শুন তথা দৈবের ঘটন।।
মৃগয়া করিতে ভীম গেল দূর বনে।
ধৌম্য পুরোহিত গেল সরোবর স্নানে।।
লোমশ পুষ্পের হেতু প্রবেশিল বন।
নিঃসহায় আশ্রমে থাকেন চারিজন।।
হেনকালে জটাসুর বকের বান্ধব।
বন্ধুর পরম শত্রু জানিয়া পাণ্ডব।।
হিংসা হেতু আশ্রয় করিল সেই বন।
ছিদ্র চাহি সাবধানে থাকে অনুক্ষণ।।
না পারে হিংসিতে দুষ্ট ভীমে করি ভয়।
বিশেষ রক্ষক মন্ত্র ব্রাহ্মণ পঠয়।।
দৈবযোগে সেই দি দেখি শূন্যালয়।
শীঘ্রগতি আসে তথা দুষ্ট দুরাশয়।।
ভয়ঙ্কর মূর্ত্তি অতি গভীর গর্জ্জনে।
কহিতে লাগিল দুষ্ট ধর্ম্মের নন্দনে।।
আরে পাপমতি দুষ্ট পাপিষ্ঠ পাণ্ডব।
হিড়িম্বক আদি মোর বন্ধু ছিল সব।।
সবারে মারিল দুষ্ট ভীম তোর ভাই।
সেই অনুতাপে আমি নিদ্রা নাহি যাই।।
স্ববাঞ্ছিত ফল আজি বিধাতা ঘটাল।
সে কারণে চারি জনে একান্তে মিলিল।।
নিশ্চয় নিধন আজি করিব সবাকে।
ভীমার্জ্জুন মরিবেক তোমাদের শোকে।।
নিপাত হইল শত্রু, কাল হৈল পূর্ণ।
এতেক বলিয়া দুষ্ট ধরিলেক তূর্ণ।।
পৃষ্ঠে আরোপিয়া সবে উঠি শীঘ্রগতি।
ভীমে ভয় করিয়া পলায় দুষ্টমতি।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।