অতঃপর ভীম, পরাক্রমে ভীম,
চলিল উত্তর পথে।
দুই ভিতে যত, আছয়ে পর্ব্বত,
নানাবর্ণ বৃক্ষ তাতে।।
পরম কৌতুকে, আপনার সুখে,
স্বচ্ছন্দ গমনে যায়।
মহাবলবান, কি করে সন্ধান,
কে বুঝিবে অভিপ্রায়।।
কত দিনান্তর, গন্ধ গিরিবর,
বন উপবন শোভা।
উচ্চ সব শাখা, বিস্তারে আলেখা,
নব জলধর আভা।।
সপ্ত শৃঙ্খ তথি, শোভা করে অতি,
তাহে নানা তরুগণ।
পবন নন্দন, আনন্দিত মন,
সুখে কৈল আরোহণ।।
প্রতি শৃঙ্গে পক্ষ, মৃগ লক্ষ লক্ষ,
পশুগণ অগণিত।
নানা পুষ্পবনে, মধুকর গণে,
মধুপানে আনন্দিত।।
কোকিল কাকলি, গুঞ্জরিছে অলি,
বিবিধ পক্ষীর রব।
দেখে নানা স্থানে, সকল সোপানে,
দেবের আশ্রয় সব।।
তাহার উত্তর, রম্য সরোবর,
সুবর্ণ পঞ্চজ বন।
দক্ষিণ পবন, বহে অনুক্ষণ,
আমোদে মোহিত মন।।
গন্ধ অনুসারে, চলিল উত্তরে,
পুষ্প হেতু মহাবুদ্ধি।
দেখি সরোবর, বীর বৃকোদর,
জানিল কার্য্যের সিদ্ধি।।
সুবাসিত জলে, কনক কমলে,
মধুপান করে ভৃঙ্গ।
তথি লাখে লাখ, হংস চক্রবাক,
ভ্রমে সহচরী সঙ্গ।।
ডাহুকী ডাহুকে, ভ্রমে নানা সুখে,
সারস সরস মতি।
পুষ্প মকরন্দ সদা বহে গন্ধ,
বায়ু বহে মন্দগতি।।
কারণ্ডববৃন্দ, পরম আনন্দ,
সদাই সানন্দ হয়ে।
মজি মনোভাবে, কেলি করে সবে,
নিজ পরিবারে লয়ে।।
তথা লক্ষ লক্ষ, যক্ষরাজ পক্ষ
সশস্ত্র রক্ষক রয়।
অপূর্ব্ব শোভয়, দেবতা আলয়,
দেখি বীর মুগ্ধ হয়।।
নির্ভয় শরীর, বৃকোদর বীর,
দেখিয়া নির্ম্মল জল।
স্নান করি হৃষ্ট, পূজা কৈল ইষ্ট,
কৌতুকে তুলে কমল।।
দেখি পরস্পর, কহে অনুচর,
কুবের কিঙ্কর যত।
দেবের উদ্যানে, ভয় নাহি মনে,
দেখি যে অজ্ঞান মত।।
কেহ বলে দুষ্ট, না করহ নষ্ট,
কনক কমল ফুল।
অল্পতর প্রাণ, মানুষ অজ্ঞান,
কি জানে ইহার মূল।।
কেহ সাধুজন , মধুর বচন,
কহে ভীমসেন প্রতি।
কহ মহামতি, কাহার সন্ততি,
কি হেতু হেথায় গতি।।
এই সরোবর, যক্ষের ঈশ্বর,
অধিপ ইহার হয়।
দেখি সাধ হেন, ভাল মন্দ জ্ঞান,
তারে নাহি কর ভয়।।
ভীম বলে মোর, নাম বৃকোদর,
তারে নাহি কর ভয়।।
ভীম বলে মোর, নাম বৃকোদর,
পাণ্ডুর নন্দন আমি।
ভয় নাহি মনে, এ তিন ভুবনে,
স্বচ্ছন্দে সর্ব্বত্র ভ্রমি।।
ক্ষিতিপালশ্রেষ্ঠ, মম ভাই জ্যেষ্ঠ,
যুধিষ্ঠির মহারাজা।
পুষ্প অনুসারে, পাঠাইলা মোরে,
করিবেন দেবপূজা।।
পুষ্প লয়ে আমি, যাব শীঘ্রগামী,
করিতে ঈশ্বরসেবা।
অন্য কর্ম্ম নয়, কি কারণে ভয়,
এমত দুর্ব্বল কেবা।।
অনুচর কয়, শুন মহাশয়,
যক্ষরাজে গিয়া বল।
নহিলে বলহ, করিবে কলহ,
তবে কি হইবে ভাল।।
হাসি বৃকোদর, কহে ওহে চর,
কি হেতু যাইব তথা।
আসিয়া পাণ্ডব, পুষ্প নিল সব,
কহ গিয়া এই কথা।।
ভীম মহাবল, তোলয়ে কমল,
না মনিল যদি মানা।
কুবের কিঙ্কর, হাতে ধনুঃশর,
রুষিল সকল সেনা।।
ভীমের উপর, সবে এড় শর,
বৃষ্টিবৎ পড়ে গায়।
ক্রোধে বৃকোদর, উঠিয়া সত্বর,
মারিল বৃক্ষের ঘায়।।
মারিলেক যতেক, কহিব কতেক,
যে কিছু আছিল শেষ।
কান্দি উচ্চৈঃস্বরে, কহিল কুবেরে
নিশ্চয় মজিল দেশ।।
নর একজন, অতি বলবান,
মারিয়া রক্ষককুল।
করিলেক হত, সরোবরে যত,
আছিল কমল ফুল।।
কহে নাম মোর, বীর বৃকোদর,
পাণ্ডু নৃপতি সুত।
শুন মহাশয়, কহিনু নিশ্চয়,
যক্ষকুল হৈল হত।।
কহে যক্ষরাজ, দ্বন্দ্বে নাহি কাজ,
তনয় অধিক হয়।
আমার উত্তর, কহিয়া সত্বর,
পুষ্প দেহ যত চায়।।
আসি চরগণে, মধুর বচনে,
সান্ত্বাইল ভীমসেনে।
হেথা ধর্ম্মসুত, ত্রিবিধ উৎপাত,
দেখয়ে শর্ব্বরী দিনে।।
উচাটন মতি, মুনিগণ প্রতি,
করিলেন নিবেদন।
কহ মুনিবর, ভাই বৃকোদর,
না আইল কি কারণ।।
মুনিগণ কয়, না করিহ ভয়,
ভীমে কে হিংসিতে পারে।
কহে যুধিষ্ঠির, প্রাণ নহে স্থির,
যাবৎ না দেখি তারে।।
ভারতের কথা, অতি সুখদাতা,
কহিলেন মুনি ব্যাস।
পাঁচালির ছন্দে, মনের আনন্দে,
বিরচিল তাঁর দাস।।