৭০তম অধ্যায়
পর্ণাদ-দ্বিজের দময়ন্তীর নিকট নলবৃত্তান্ত-জ্ঞাপন
বৃহদশ্ব কহিলেন, “মহারাজ! বহুকাল অতীত হইলে পর্ণাদনামা এক ব্রাহ্মণ নগরে প্রত্যাগমনপূর্ব্বক দময়ন্তীকে কহিলেন, “হে কল্যাণি! আমি নলের অন্বেষণ-প্রসঙ্গে একদা অযোধ্যানগরীতে উপনীত হইয়া মহারাজ ঋতুপর্ণের সহিত সাক্ষাৎ করিলাম ও আপনার আদেশানুসারে তাঁহার নিকট সেই সকল বাক্য বারংবার অবিকল বর্ণন করিলাম; কিন্তু তিনি বা তাঁহার পরিষদবর্গ কোন প্রত্যুত্তর প্রদান করিলেন না। অনন্তর? আমি ভূপতির নিকট বিদায় গ্রহণপূর্ব্বক প্রত্যাগমন করিতেছি, এই অবসরে বাহুকনামা এক রাজপুরুষ আমাকে নির্জ্জনে আহ্বান করিল; সে দেখিতে অতি বিরূপ ও হ্রস্ববাহু, রাজার সারথ্যস্বীকার করিয়া তথায় অবস্থিতি করিতেছে। সে ব্যক্তি অতিদ্রুতবেগে অশ্বচালনা ও সুপ্ৰণালীক্ৰমে ভোজনসামগ্ৰী-সকল উত্তমরূপে প্ৰস্তুত করিতে পারে।
‘বাহুক ঘন ঘন দীর্ঘনিশ্বাসপরিত্যাগ ও অনর্গল অশ্রুজলবিসর্জ্জন করিয়া, আমাকে কুশলপ্রশ্নপূর্ব্বক কহিল, “কুলকামিনীগণ বিষমদশাপ্রাপ্ত হইলেও স্বয়ং আপনাকে রক্ষা করে; এই নিমিত্ত ঐসকল পতিপরায়ণারা নিঃসন্দেহ স্বৰ্গলাভ করিয়া থাকে। তাহারা ভর্ত্তৃবিরহিত হইলেও কদাচ ক্ৰোধাবিষ্ট হয় না, প্রত্যুত সৎপথ অবলম্বনপূর্ব্বক, আপনার প্রাণরক্ষা করে। অতএব সেই নলরাজ তাদৃশ বিষমদশাগ্ৰস্ত ও সুখপরিভ্রষ্ট হইয়া মুগ্ধহৃদয়ে দময়ন্তীকে যে পরিত্যাগ করিয়াছেন, তদ্বিষয়ে দময়ন্তীর ক্ৰোধ করা কোনক্রমে উচিত নহে। নল-নৃপতি পক্ষিগণকর্ত্তৃক হতবসন ও মনঃপীড়ায় নিতান্ত ব্যথিত হইয়া অতিকষ্টে প্ৰাণ যাত্রা নির্ব্বাহ করিতেছেন; এক্ষণে তাঁহার উপর ক্ৰোধ করা দময়ন্তীর উচিত নহে। নলরাজ দময়ন্তীর প্রতি আদরই প্ৰকাশ করুন, বা অনাদরই প্রকাশ করুন, তথাচ তাহাকে রাজ্যভ্রষ্ট, শ্ৰীহীন, ক্ষুধিত ও একান্ত দুঃখিত নিরীক্ষণ করিয়া ক্ৰোধ করা কোনক্রমেই দময়ন্তীর উচিত নহে।” আমি বাহুকমুখে এই কথা শ্রবণ করিয়া ত্বরিতগমনে এই স্থানে আগমন করিলাম; এক্ষণে আপনি এ বিষয়ে যাহা বিবেচনা করেন, করুন।”
“এইসকল কথা শুনিয়া দময়ন্তী বাষ্পাকুললোচনে নির্জ্জনে জননীসন্নিধানে গমন করিয়া আদ্যোপান্ত সমুদয় নিবেদন করিলেন, “মাতঃ! আপনি এই কথা কদাচ পিতার কর্ণগোচর করিবেন না। আমি দ্বিজসত্তম সুদেবকে এক্ষণে আপনার নিকট আনয়ন করিব; কিন্তু যদি আপনার মদীয় প্রিয়কাৰ্য্যসাধন করিবার বাসনা থাকে, তবে যাহাতে পিতা এই বিষয়ের বিন্দুবিসর্গও জানিতে না পারেন, তাহাই করিতে হইবে। হে মাতঃ! সুদেব যেরূপে আমাকে বান্ধব-সন্নিধানে আনয়ন করিয়াছেন, এক্ষণে তিনি সেইরূপে অনতিবিলম্বে নলের প্রত্যানয়নার্থ নির্ব্বিঘ্নে অযোধ্যায় যাত্রা করুন।”
নলাকৰ্ষণার্থ দূতমুখে দময়ন্তীর পুনঃস্বয়ংবর প্রস্তাব
“অনন্তর দময়ন্তী পৰ্ণাদকে বিশ্রান্ত ও গতক্লম দেখিয়া প্রার্থনাধিক অর্থদানদ্বারা অর্চনা করিয়া কহিলেন, “হে দ্বিজবর! নলরাজ আগমন করিলে আমি পুনরায় আপনাকে অর্থ প্রদান করিব। আপনি আমার অসীম উপকার করিয়াছেন, এরূপ আর কেহই করিবে না। আমি আপনারই প্ৰসাদে অবিলম্বে স্বামিসমাগম লাভ করিব।’ ব্ৰাহ্মণ এই কথা শ্রবণ করিয়া আশীৰ্বাদ প্রয়োগপূর্ব্বক দময়ন্তীকে আশ্বাসিত করিয়া কৃতাৰ্থম্মন্যচিত্তে গৃহাভিমুখে প্রস্থান করিলেন। অনন্তর দময়ন্তী দুঃখিতমনে মাতৃসন্নিধানে সুদেবকে সম্ভাষণ করিয়া কহিলেন, “হে সুদেব! তুমি কামগামীর ন্যায় শীঘ্র অযোধ্যানগরীতে উপনীত হইয়া মহারাজ ঋতুপর্ণকে কহিবে যে, ভীমসূতা দময়ন্তর পুনঃস্বয়ংবর হইবে! অনেকানেক রাজা ও রাজপুত্ৰগণ স্বয়ংবরসভায় গমন করিতেছেন। আগামীকাল স্বয়ংবরের দিন নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। দময়ন্তী দিবাকর সমুদিত হইলেই দ্বিতীয় ভর্ত্তাকে বরণ করিবেন। যদি আপনার ইচ্ছা হয়, তবে শীঘ্ৰ গমন করুন। নলরাজ জীবিত আছেন কি না দময়ন্তী ইহার কিছুই নিশ্চয় করিতে না পারিয়া ঈদৃশ অধ্যবসায় অবলম্বন করিয়াছেন।” এই বলিয়া তিনি সুদেবকে বিদায় দিলেন। অনন্তর সুদেব ঋতুপর্ণসন্নিধানে সমুপনীত হইয়া আদ্যোপান্ত দময়ন্তীবাক্য-সকল নিবেদন করিলেন।”