৭০তম অধ্যায়
নৃপতির বর্জ্জনীয় নীতি
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! কিরূপ ব্যবহার অবলম্বন করিলে ইহলোক ও পরলোকে অনায়াসে সুখসম্ভোগে সমর্থ হইতে পারা যায়?”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! ধৰ্ম্মচৰ্য্যাদি গুণ ষট্ত্রিংশৎ প্রকার। ঐ ষট্ত্রিংশৎ গুণ রাগদ্বেষহীনতাদি ষট্ত্রিংশৎ-গুণযুক্ত হইলেই শোভা পাইয়া থাকে। লোকে ঐ সমুদয় গুণসম্পন্ন হইলে গুণবান্ বলিয়া বিখ্যাত হয়। অতএব রাজার ঐ সমুদয় গুণ উপার্জ্জন করা নিতান্ত আবশ্যক। এক্ষণে ভূপতি রাগদ্বেষবিহীন হইয়া ধৰ্ম্মানুষ্ঠান, লোভাদিশূন্য হইয়া লোকের প্রতি স্নেহপ্রকাশ, নিষ্ঠুরতা পরিত্যাগ করিয়া অর্থোপার্জ্জন, ঔদ্ধত্য পরিহারপূৰ্ব্বক কামনাসিদ্ধি, অদীনভাবে[নির্ভীকভাবে] প্রিয়বাক্য প্রয়োগ, আত্মশ্লাঘাবিহীন হইয়া বীরত্ব প্রকাশ, সৎপাত্র দেখিয়া দান ও অনৃশংস হইয়া অহঙ্কার প্রকাশ করিবেন। অসৎলোকের সহিত সন্ধিস্থাপন, বন্ধুবান্ধবের সহিত সংগ্রাম, অননুরক্ত ব্যক্তিকে চরকার্য্যে নিয়োগ, লোকপীড়নদ্বারা স্বকার্য্যসাধন, অসদ্ব্যক্তির নিকট কার্য্যপ্রকাশ, আত্মসুখে আপনার গুণকীৰ্ত্তন, সাধুলোকের নিকট হইতে অর্থগ্রহণ, অসদ্ব্যক্তির সহায়তা অবলম্বন, সবিশেষ পরীক্ষা না করিয়া দণ্ডবিধান, মন্ত্রণা-প্রকাশ, লোভাকৃষ্ট ব্যক্তিকে অর্থদান, অনিষ্টকারীর প্রতি বিশ্বাস, নিরন্তর স্ত্রীসম্ভোগ এবং অহিতকর সামগ্রীসমুদয় ভোজন করা ভূপতির কদাপি বিধেয় নহে। ঘৃণা ও ঈর্ষা পরিত্যাগপূৰ্ব্বক পবিত্র হওয়া তাঁহার নিতান্ত আবশ্যক। তিনি সতত আপনার স্ত্রীর রক্ষণাবেক্ষণ, অকপটচিত্তে গুরুজনের সেবা, অহঙ্কার পরিত্যাগপূৰ্ব্বক মার্নাহ[মাননীয়] ব্যক্তির সম্মানরক্ষা, দেবগণের অর্চ্চনা ও ন্যায়ানুসারে সম্পত্তিলাভের কামনা করিবেন। অকালে দক্ষতাপ্রকাশ, লোককে সান্ত্বনা বা অনুগ্রহ করিয়া পরিত্যাগ, অজ্ঞ ব্যক্তিকে প্রহার, শত্রু বিনাশ করিয়া অনুতাপ, অকস্মাৎ ক্রোধপ্রকাশ এবং অপকারী ব্যক্তির প্রতি মৃদুভাব অবলম্বন করা তাঁহার কদাপি বিধেয় নহে।
“হে ধৰ্ম্মরাজ! যদি তোমার ইহলোকে মঙ্গললাভ করিতে বাসনা থাকে, তাহা হইলে স্বীয় রাজ্যে অবস্থানপূর্ব্বক ঐরূপ আচরণ কর। উহার অন্যথাচরণ করিলে ভূপতিকে নিশ্চয়ই ঘোরতর ভয়ে অভিভূত হইতে হয়। আমি তোমার সমক্ষে যে সকল গুণের কথা কীৰ্ত্তন করিলাম, যদি কেহ ঐ সমুদয়ের অনুবৰ্ত্তী হইয়া অবস্থান করিতে পারে, তাহা হইলে তাহার উভয় লোকেই যারপরনাই সুখসম্ভোগ ও মহীয়সী কীৰ্ত্তিলাভ হয়, সন্দেহ নাই।”