গ্রিস থেকে যখন কেউ কায়রো আসবেন বিমানে, সকালে আসবেন না। দুপুরেও না। রাত্রে আসার তো কোনওই মানে হয় না। বিকেলে আসবেন, যখনও ঠিক সন্ধে হয়নি, অথচ রোদ্দুরের তেজ মরে গেছে। আলো তখনও আছে, কিন্তু তাপ নেই।
আথেনসের বিমান বন্দরটা ছোট। এপাশে সমুদ্র, ওপাশে পাহাড়ের সারি, মাঝখানের সমতল উপত্যকায় ছোট্ট বাড়ি। আকাশে মেঘ নেই, গ্রিসের আকাশে কদাচিৎ মেঘ থাকে।
প্রতীক্ষাগৃহ থেকে হয়তো কিছুটা হেঁটে গিয়ে আপনাকে প্লেনে উঠতে হবে। অথবা প্লেন। আসতে যদি দেরি হয়, কিছুটা হয়তো অপেক্ষা করতে হবে এয়ারপোর্ট। আপনার ভালোই লাগবে, নাকে আসবে সমুদ্রের লবণ হাওয়া, আপনার বুকের মধ্যে একটু-একটু দ্রিমদ্রিম শব্দ হবে।
না, আমি এয়ারপোর্টের বর্ণনা লিখতে বসিনি। একটি আলৌকিক ঘটনা বর্ণনা করতে চলেছি।
গ্রিস ভ্রমণের চেয়ে, গ্রিস ছেড়ে যাওয়ার মুহূর্তটিও কম আকর্ষণীয় নয়। প্লেন আসার পর আপনি গিয়ে প্লেনে উঠলেন। সিট বেল্ট বাঁধলেন কোমরে, কানে তালা লাগানো শব্দ, হাওয়ার জাহাজ হাওয়ায় উঠল।
তখনও আপনার বিশেষ কিছু মনে হবে না। প্লেনে চড়ার অভিজ্ঞতা আপনার তো নতুন নয়, বরং বিরক্ত হয়ে উঠেছেন, এখন যে-কোনওদিন প্লেনে উঠেই কত তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছনো যায়, সেই জন্যই আপনার ব্যস্ততা থাকে। এবার প্লেন যখন শূন্যে উঠে সমান হয়েছে, উড়ে চলেছে সমুদ্রের ওপর দিয়ে, আপনি কোমর থেকে সিট বেল্ট খুলে সিগারেট ধরিয়েছেন, ছেড়ে আসা গ্রিসের জন্য সামান্য বুক টনটন করছে। সেই স্বপ্নের গ্রিস, দেখা হয়ে গেল, এখন বিদায়। হয়তো আপনার ইচ্ছে হবে–যদি ভাগ্যবশত জানালার ধারের সিট পান–জানলা দিয়ে একবার শেষবার গ্রিসের দিকে তাকাতে। শেষবার অ্যাক্রোপলিসের দিকে দেখে নিতে। আপনি পিছন ফিরে তাকাবেন, আর সঙ্গে-সঙ্গে চমকে উঠবেন বিষমভাবে।
ও কী! পিছনের আকাশটা দাউ দাউ করে জ্বলছে শেষ গোধূলিতে। যেন ভয়ংকর আগুন লেগে গেছে গ্রিসে–আপনি আসার ঠিক পরেই কি একরকম অগ্নিকাণ্ড হল? বিষম বিস্ময়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর একটু একটু করে আপনার মনে পড়বে–ওই আগুন ইউরোপের আগুন। পিছন দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে অপনি সামনের দিকে তাকাবেন। সামনের আকাশ নিকষ কালো। বিষম অন্ধকার ওই মিশরের দিকে। মিশর নয়, সমস্ত প্রাচ্যে অন্ধকার। সূর্য প্রাচ্যদেশে আগে ওঠে, আগেই অস্ত যায়। তাই সামনের দিকে দেখবেন সন্ধ্যা নেমে গেছে, পিছনের দিকে তবুও শেষ সূর্যের আগুন।
তৎক্ষণাৎ আপনার মনে পড়বে আপনি পাশ্চাত্য দেশ ছেড়ে এসেছেন, এই মাত্র, আপনি প্রাচ্যে প্রবেশ করছেন। আমি ধরেই নিয়েছি, আপনি প্রাচ্যদেশের লোক, ভারতবর্ষের হয়তো কোনও বাঙালি যুবা। আপনি নিজের দেশে ফিরছেন। আপনি এখন ভূমধ্যসাগরের ওপরে আছেন, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সন্ধিস্থলে, আপনার গা ছমছম করবে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাসের একটি চরিত্র নদীয়া আর যশোর জেলার সীমান্তে একটি গাছতলায় দাঁড়িয়ে অভিভূত হয়ে গিয়েছিল! এখানে দুটো জেলা এসে মিলেছে, দুই চরিত্র! আর আপনি এখন আছেন দুই পৃথিবীর মাঝখানে–প্রাচী ও প্রতীচীর মধ্যে আপনি ত্রিশঙ্কু। সামনে অন্ধকার পিছনে আগুন। একদিন সভ্যতা জেগে উঠেছিল প্রাচ্যে, এখন অন্ধকারে ঘুমিয়ে আছে। আর পিছনে, পাশ্চাত্যে সভ্যতা এখন জ্বলছে দাউদাউ করে, হয়তো শিগগিরই পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।
এই উপলব্ধি মাত্রই এক ধরনের অলৌকিক অনুভব হবে আপনার। হঠাৎ আপনার গলা থেকে টাই খুলে ফেলতে ইচ্ছে হবে। মুখ ও নাক দিয়ে যুগপৎ একটা বড় নিশ্বাস ফেলা মাত্র আপনার মুখের চেহারা বদলে যাবে। ইউরোপ বা আমেরিকা–পশ্চিমের যে-কোনও দেশে থাকার সময় আপনার মুখটা অন্যরকম হয়ে যায়–হাসি অন্যরকম, গলার স্বর অন্যরকম, হাঁটা অন্যরকম, চাহনি অন্যরকম। চেষ্টা করে ভুরু টান করে রাখতে হয় নচেৎ অনিচ্ছায় বারবার ভুরু কুঁচকে আসে। জুতোর ডগায় ধুলো লাগলে অস্বস্তি হয়, প্যান্টের ক্রিজ ঠিক না থাকলে বিরক্তি আসে, বারবার নিজের গলার কাছে হাত চলে যায়–টাইয়ের গিট ঠিক আছে কি না দেখার জন্য। হাঁচি পেলে হাঁচা যায় না, সর্দি লুকোতে হয় রুমালে, খাওয়ার পর ঢেকুর তোলা তো রীতিমতো পাপ। চা খাওয়ার সময় ভয় হয়–পাছে সপসপ শব্দ না হয়ে যায়। আর তালিকা বাড়িয়ে লাভ নেই–আসলে আপনি পুবের লোক–পশ্চিমে গিয়ে অন্যরকম। পশ্চিমে সাহেব সুবোর পাশে দাঁড়ানো আপনার ছবি দেখে আপনার বাড়িতে সকলে বলেছে, ওম, কত বদলে গেছে! আসলে আপনি বদলাননি, যা বদলেছে তা আপনার অভিব্যক্তি, সাময়িকভাবে বদলেছে মুখের রেখা।
যেই মাত্র আপনি অনুভব করলেন, আপনি পশ্চিম ছেড়ে এসেছেন, অমনি–না, আপনার কাঁধ থেকে ভূত নেমে গেল–এ কথা বলব না, অনেকের শেষ পর্যন্ত নামে না–আপনার সেই কৃত্রিম মুখের রেখা মিলিয়ে যাবে, আপনার উদ্ভাসিত মুখ সেই আপনার পুরোনো নিজস্ব মুখ। আপনার বোধ হবে আপনি নিজভূমিতে ফিরে এলেন–মিশর আপনার দেশ নয়, কিন্তু সেই একই মাটি–যে মাটির সঙ্গে আপনার দেশ যুক্ত। একা একা বসেও আপনার মুখের নিঃশব্দ হাসিটি মনে হবে বাংলা ভাষায় হাসি। আপনার মনে হবে হঠাৎ আপনার শরীর খুব হালকা হয়ে গেছে।
আমার মনে হয়েছিল।