দুর্জ্জয় শরীর বীর চলে অন্তরীক্ষে।
লঙ্কার ভিতরে থাকি দশানন দেখে।।
বিস্মিত হৈয়া রাবণ ভাবিল মনেতে।
ঘরপোড়া বেটা কোথা যায় এত রাতে।।
দশানন বুঝিল করিয়া অনুমান।
ঔষধ আনিতে যায় বীর হনুমান।।
বিশল্যকরণী আছে গন্ধমাদনেতে।
কোনমতে নাহি দিব লক্ষ্মণে বাঁচাতে।।
এতেক ভাবিয়া তবে রাজা দশানন।
কালনেমী-নিশাচরে ডাকে ততক্ষণ।।
রাবণ বলে শুন হে মাতুল কালনেমী।
লঙ্কাতে আমার বড় হিতকারী তুমি।।
চিরদিন করি আমি ভরসা তোমার।
আজি মামা তুমি কিছু কর উপকার।।
আজি রণে লক্ষ্মণ পড়েছে শক্তিশেলে।
মরিবে তপস্বী বেটা রাত্রি পোহাইলে।।
বিশল্যাকরণী আছে গন্ধমাদনেতে।
ঘরপোড়া গেল সেই ঔষধ আনিতে।।
গিয়া গন্ধমাদনেতে করহ উপায়।
যেমতে বানর বেটা ঔষধ না পায়।।
বুদ্ধে বৃহস্পতি তুমি, বৃদ্ধ নিশাচর।
রাক্ষসের মধ্যে তুমি মায়ার সাগর।।
মায়ার প্রবন্ধে এস হনুমানে মেরে।
লঙ্কার অর্দ্ধেক রাজ্য দিব যে তোমারে।।
কালনেমী বলে মনে করি বড় ভয়।
দুষ্ট বড় যে বানরা কি জানি কি হয়।।
মায়ারূপে যাই যদি চিনে হনুমান।
একই আছাড়ে মোর বধিবে পরাণ।।
বানর প্রধান বেটা, বুদ্ধে বড় শঠ।
কেমনে যাইতে বল তাহার নিকট।।
দশানন বলে, এত ভয় কেন তারে।
যুক্তি করে যাও যাতে চিনিতে না পারে।।
কালনেমী বলে, বাপু যত বল মিছে।
কোন যুক্তি না খাটিবে ঘরপোড়ার কাছে।।
রাবণ বলে কালনেমী না হও চিন্তিত।
যেন যুক্তি আছে বেটা মরিবে নিশ্চিত।।
গন্ধমাদনের সব সন্ধি আমি জানি।
গন্ধকারী নামে এক আছে কুম্ভীরিণী।।
সরোবরে পড়ে থাকে গন্ধমাদনেতে।
প্রকাণ্ড শরীর তার মুখ বিপরীতে।।
সুরাসুর শঙ্কা করে দেখে কুম্ভীরিণী।
সেই ডরে কেহ নাহি ছোঁয় তার পানি।।
কেহ নাহি যায় সরোবরের নিকটে।
লক্ষ লক্ষ প্রাণী বধ হৈল তার পেটে।।
সহজে বানর জাতি বীর হনুমান।
গন্ধমাদনের এত না জানে সন্ধান।।
উহার আগে যাহ তুমি তপস্বীর বেশে।
আদর গৌরব করি তুষিবে হরিষে।।
মায়াতে আশ্রম করি রেখ ফুল ফল।
কলসী ভরিয়া রেখ সুবাসিত জল।।
নানা মতে হনুমানে করিবে আদর।
স্নান হেতু পাঠাইবে সেই সরোবর।।
অল্পবুদ্ধি হনুমান পশু মধ্যে গণি।
সরোবরে গেলে ধরে খাবে কুম্ভীরিণী।।
কুম্ভীরিণী ধরে খাবে পবন-নন্দনে।
হনু মৈলে ঔষধ আনিবে কোন্ জনে।।
রাম তবে মরিবেক লক্ষ্মণের শোকে।
পলাবে সুগ্রীব বেটা পড়িয়া বিপাকে।।
মায়াতে বধিয়া তারে এস মম আগে।
লঙ্কাপুরী লব দোঁহে অর্দ্ধ অর্দ্ধ ভাগে।।
কালনেমী বলে, একি বলিস রাবণ।
ঘরপোড়ার কাছে গেলে হারাব জীবন।।
পূর্ব্বে ঘরপোড়া তোরে মারিল চাপড়।
রথ হৈতে পড়িয়ে করিলি ধড়ফড়।।
সেই দিন আমি হলে যেতাম যমঘর।
ভাগ্যে বেঁচে এসেছিলি লঙ্কার ভিতর।।
হনুমানের কাছে কারো নাহিক নিস্তার।
দেখিলে তখনি আমায় করিবে সংহার।।
প্রাণ হারাইতে পাঠাও হনুমান আগে।
আমি মৈলে লঙ্কা কেবা লবে অর্দ্ধভাগে।।
এত যদি কালনেমী রাবণেরে বলে।
শুনিয়া রাবণ রাজা অগ্নি হেন জ্বলে।।
কালনেমী বলে রাগ সম্বর রাবণ।
তুমি মার, সেই মারুক অবশ্য মরণ।।
কালনেমী-নিশাচর ঘোর দরশন।
অষ্ট বাহু চারি মুণ্ড, অষ্ট যে লোচন।।
চলিল যে কালনেমী রাবণ আদেশে।
গন্ধমাদনেতে গেল তপস্বীর বেশে।।
পবন-গমনে চলে বীর হনুমান।
কালনেমী উপনীত তার আগুয়ান।।
মায়াস্থান সৃজিল মধুর ফুল ফল।
কলসী ভরিয়া রাখে সুবাসিত জল।।
জটাভার শিরেতে বাকল পরিধান।
হাতে করে জপমালা করিতেছে ধ্যান।।
হেনকালে উপনীত পবন-নন্দন।
তপস্বী দেখিয়া করে চরণ বন্দন।।
অন্তে বাড় লাগিয়াছে দীর্ঘ গোঁপ দাড়ি।
হনুমানে দেখিয়া দিলেন জলপিঁড়ি।।
এসেছ অতিথি আজি বড়ই মঙ্গল।
স্নান করি এস, কিছু খাও ফুল ফল।।
হনুমান কহে, গোঁসাই না জান কারণ।
কোন্ সুখে খাব আমি নাহি লয় মন।।
দশরথ নামে রাজা জন্ম সূর্য্যবংশে।
সত্যপালি দুই পুত্র দিলা বনবাসে।।
জ্যেষ্ঠপুত্র রামচন্দ্র অনুজ লক্ষ্মণ।
পালিতে বাপের সত্য এসেছেন বন।।
দোসর লক্ষ্মণ বীর সীতা ত সুন্দরী।
শূন্য ঘর পেয়ে রাবণ সীতা কৈল চুরি।।
বানর-সহায়ে রাম বান্ধিলা সাগর।
কটক সমেত গেলা লঙ্কার ভিতর।।
সীতা লাগি রাম রাবণেতে বাজে রণ।
রাবণের শেলে পড়ে আছেন লক্ষ্মণ।।
ঠাকুর লক্ষ্মণ পড়ে রাবণের শেলে।
প্রাণদান পাবেন ঔষধ লয়ে গেলে।।
ফুল ফল শিরে রাখি ক্ষমহ আপনি।
ঔষধ চিনায়ে দেহ বিশল্যাকরণী।।
তপস্বী বলেন তোর ছাওলিয়া মতি।
ভোকে শোকে কেমনে কুলাবে এ আরতি।।
মম স্থানে অতিথি যদি থাকে উপবাসী।
সব তপ নষ্ট হয় কিসের তপস্বী।।
যার বাড়ী অতিথি আসি করে উপবাস।
সব তপ নষ্ট হয় কিসের তপস্বী।।
যার বাড়ী অতিথি আসি করে উপবাস।
অতিথির উপবাসে হয় সর্ব্বনাশ।।
অতিথি দেখিয়া যেবা না করে আশ্বাস।
সর্ব্বনাশ হয় তার নরকে নিবাস।।
এই দেখ সরোবর তপের প্রসাদে।
উলিয়া করহ স্নান ঘুচুক বিষাদে।।
পান যদি কর ওর একাঞ্জলি পানি।
এক বৎসর ক্ষুধা তৃষ্ণা কিছুই না জানি।।
রাক্ষসের মায়াতে পণ্ডিত জন ভুলে।
স্নান হেতু হনুমান চলিলেন জলে।।
ঝাঁপ দিয়া হনু জলে পড়িল যখনি।
হনুর সে শব্দ পেয়ে ধায় কুম্ভীরিণী।।
কুম্ভীরিণী-শব্দ পেয়ে পলায় যত মাছ।
যোজন শরীর তার জিনি তালগাছ।।
হস্ত পদ নখ যেন চোখ চোখ ছুরি।
শমনের দণ্ড যেন দন্ত সারি সারি।।
জলমধ্যে কুম্ভীরিণী হনু নাহি দেখে।
হাত পা পসারি আসি ধরে হাতে নখে।।
কি কি বলি হনুমানে ধরিলেক তারে।
এক লাফে উঠে বীর পাড়ের উপরে।।
কুম্ভীরিণীকে তুলিলেন পবন-নন্দন।
শরীর তাহার উচ্চ একই যোজন।।
ফেলিলেন কুম্ভীরিণী পর্ব্বত-প্রমাণ।
নখে চিরি হনুমান করে খান খান।।
দেবকন্যা কুম্ভীরিণী উঠিল আকাশে।
আকাশে উঠিয়া হনুমানেরে সম্ভাষে।।
দেবকন্যা ছিনু আমি নামে গন্ধকালী।
দেবতার বাড়ী বাড়ী করি নৃত্য কেলি।।
কুবের-নিবাসে যাই নৃত্যগীত রঙ্গে।
ঠেকিল আমার অঙ্গ দক্ষ-মুনি-অঙ্গে।।
পথে মুনি তপ করে নাম তার দক্ষ।
কোপে মুনি শাপ দিল বড়ই অশক্য।।
না যায় খণ্ডন এই শাপ দিল মুনি।
থাক গন্ধমাদনেতে হয়ে কুম্ভীরিণী।।
লক্ষ লক্ষ প্রাণী মেরে বাড়িবেক পাপ।
হনুমান-হাতে তোর মুক্ত হবে শাপ।।
হইবেন নারায়ণ রাম-অবতার।
তাঁর সেবকের হাতে তোমার নিস্তার।।
চিরজীবী হয়ে থাক সাধ রাম-কাজ।
তোমার প্রসাদে যাই দেবের সমাজ।।
আর এক কথা বলি শুন হনুমান।
ভণ্ড তপস্বীর হাতে হইও সাবধান।।
এত বলি আকাশে চলিল গন্ধকালী।
রূপে আলো করে যেন পড়িছে বিজলী।।
হেথা পথ পানে চাহে তপস্বী সঘনে।
হনুর বিলম্ব দেখি হরষিত মনে।।
মনে মনে তপস্বী করিছে অনুমানে।
খেয়েছে কুম্ভীরিণী ধরিয়া হনুমানে।।
অতঃপর যাই আমি রাবণ-গোচর।
অর্দ্ধ লঙ্কা ভাগ করি লইব সত্বর।।
দড়ি ধরে লব ভাগ উত্তর দক্ষিণে।
পূর্ব্বদিক লব আমি না যাব পশ্চিমে।।
পশ্চিম সাগরে যদি বাঁধ ভেঙ্গে যায়।
পশ্চিম রাবণে দিব ভাগ যত হয়।।
অশ্ব হস্বী সৈন্য রথ ভাণ্ডারের ধন।
সকল অর্দ্ধেক বুঝে লইব এখন।।
রাণীগণ আছে যত স্বর্গ-বিদ্যাধরী।
তার অর্দ্ধ লইব যেন ভাগে মন্দোদরী।।
মন্দোদরী-রূপে জিনে স্বর্গ-বিদ্যাধরী।
তার সহ ক্রীড়া হবে দিবা বিভাবরী।।
স্নান করি হনু গেল তপস্বী গোচর।
হনুমানে দেখিয়া কাঁপিছে নিশাচর।।
হাতে ফুল ফল ধীরে ধীরে নাড়ে।
খাও খাও বলি হনুমান প্রতি এড়ে।।
একদৃষ্টে হনুমান তপস্বী নেহালে।
তপস্বী ভাবিছে হনু কি জানি কি বলে।।
হনুমান বলে তুই ভণ্ড যে তপস্বী।
স্বরূপে তপস্বী হলে অতিথিরে হিংসি।।
রাবণের কার্য্য সাধ তপস্বীর বেশে।
মম হাতে পরে আজি যাবে যম-পাশে।।
তোর ফুল ফল বেটা টেনে ফেল দূর।
মোর ঠাঁঞি আজি বেটার মায়া হবে চূর।।
তপস্বী ভাবিল মায়া হইল বিদিত।
ধরিল রাক্ষস মূর্ত্তি অতি বিপরীত।।
অষ্টবাহু চারিমুণ্ড অষ্টটা লোচন।
হনুমান বলে তোরে বধিব এখন।।
প্রথমে গৌরব দ্বিতীয়েতে গালাগালি।
তৃতীয়েতে ঠেলাঠেলি, পরে চুলাচুলি।।
দুইজনে মল্লযুদ্ধ দুজনে সোসর।
দুইজনে মহাযুদ্ধ পর্ব্বত উপর।।
ক্ষণে নীচে হনুমান ক্ষণেক উপরে।
টলমল করে গিরি দুজনার ভরে।।
লাফ দিয়া হনুমান কালনেমী ধরে।
বুকে হাঁটু দিয়া হনু কালনেমী মারে।।
লেজে জড়াইয়া তাকে ঘুরায় আকাশে।
লঙ্কাতে ফেলিয়া দিল রাবণের পাশে।।
গন্ধমাদন লঙ্কা-পথ আঠারো মাসের।
এতদূরে ফেলে টেনে রাবণ গোচর।।
বসেছে রাবণ রাজা পাত্র মিত্র সনে।
অন্ধকারে কালনেমী পড়ে মধ্যস্থানে।।
কি পড়িল বলে সবে চমকিয়া উঠে।
নেড়েচেড়ে দেখে বলে কালনেমী বটে।।
কালনেমী দেখে রাবণের উড়ে প্রাণ।
সর্ব্ব মায়া কৈল চূর্ণ বীর হনুমান।।