জন্মেজয় জিজ্ঞাসিল, কহ মুনিবর।
চারি ভাই কি করিল বহ অতঃপর।।
স্বর্গেতে রহিয়া কিবা করে ধনঞ্জয়।
কত দিনে ভ্রাতৃসহ সমবেত হয়।।
আমারে বিশেষ করি কহ মুনিরাজ।
শুনিতে উল্লাস বড় হয় হৃদিমাঝ।।
বলেন বৈশম্পায়ন শুন নৃপবর।
কৃষ্ণা সহ কাম্যবনে চারি সহোদর।।
যত দ্বিজবর ধৌম্য লোমশ সংহতি।
ছয় রাত্রি তথা বাস করে ধর্ম্মমতি।।
এক দিন দেখ তথা দৈবের ঘটন।
বহিল উত্তর দিকে মন্দ সমীরণ।।
সুগন্ধি সুন্দর বায়ু অতি সুশীতল।
পদ্মগন্ধে প্রপূরিল সব বনস্থল।।
আমোদে করিল মুগ্ধ সবাকার মন।
পুনঃ পুনঃ প্রশংসা করিল সর্ব্বজন।।
উত্তর মুখেতে সবে করে অনুমান।
যোগের সাধনে যেন যোগীর ধেয়ান।।
কেহ কেহ স্বর্গ হৈতে আসিতেছে গন্ধ।
কেহ কহে পৃথিবীতে কে করে আনন্দ।।
কোন মতে কেহ না জানিল নিরূপণ।
লোমশেরে জিজ্ঞাসেন ধর্ম্মের নন্দন।।
জানহ বৃত্তান্ত যদি কহ মুনিবর।
কোথা হৈতে আসিতেছে গন্ধ মনোহর।।
কোথা ফুটে পুষ্প কার সেই উপবন।
চেষ্টায় পাইব কিম্বা অসাধ্য সাধন।।
মুনি বলে, আছে গন্ধমাদন পর্ব্বতে।
সরোবর আছে, তাহা পুষ্প শতে শতে।।
কুবেরের পুষ্প সেই অতি মনোহর।
রক্ষক আছয়ে লক্ষ যক্ষ অনুচর।।
সুবর্ণের পুষ্প সে গন্ধের অবধি।
চেষ্টায় হইবে প্রাপ্ত বাঞ্ছা কর যদি।।
এতেক বৃত্তান্ত যদি কহিলেন মুনি।
ব্যগ্র হয়ে বৃকোদরে বলে যাজ্ঞসেনী।।
আমা প্রতি প্রীতি যদি তোমার আছয়।
অষ্টোত্তর শত পুষ্প দেহ মহাশয়।।
পূজিব ঈশ্বরপদ করেছি বাসনা।
তোমায় কৃপায় যদিপূরে সে কামনা।।
তোমার অসাধ্য নাহি এ তিন ভুবনে।
মনোযোগ কর তুমি মোর নিবেদনে।।
কৃষ্ণারে আকুল দেখি বীর বৃকোদর।
অনুমতি লইলেন ধর্ম্মের গোচর।।
বন্দনা করিল যত ব্রাহ্মণ-মণ্ডলী।
ধর্ম্মের প্রণাম করে করি কৃতাঞ্জলি।।
যুধিষ্ঠির বলেন, সে দেবের আলয়।
কাহার সহিত যেন বিরোধ না হয়।।
যাহ শীঘ্র ত্বরা করি এস ভ্রাতৃবর।
শুনিয়া উত্তরে যান বীর বৃকোদর।।
দেখিল সুন্দর বন ছায়া সুশীতল।
দিব্য সরোবর তথা সুবাসিত জল।।
মধুর সুস্বাদু ফল, নানাবিধ ফুল।
মকরন্দ লোভে উড়ি ভ্রমর আকুল।।
কোন স্থান শোভিত গুবাক নারিকেলে।
পলাশ রসাল তাল পূর্ণ বনফলে।।
বিবধি কুসুমে দেখে বিচিত্র উদ্যান।
দেবের আশ্রম হেন করে অনুমান।।
কোকিলের কলবর বিনা নাহি আর।
মধুপানে মত্ত করে ভ্রমর ঝঙ্কার।।
সর্ব্বদা বসন্তঋতু নিবসে সে বনে।
বিহর যে বৃকোদর আনন্দিত মনে।।
পাসরে পুষ্পের কথা দেখি দিব্য বন।
দুই পাশে ভাঙ্গিল অনেক তরুগণ।।
বৃক্ষাঘাতে মারিলেক মৃগ রাশি রাশি।
প্রমাদ গণিল যত কানন নিবাসী।।
বারণে বারণ মারে মৃগেন্দ্রে মৃগেন্দ্র।
হরিণে হরিণ মারে সবে নিরানন্দ।।
সিংহনাদ ছাড়ি করে হুহুঙ্কার ধ্বনি।
গগণে গরজে যেন ঘোর কাদিম্বিনী।।
মহাশব্দে প্রপূরিল সব বনস্থল।
প্রাণভয়ে পশুপক্ষী পলায় সকল।।
ক্ষুদ্র মৃগ বরাহ ব্যাঘ্রাদি বনচরে।
পলায় মহিষ ব্যাঘ্র গজেন্দ্রের ডরে।।
গজেন্দ্র পলায় দূরে মৃগেন্দ্রেয় ভয়।
মৃগেন্দ্র পলায় বনে মানিয়া সংশয়।।
একেরে অন্যের ভয়, যত মৃগ পশু।
বিকল হইয়া ধায় যুবা বৃদ্ধ শিশু।।
পবন নন্দন ভীম মহাপরাক্রম।
বিহার করেন তথা নাহি মনোভ্রম।।
হেনমতে কতদিন পরম কৌতুকে।
স্বচ্ছন্দ গমনে বীর ভ্রমে মনসুখে।।
চলিতে উত্তর পথে পবন নন্দন।
কত দূরে দেখে বীর কদলীর বন।।
পরম সুন্দর বন দূরেতে আছয়।
যেমন মেঘের ঘটা গগনে উদয়।।
দেখি আনন্দিত হৈল ভীম মহাবল।
ত্বরান্বিত হয়ে বীর আইল সে স্থল।।
নানাপুষ্পে অলিকুল পিয়ে মকরন্দ।
শীতল সৌরভে অতি বাড়িল আনন্দ।।
প্রবেশিয়া দেখে বনে সুপক্ক কদলী।
করিল উদর পূর্ণ ভীম মহাবলী।।
পদাঘাতে ভাঙ্গে যত কদলীর বন।
মড়মড় শব্দেতে চমকে সর্ব্ব জন।।
মারিল যতেক পশু, নাহি তার অন্ত।
সেই বনে আছিল দুরন্ত হনূমন্ত।।
ভাঙ্গিল কদলী বন করি অনুমান।
ক্রোধভরে শীঘ্রগতি হৈল আগুয়ান।।
কুবুদ্ধি পাইল আজি কোন দেবতায়।
আপনারে না জানিয়া আমারে ঘাঁটায়।।
এতেক বলিয়া বীর যাইতে সত্বরে।
আসিতেছে বৃকোদর দেখে কত দূরে।।
দেখিয়া জানিল এই মম ভ্রাতৃবর।
নতুবা এমন দর্প করে কোন নর।।
জানি ছদ্ম করিল পবন অঙ্গজনু।
হইলা অশক্ত জীর্ণ অতি ক্ষীণ তনু।।
ব্যাধিতে পীড়িত অঙ্গ, অস্থিমাত্র সার।
পড়িল পথেতে গিয়া ভীম আগুসার।।
দুদিকে কণ্টক বন নাহি পরিমাণ।
মধ্য পথ যুড়ি রহে বীর হনূমান।।
হেনকালে উপনীত ভীম মহাবল।
দেখে পড়িয়াছে পথে বানর দুর্ব্বল।।
ভীম বলে, পথ ছাড়ি দেহ রে বানর।
আবশ্যক কার্য্য আছে, যাইব সত্বর।।
এতেক শুনিয়া বীর ভীমের বচন।
মায়া করি অতি কষ্টে মেলিল নয়ন।।
ধীরে ধীরে কহে তবে বিনয় আচরি।
জিজ্ঞাসা করয়ে অতি করিয়া চাতুরী।।
কে তুমি, কোথায় যাবে, কহ মহাবল।
জরাযুক্ত অঙ্গ মোর ব্যথায় বিকল।।
নড়িতে নাহিক শক্তি, অবশ শরীর।
লঙ্ঘিয়া গমন কর সুখে মহাবীর।।
এতেক শুনিয়া ভীম চিন্তে মনে মন।
সকল শরীরে আত্মরূপী নারায়ণ।।
ইহারে লঙ্ঘিয়া আমি যাইব কেমনে।
এতেক বিচারি তবে কহে হনূমানে।।
ধার্ম্মিক বানর তুমি, বৃদ্ধ পুরাতন।
অনীতি করিতে যুক্তি দেহ কি কারণ।।
শুনি যে শাস্ত্রেতে হেন আছে বিবরণ।
যত্র জীব তত্র শিবরূপে নারায়ণ।।
দেখিয়া শুনিয়া কেন করিব দুর্ণীতি।
লঙ্ঘিয়া যাইতে বল, নাহ ধর্ম্মে মতি।।
হনূমান বলে, আমি জাতিতে বানর।
ধর্ম্মাধর্ম্ম জ্ঞান কোথা পশুর গোচর।।
ব্যথায় কাতর অঙ্গ, দেখ মহাশয়।
কহিলাম বাক্যমাত্র, মনে যাহা লয়।।
তুমি ধর্ম্মবান বড়, হও সত্যবাদী।
পরম সুজন অতি দয়াগুণনিধি।।
অভিপ্রায়ে বুঝিলাম বড় বংশে জন্ম।
পথ ছাড়াইয়া রাখ, বাড়িবেক ধর্ম্ম।।
তবে ভীম হেলা করি নিজ বাম হাতে।
ধরিয়া তুলিতে যায়, নারিল নাড়িতে।।
বিস্ময় মানিয়া তবে বীর বৃকোদর।
শক্ত করি ধরিলেন দিয়া দুই কর।।
যতেক আছিল শক্তি, কৈল প্রাণপণ।
মহাশ্রমে নাড়িবারে নারে কদাচন।।
বহিল অঙ্গেতে ঘাম হইল ফাঁফর।
বিনয় পূর্ব্বক কহে যুড়ি দুই কর।।
কে তুমি দেবতা যক্ষ গন্ধর্ব্ব কিন্নর।
রাক্ষস মানুষ কিংবা নাগের ঈশ্বর।।
জানিলাম মোর দর্প নাশিতে বিশেষে।
ছলিতে আইলে বৃদ্ধ বানরের বেশে।।
অজ্ঞানের অপরাধ ক্ষম মহাশয়।
অবধানে শুন এবে মম পরিচয়।।
চন্দ্রবংশে জন্ম, রাজা পাণ্ডু মহামতি।
তাঁর ক্ষেত্রে জন্ম মোর পবন সন্তুতি।।
ভীমসেন নাম মম, জান মহাশয়।
মম জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির, ধর্ম্মের তনয়।।
রাজ্য ধন নিয়া শত্রু পাঠাইল বনে।
তপস্বীর বেশে ভ্রমি ভাই পঞ্চ জনে।।
কহিলাম নিজ কথা তোমার অগ্রেতে।
সম্প্রতি যাইব গন্ধমাদন পর্ব্বতে।।
আনিব সুবর্ণ পদ্ম ঈশ্বরের হেতু।
আমারে পাঠাইলেন ভাই ধর্মসেতু।।
যে কিছু বৃত্তান্ত কহিলাম মহাশয়।
কৃপা করি দেহ মোরে নিজ পরিচয়।।
এতেক কহিল যদি ভীম মহামতি।
প্রসন্ন হইয়া তবে কহেন মারুতি।।
জিজ্ঞাসিলেন, শুন তবে মম বিবরণ।
কেশরীর ক্ষেত্রে জন্ম পবন নন্দন।।
রামকার্য্য হেতু মোরে সৃজিলা বিধাতা।
হনূমান নাম মোর রাখিলেন পিতা।।
রাবণ রামের সীতা হরিল যখন।
প্রাণপণে সাধিলাম রাম প্রয়োজন।।
সাগর লঙ্ঘিয়া কৈনু সীতার উদ্দেশ।
তবে রাম করিলেন সৈন্য সমাবেশ।।
সমুদ্রে বান্ধিয়া সেতু সৈন্য হৈল পার।
হইল রাবণ রাজা সবংশে সংহার।।
সীতা উদ্ধারিয়া রাম যান নিজ বাস।
আমারে করিয়া কৃপা করিলেন দাস।।
তুষ্টা হয়ে সীতা দেবী মোরে দিল বর।
এই হেতু চারি যুগ হইনু অমর।।
এই কদলীর বন মোরে দিল দান।
রামের সেবক আমি নাম হনূমান।।
এতেক শুনিয়া তবে ভীম মহাবল।
সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে পড়ি ভূমিতল।।
ভীম বলে, অপরাধ ক্ষমহ গোঁসাই।
যুধিষ্ঠির তুল্য তুমি, মম জ্যেষ্ঠ ভাই।।
হনূমান বলে ভাই কেন হেন কহ।
প্রানের সমান তুমি কভু দোষী নহ।।
পূর্ব্বে দেখিয়াছি আমি, জেনেছি কারণ।
করিলাম এত ছল জানিবারে মন।।
ভীমসেন বলে, যদি কৃপা হলো মোরে।
এক নিবেদন করি তোমার গোচরে।।
নিজমূর্ত্তি মহাশয় করিয়া প্রকাশ।
পূরাও আমার যে মনের অভিলাষ।।
শুনিয়া হাসিল তবে হনূমান বীর।
দেখিতে দেখিতে হৈল পূর্ব্বের শরীর।।
অতি তপ্ত স্বর্ণ জিনি কিবা অঙ্গশোভা।
বালসূর্য্য সম যেন চমৎকার প্রভা।।
মনের আবেশে বাড়ে বীর হনূমন্ত।
কি দিব উপমা যেন পর্ব্বত জ্বলন্ত।।
চক্ষু বুজি ভীমসেন ডাকে পরিত্রাহি।
নিম্পন্দ হইল অঙ্গ, আর নাহি চাহি।।
মুর্চ্ছাগত হয়ে ভীম পড়ে ভূমিতলে।
তথাপিহ মহাবীর বাড়ে কুতূহলে।।
ঊর্দ্ধে লক্ষ যোজন হইল পদ নখ।
ব্রহ্মাণ্ড উপরে গিয়া ঠেকিল মস্তক।।
বিশেষে দেখিয়া দুঃখী বীর বৃকোদর।
পূর্ব্বমত দেহ পুনঃ ধরে মায়াধর।।
আশ্বাসিয়া বৃকোদরে করে সচেতন।
মৃত দেহে সঞ্চারিল যেমন জীবন।।
বৃকোদর কহে, দাণ্ডাইয়া যোড়করে।
বিস্তর বিনয় করে বানর ঈশ্বরে।।
ভাগ্যেতে দেখিনু তোমা পূর্ব্বপুণ্যফলে।
মনের বাসনা পূর্ণ হৈল এত কালে।।
তোমার চরণে মম এই নিবেদন।
আমার পরম শত্রু আছে দুর্য্যোধন।।
বনবাস অবসান্তে যদি যুদ্ধ হয়।
সেই কালে সাহায্য করিবে মহাশয়।।
হাসিয়া বলিল তবে পবন সন্তান।
কাল দেশ পাত্র বুঝি করিব বিধান।।
যখন যাহার সঙ্গে করিবে বিবাদ।
তোমার সম্মুখে বীর হবে সিংহনাদ।।
অর্জ্জুনের কপিধ্বজে হয়ে অধিষ্ঠান।
দুই স্থানে নিজশক্তি করিব বিধান।।
দুই শব্দে যেমন একত্র বজ্রাঘাত।
শুনিয়া অনেক সৈন্য হইবে নিপাত।।
যাহ গন্ধমাদনেতে পুষ্প আছে যথা।
কার সঙ্গে দ্বন্দ্ব নাহি করিহ সর্ব্বথা।।
কুবেরের পুষ্প সেই রাখয়ে রক্ষক।
সাধিবে আপন কার্য বিনয় পূর্ব্বক।।
সবার বন্দিত দেব বেদে হেন কয়।
অনাদর করিলে যে পাপবৃদ্ধি হয়।।
এতেক কহিয়া বীর মধুর বচন।
বিদায় করিল ভীমে দিয়া আলিঙ্গন।।
কতদূরে আগুসরি পথ দেখাইল।
ভূমিতে পড়িয়া ভীম প্রণাম করিল।।
পরম কৌতুকে তবে বৃকোদর বীর।
চলিল উত্তর মুখে নির্ভয় শরীর।।
ভারত পঙ্কজ রবি মহামুনি ব্যাস।
পাঁচালি প্রবন্ধে রচিলেন তাঁর দাস।।