৬৯তম অধ্যায়
কৃষ্ণপ্ৰসাদলাভার্থী ধৃতরাষ্ট্রের কৃষ্ণমাহাত্ম্যশ্রবণ
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! তুমি পুনরায় আমার নিকট কৃষ্ণের কথা কীর্ত্তন কর, তাঁহার নাম ও কর্মের প্রকৃত অর্থ অবগত হইয়া সেই পুরুষোত্তমকে প্রাপ্ত হইব।”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! মহাত্মা বাসুদেব অপ্রমেয়, তথাপি আমি তাঁহার মহিমার বিষয় যাহা অবগত আছি, তৎসমুদয় কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। তিনি সর্ব্বভূতের বাসস্থান ও দেবযোনিসম্ভব বলিয়া তাঁহার নাম বাসুদেব[স্থূলার্থ-বাসুদেবের পুত্র]; তিনি বৃহৎ [ব্যাপক] বলিয়া বিষ্ণুনামে বিখ্যাত হইয়াছেন; মা শব্দের অর্থ বুদ্ধিবৃত্তি তিনি মৌন, ধ্যান ও যোগদ্বারা আত্মার উপাধিভুত সেই বুদ্ধিবৃত্তি দূরীকৃত করিয়াছেন বলিয়া তাহার নাম মাধব [মা (লক্ষ্মী), তাহার ধব (পতি)] এবং সর্ব্বতত্ত্বের যথার্থ জ্ঞানলাভ ও মধুদৈত্যকে বিনাশ করিয়াছেন বলিয়া মধুসূদন-নামে প্রথিত হইয়াছেন। হে মহারাজ! কৃষি শব্দের অর্থ সত্তা ও ন-শব্দের অর্থ আনন্দ; মহাত্মা মধুসূদন সৎ ও আনন্দস্বরূপ বলিয়া কৃষ্ণ [কৃষ ধাতুর অর্থ আকর্ষণ, তিনি ভক্তগণের মন আকর্ষণ করেন বলিয়া কৃষ্ণ]-নামে বিখ্যাত হইয়াছেন। পুণ্ডরীকশব্দের অর্থ পরমস্থান ও অক্ষশব্দের অর্থ অব্যয়, বাসুদেব পরম স্থানে বাস করেন ও তাহার ক্ষয় নাই বলিয়া তাহার নাম পুণ্ডরীকাক্ষ [স্থূলার্থ-কমলনয়ন] হইয়াছে। তিনি দাস্যুগণকে বিত্ৰাসিত করেন বলিয়া জনাৰ্দন-নামে বিখ্যাত হইয়াছেন। ঐ সত্যশালী পুরুষ কদাপি সত্ত্ব হইতে পরিচ্যুত হন না বলিয়া তাঁহার নাম সাত্ত্বত। বৃষভ শব্দের অর্থ বেদ ও ঈক্ষণ শব্দের অর্থ জ্ঞাপক, বেদ তাঁহার জ্ঞাপক বলিয়া তাঁহার নাম বৃষভেক্ষণ। তিনি কাহারও গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন নাই বলিয়া তাঁহার নাম অজ। তিনি সাতিশয় দন্ত ও ইন্দ্ৰিয়গণের মধ্যে স্বপ্রকাশ বলিয়া তাহার নাম দামোদর [অথবা-দাম রজ্জু তদ্বারা উদরে বন্ধন প্রাপ্ত, অথবা-শিশুকালের চাঞ্চল্যে যশোদা তাঁহার উদর ও কোটির মধ্যস্থলে কোমরে দড়ি দিয়া বাঁধিয়া রাখিতেন, কৃষ্ণ বন্ধনরজ্জু খুলিয়া উদরসাৎ করিয়াছিলেন।]। তিনি অতিশয় হৃষ্ট, সুখী ও ঐশ্বৰ্য্যবান বলিয়া হৃর্ষীকেশ [অথবা- হৃষীকবিষয়েন্দ্ৰিয়-রূপ, শব্দ, গন্ধ, রস, স্পর্শ এই সকল বিষয়ের ইন্দ্ৰিয় যথাক্রমে চক্ষু কৰ্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক এই পঞ্চ ইন্দ্ৰিয়ের ঈশ কর্ত্তা এই সকল যাহার অধীন—এই সকল ইন্দ্ৰিয়ের যিনি অধীন নহেন।] নাম ধারণ করিয়াছিলেন। তিনি বাহুদ্বয়দ্বারা রোদসী [অন্তরীক্ষ] ধারণ করিয়াছিলেন বলিয়া মহাবাহু নামে বিখ্যাত হইয়াছেন ও অধঃপ্রদেশে তাঁহার ক্ষয় নাই বলিয়া তাহার নাম অধোক্ষজ [অথবা অতীন্দ্ৰিয়-ইন্দ্ৰিয়ের অবিষয়ীভূত]। তিনি নরগণের আশ্রয় বলিয়া তাহার নাম নারায়ণ [জলের একটি নাম নার, সেই নার অয়ন (আশ্রয়) যাঁহার অনন্তশয্যায় সাগরশায়ী]। তিনি সর্ব্বভূতের পুরাণকর্ত্তা ও সর্ব্বভূত তাঁহাতেই অবসন্ন হয় বলিয়া তাহার নাম পুরুষোত্তম [স্থূলাৰ্থ-পুরুষশ্রেষ্ঠ]। তিনি সমুদয় কাৰ্য্যকারণের মূলীভূত ও সর্ব্বজ্ঞ বলিয়া তাঁহার নাম সর্ব্ব এবং তিনি সত্যে ও সত্য তাঁহাতে প্রতিষ্ঠিত আছে, এই নিমিত্ত তাহার নাম সত্য। তিনি চরণদ্বারা আকাশ আক্রমণ করিয়াছিলেন বলিয়া বিষ্ণু, জয়শীল বলিয়া জিষ্ণু, নিত্য বলিয়া অনন্ত ও ইন্দ্ৰিয়গণকে প্রকাশ করিয়াছিলেন বলিয়া গোবিন্দ [বৃন্দাবনের গোপালক; অথবা সংযত ইন্দ্ৰিয়গণদ্বারা লভ্য]-নামে বিখ্যাত হইয়াছেন। সেই মহাপুরুষ অসত্যকে সত্য ও প্ৰজাগণকে মোহিত করেন। হে মহারাজ! আমি আপনার আদেশক্ৰমে সেই ধর্ম্মনিত্য ভগবান মধুসূদনের স্বরূপ কীর্ত্তন করিলাম। সেই মহাত্মা কুরুগণের প্রতি কৃপা করিয়া সন্ধিসংস্থাপনের নিমিত্ত আগমন করিবেন।”