যট্ষষ্টিতম অধ্যায়
রুদ্রাদি সৃষ্টিবিস্তার
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! পূর্ব্বে আপনাকে কহিয়াছি যে, মরীচি প্রভৃতি অতিবীর্য্যবান্ ছয়জন ব্রহ্মর্ষি ব্রহ্মার মানস-পুৎত্র। মৃগব্যাধ, সর্প, নির্ঋতি, অজৈকপাদ্, অহি, বুধ্ন্য, পিনাকী, দহন, কপালী, স্থাণু ও ভর্গ স্থাণুর এই একাদশ পুৎত্র; ইঁহাদিগকেই একাদশ রুদ্র কহে। অঙ্গিরার তিন পুৎত্র;— বৃহস্পতি, উতথ্য ও সংবর্ত্ত; ইঁহারা সর্ব্বলোকবিখ্যাত। হে নরনাথ! শ্রুত আছে, অত্রির অনেক পুৎত্র; তাঁহারা সকলেই বেদজ্ঞ, সিদ্ধ ও শমগুণাবলম্বী মহর্ষি। হে নরশ্রেষ্ঠ! রাক্ষস, বানর, কিন্নর ও যক্ষগণ ধীমান্ পুলস্ত্যের পুৎত্র। শলভ, সিংহ, কিংপুরুষ, ব্যাঘ্র ও ঈহামৃগগণ পুলহ হইতে সমুৎপন্ন হয়। ক্রতুর পুৎত্রগণ স্বীয় পিতার সদৃশ প্রতাপশালী, সূর্য্যসহচারী, ত্রিভুবনবিশ্রুত ও সত্যনিষ্ঠ ছিলেন। হে ধরানাথ! শান্তিগুণাবলম্বী, তপঃপরায়ণ, ভগবান্ দক্ষ-ঋষি ব্রহ্মার দক্ষিণ অঙ্গুষ্ঠ হইতে ও তাঁহার পত্নী প্রজাপতির বামাঙ্গুষ্ঠ হইতে উৎপন্ন হয়েন। মহর্ষি দক্ষ ঐ ভার্য্যার গর্ভে পঞ্চাশৎ কন্যা উৎপাদন করেন। মহর্ষির পুৎত্র জন্মে নাই, এই নিমিত্ত তিনি ঐ সকল সর্ব্বাঙ্গসুন্দরী কন্যাগণকে পুৎত্রিকা করিয়াছিলেন। হে রাজন! মহর্ষি দক্ষ ঐ পঞ্চাশটি কন্যার মধ্যে ধর্ম্মকে দশটি, কশ্যপকে ত্রয়োদশটি ও চন্দ্রকে সাতাইশটি বেদ-বিধানানুসারে সম্প্রদান করেন। ধর্ম্ম, চন্দ্র ও কশ্যপের ধর্ম্মপত্নীদিগের নাম কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। কীর্ত্তি, লক্ষ্মী, ধৃতি, মেধা, পুষ্টি, শ্রদ্ধা, ক্রিয়া, বুদ্ধি, লজ্জা ও মতি এই দশটি ধর্ম্মের পত্নী। লোকবিশ্রুতা সময়বোধিকা নক্ষত্ররূপিণী অশ্বিনী, ভরণী প্রভৃতি সাতাইশটি চন্দ্রের ভার্য্যা। সর্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মার পুৎত্র মনু। মনুর পুৎত্র প্রজাপতি। ধর, ধ্রুব, সোম, অহঃ, অনিল, অনল, প্রত্যুষ ও প্রভাস এই অষ্টবসু প্রজাপতি হইতে সমুৎপন্ন হয়েন। ইঁহাদিগের মধ্যে ধর ও ব্রহ্মবিৎ ধ্রুব ধূম্রার গর্ভে জন্মেন; সোম মনস্বিনীর গর্ভে, অহঃ রতার গর্ভে অনিল শ্বাসার গর্ভে অনল শাণ্ডিল্যার গর্ভে এবং প্রত্যূষ ও প্রভাস প্রভাতার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। ধরের দুই পুৎত্র;—দ্রবিণ ও হুতহব্যবহ। সংহারকর্ত্তা ভগবান্ কাল ধ্রুবের পুৎত্র। সোমের পুৎত্র বর্চ্চাঃ, যদ্দ্বারা লোক বর্চ্চস্বী হয়। শিশির, প্রাণ ও রমণ ইঁহারা মনোহরার পুৎত্র। জ্যোতিঃ, শম, শান্ত ও মুনি ইঁহারা অহের ঔরসে জন্মেন। শরবনবাসী শ্রীমান্ কুমার অগ্নির পুৎত্র। শাখ, বিশাখ ও নৈগমেয় এই তিনজন কার্ত্তিকেয়ের অনুজ। কুমার কৃত্তিকা কর্ত্তৃক পালিত হইয়াছিলেন বলিয়া কার্ত্তিকেয় নামে বিখ্যাত হইয়াছেন। অনিলের ভার্য্যা শিবা, তাঁহার গর্ভে মনোজব ও অবিজ্ঞাতগতি নামে অনিলের দুই পুৎত্র জন্মে। দেবল ঋষি প্রত্যুষের পুৎত্র। দেবলের দুই পুৎত্র, তাঁহারা সাতিশয় ক্ষমাবান্ ও বিদ্বান ছিলেন। বৃহস্পতির ভগিনী ব্রহ্মবাদিনী যোগাসক্তা বরস্ত্রী সমস্ত পৃথিবী পরিভ্রমণ করেন। ইঁহার গর্ভে অষ্টম বসু প্রভাসের ঔরসে শিল্পপ্রজাপতি দেবসূত্রধর বিশ্বকর্ম্মা জন্মগ্রহণ করেন। ইনি সর্ব্বশিল্পকরের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। দেবতাদিগের সমুদয় অলঙ্কার ও বিমানাদি বিশ্বকর্ম্মা নির্ম্মাণ করেন। ইঁহার শিল্পকার্য্য উপজীব্য করিয়া মনুষ্যেরা জীবিকা নির্ব্বাহ করে এবং শিল্পোপজীবী লোকেরা সেই অক্ষয় বিশ্বকর্ম্মাকে পূজা করিয়া থাকে।
সর্ব্বলোক-সুখাবহ ভগবান্ ও ধর্ম্ম নরকলেবর ধারণপুরঃসর ব্রহ্মার দক্ষিণস্তন ভেদ করিয়া বিনির্গত হয়েন। ধর্ম্মের তিন পুৎত্র;—শম, কাম ও হর্ষ। শমের পত্নী প্রাপ্তি, কামের স্ত্রী রতি ও হর্ষের ভার্য্যা নন্দা; ইঁহাদিগকে অবলম্বন করিয়া লোকযাত্রা নির্ব্বাহ হইতেছে। ঘোটকী-রূপধারিণী ত্বাষ্ট্রী সবিতার স্ত্রী। ইনি অন্তরীক্ষে অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে প্রসব করেন। হে রাজন্! মরীচির পুৎত্র কশ্যপ হইতে সুরাসুরগণ জন্মেন। অতএব ভগবান্ কশ্যপ হইতেই সমস্ত লোকের উৎপত্তি হইয়াছে বলিতে হইবে।
অদিতির গর্ভে ইন্দ্রাদি দ্বাদশ পুৎত্র জন্মেন; সর্ব্বজগৎ পালনকর্ত্তা ভগবান্ বিষ্ণু তাঁহাদিগের সর্ব্বকনিষ্ঠ। রুদ্র, সাধ্য, মরুৎ, বসু, ভার্গব ও বিশ্বদেব এই নবতি দেবতার নাম কার্ত্তীত হইল। এক্ষণে ইঁহাদের বংশাবলী পক্ষ ও গণ কীর্ত্তন করিতেছি। বিনতানন্দন গরুড় ও বলবান্ অরুণ এবং বৃহস্পতি ইঁহারা আদিত্যমধ্যে পরিগণিত। অশ্বিনীকুমারদ্বয়, গুহ্যকগণ, যাবতীয় ওষধি ও সমস্ত পশুগণ দেবতামধ্যে পরিগণিত। লোকে আনুপূর্ব্বিক ইঁহাদের নাম কীর্ত্তন করিলে সর্ব্বপাপ হইতে বিমুক্ত হয়। ভগবান্ ভৃগু ব্রহ্মার হৃদয়দেশ ভেদ করিয়া বিনির্গত হয়েন। ভৃগুর পুৎত্র শুক্র, ইনি পরম প্রাজ্ঞ ও কবিশ্রেষ্ঠ। যিনি ত্রৈলোক্যের প্রাণযাত্রার্থে বর্ষাবর্ষ [বর্ষলক্ষণ—অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টি] ও ভয়াভয় বিষয়ে ভগবান্ স্বয়ম্ভূ কর্ত্তৃক নিযুক্ত হইয়া ত্রিভুবন ভ্রমণ করিতেছেন, সেই অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন যোগাচার্য্য শুক্রাচার্য্য দৈত্যগণের গুরু। তিনি যোগক্ষেম [সাংসারিক মঙ্গল —সংসারযাত্রানির্ব্বাহ] সম্পাদনার্থে বিধাতা কর্ত্তৃক নিযুক্ত হইলে ভগবান্ ভৃগু চ্যবন্ নামে আর এক পুৎত্র উৎপাদন করেন। তিনি স্বীয় জননীর দুঃখ মোচনের নিমিত্ত ক্রোধভরে গর্ভ হইতে বহির্গত হয়েন। মনুর কন্যা আরুষী বিচক্ষণ চ্যবনের ভার্য্যা। আরুষীর উরুদেশ ভেদ করিয়া ঔর্ব্ব নামে এক পুৎত্র নির্গত হয়েন। ইনি বাল্যকালেই সাতিশয় তেজঃশালী, মহাবলপরাক্রান্ত ও নানা গুণযুক্ত হইয়াছিলেন। ঔর্ব্বেরপুৎত্র ঋচীকের পুৎত্র জমদগ্নি। মহাত্মা জমদগ্নির চারি পুল। রাম [পরশুরাম] তাঁহাদের সর্ব্বকনিষ্ঠ; কিন্তু সর্ব্বাপেক্ষা গুণজ্যেষ্ঠ সর্ব্বশাস্ত্রবিশারদ ও ক্ষৎত্রিয়কুলান্তক। ঔর্ব্বপুৎত্র ঋচীকের জমদগ্নি প্রভৃতি একশত পুৎত্র। সেই শত পুৎত্রের সহস্র সহস্র পুৎত্রগণ পৃথিবীতে ব্যাপ্ত হইয়াছেন এবং তাঁহার ধাতা ও বিধাতা নামে অপর দুই পুৎত্র আছেন; পদ্মালয়া লক্ষ্মী তাঁহাদের ভগিনী। আকাশগামী তুরঙ্গমগণ লক্ষ্মীর মানস-পুৎত্র। বরুণের জ্যেষ্ঠা ভার্য্যা শুক্রাদেবী, তাঁহার গর্ভে বল নামে পুৎত্র ও সুরানাম্নী কন্যা জন্মে। অন্নার্থী প্রজাগণের পরস্পর ভক্ষণ হইতে সর্ব্বভূত নাশনকারী অধর্ম্মের জন্ম হয়। অধর্ম্মের ভার্য্যা নির্ঋতি; নির্ঋতির গর্ভে রাক্ষসগণের জন্ম হয়, এই নিমিত্ত উহারা নৈর্ঋত নামে বিখ্যাত। অধর্ম্মের নিরন্তর পাপকারী তিন পুৎত্র;—ভয়,মহাভয় ও ভূতান্তক মৃত্যু।