৬৬তম অধ্যায়
ভীষ্মের কৃষ্ণভক্তি
মহারাজ! অনন্তর ত্রিলোকপতি ভগবান্ বিষ্ণু স্নিগ্ধ গম্ভীর স্বরে ব্রহ্মাকে কহিলেন, হে তাত! আমি যোগবলে তোমার অভিলাষিত সকল বিষয়ই অবগত হইয়াছি; তোমার মনোরথ পূর্ণ হইবে; এই বলিয়া তিনি তথায় অন্তর্হিত হইলেন।
অনন্তর দেবর্ষি ও গন্ধর্ব্বগণ সাতিশয় বিষ্ময়াবিষ্ট ও একান্ত কৌতুহলপরতন্ত্র হইয়া পিতামহ ব্রহ্মাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ভগবন্! আমি যাঁহাকে বিনীতভাবে নমস্কার করিয়া উৎকৃষ্ট বাক্য স্তব করিলেনম উনি কে? আমরা উহা শ্রবণ করিতে নিতান্ত অভিলাষী হইয়াছি।
তভন ভগবান্ ব্রহ্মা মধুর বাক্যে তাঁহাদিগকে কহিলেন, হে দেবর্ষি গন্ধর্ব্বগণ! যিনি ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্ত্তমান; যিনি সকলের পর, যিনি প্রভু, ব্রহ্ম ও পরমপদ; তিনি প্রসন্ন হিইয়া আমার সহিত সম্ভাষণ করিতেছিলেন; আমি জগতের হিতার্থ তাঁহাকে প্রার্থনা করিয়া কহিলাম, হে বিশ্বেশ! তুমি বাসুদেব নামে বিখ্যাত হইয়া মনুষ্যযোনিতে জন্মগ্রহণ কর এবং অসুর সংহার করিবার নিমিত্ত অবনীতলে অবতীর্ণ হও। যে সমস্ত ঘোররূপ মহাবল পরাক্রান্ত দৈত্য, দানব ও রাক্ষস সমরক্ষেত্রে নিহত হইয়াছিল, তাহারাই মিনুষ্যযোনিতে উৎপন্ন হইয়াছে। তুমি তাহাদিগকে বধ করিবার নিমিত্ত নরের সহিত মানব বিগ্রহ পরিগ্রহ করিয়া ভূতলে সঞ্চরণ করিবে।
অমরগণও পুরাতন ঋষি নর নারায়ণকে পরাজিত করিতে সমর্থ হন না; তাঁহারা এক
ত্র হইয়া নরলোকে জন্ম গ্রহণ করিয়াছেন; কিন্তু মূঢ় লোকেরা তাঁহাদিগকে অবগত নয়। আমি তাঁহারই আত্মজ ও জগতের পতি। সেই সর্ব্বলোকেশ্বর বাসুদেব তোমাদিগের অনুমেয়; তোমরা শঙ্খ চক্র গদাধর বাসুদেবকে মনুষ্য বলিয়া কদাচ অবজ্ঞা করিও না। আমি পরম গুহ্য, পরম পদ, পরম ব্রহ্ম ও পরম যশঃ। তিনি অক্ষয়, অব্যক্ত ও শ্বাশ্বত; লোকে তাঁহাকে পুরুষ বলিয়া কীর্ত্তন করিয়া থাকে কিন্তু কেহ জ্ঞাত নয়। বিশ্বকর্ম্মা ইঁহাকে পরম তেজঃ পরম সুখ ও পরম সত্য বলিয়া কীর্ত্তন করিয়া থাকেন; অতএব কি ইন্দ্রাদি দেবতা কি অসুরগণ তাহারই বাসুদেবকে মনুষ্য বলিয়া অবজ্ঞা করা কর্ত্তব্য হয়। যে ব্যক্তি অবজ্ঞা করিয়া হৃষীকেশকে
মনুষ্য বলে, সেই মূঢ়মতি পুরুষাধম। যে ব্যক্তি সেই পরম কারণ পরমাত্মাকে, মনুষ্যকলেবর পরিগ্রহ করিয়াছেন বলিয়া অবজ্ঞা করে, মানবগণ তাহাকে তামস পুরুষ বলিয়া থাকে এবং যে ব্যক্তি সেই স্থাবরজঙ্গমাত্মক শ্রীবৎসলাঞ্ছিত বাসুদেবকে বিদিত নয়, লোকে তাহাকেও তামষ পুরুষ বলিয়া থাকে। সিই কিরীটকৌস্তুভধারী মি
ত্রগণের অভয়প্রদ মাহাত্মা বাসুদেবকে অবজ্ঞা করিলে ঘোর অন্ধকারে নিমগ্ন হইতে হয়। সকল লোকই এই রূপ তত্ত্বার্থ অবগত হইয়া সকল লোকের ঈশ্বরের ঈশ্বর কৃষ্ণকে নমস্কার করিবে।
ভগবান্ কোমলযোনি দেবর্ষিদিগকে এই রূপ কহিয়া সকলকে পরিত্যাগপূর্ব্বক স্বভবনে গমন করিলেন। দেবতা, গন্ধর্ব্ব, মহর্ষি ও অপ্সরাসকল ব্রহ্মার মুখে এই কথা শ্রবণ করিয়া প্রীত মনে সুরলোকে প্রতিনিবৃত্ত হইলেন।
মহর্ষিগণ সমবেত হইয়া এই রূপে বাসুদেবের গুণমান করিতেছিলেন; আমি তাঁহাদিগেরই মুখে এঁই সমস্ত শ্রবণ করিয়াছি এবং জামদগ্ন্য, মার্কণ্ডেয়, ব্যাস এবং নারদও আমাকে এইরূপ কহিয়াছেন। সকল জগতের পিতা ব্রহ্মা তাঁহার আত্মজ সিই ত্রিলোকীনাথ অব্যয় বাসুদেবের গুণগ্রাম অবগত হইয়া এবং তাঁহার বিষয় সমস্ত শ্রবণ করিয়া কোন্ ব্যক্তি তাঁহাকে সৎকার না করিবে। হে বৎস! মাহাত্মা মহর্ষিগণ তোমাকে ধন্বী বাসুদেব ও পাণ্ডবগণের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইও না বলিয়া বারংবার নিবারণ করিয়াছেন; কিন্তু তুমি মোহপরতন্ত্র হইয়া উহা অনুধাবন করিতেছ না; এক্ষণে তোমাকে ক্রূর রাক্ষস বলিয়া বোধ হইতেছে। তুমি অজ্ঞানান্ধকারে একান্তই সমাচ্ছন্ন হইয়া আছ বলিযা বাসুদেব ও অর্জ্জনের প্রতি বিদ্বেষ প্রকাশ করিতেছ। দেখ, কোন মনুষ্য নর ও নারায়ণের দ্বেষী হইতে সমর্থ হয়। তিনি নিত্য, অব্যয়, সর্ব্বলোকময়, শাস্তা, বিধাতা, লোকপাল ও নিশ্চল। সেই চরাচর পুরুষ হরি এই ত্রিলোক ধারণ করিতেছেন; তিনি যোদ্ধা, জয়, জেতা, প্রকৃতি ও ঈশ্বর। তিনি যোদ্ধা, জয়, জেতা, প্রকৃতি ও ঈশ্বর। তিনি সত্ত্ব, রজঃ ও তমোগুণ বিবর্জ্জিত; অতএব যে স্থানে কৃষ্ণ সেই স্থানেই ধর্ম্ম; যে স্থানে ধর্ম্ম, সেই স্থানেই জয়। তাঁহার মাহাত্ম্য ও আত্মযোগ দ্বারা পাণ্ডবেরা রক্ষিত হইতেছেন; সুতরাং তাঁহাদিগেরই জয় লাভ হইবে, তাহার সন্দেহ নাই। যিনি পাণ্ডবগণকে সৎ পরামর্শ ও সাহায্য প্রদান করেন, তিনি সতত নির্ভয়ে কালযাপন করিয়া থাকেন। হে মহারাজ! তুমি যাঁহার কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছ, সেই শাশ্বত সর্ব্বভূতময় দেবতাই বাসুদেবনামে প্রখ্যাত হইয়াছেন। স্ব স্ব লক্ষণোপেত ব্ৰাহ্মণ, ক্ষত্ৰিয়, বৈশ্য ও শূদ্রেরা প্রতিনিয়ত অনুষ্ঠিত স্বস্ব কর্ম্মদ্বারা তাঁহারই সেবা ও সৎকার করিয়া থাকেন। ভগবান বলদেব দ্বাপরের অন্তে ও কলিযুগের আদিতে সাত্বতবিধি [ভক্তিমাৰ্গ] অবলম্বনপূর্ব্বক যাঁহাকে গান করিয়াছিলেন, সেই বিশ্বস্রষ্টা প্রতিযুগে সমস্ত সুরলোক, সত্যলোক, সমুদ্রগর্ভস্থিত পুরী এবং মুনষ্যের আবাসস্থান বারংবার সৃষ্টি করিতেছেন।”