৬৬তম অধ্যায়
প্রজাপালনে রাজার চতুরাশ্রম পালনফল
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে পিতামহ। আপনি অগ্রে চারি আশ্রমের বিষয় সংক্ষেপে নির্দেশ করিয়াছেন, এক্ষণে তৎসমুদয় সবিস্তর কীৰ্ত্তন করুন।” ভীষ্ম কহিলেন, ‘বৎস! তুমি আমার ন্যায় সাধুসম্মত ধৰ্ম্মসমুদয় অবগত হইয়াছ, এক্ষণে রাজা যেরূপ আচারনিষ্ঠ হইলে যে আশ্রমের ফললাভে অধিকারী হয়েন, তাহা শ্রবণ কর। অন্যান্য মনুষ্যেরা চারি-আশ্ৰম আশ্রয় করিয়া বিধিবিহিত ধৰ্ম্মানুষ্ঠানপূর্ব্বক যেসমস্ত ফললাভ করে, রাজা ধর্ম্মপরায়ণ হইয়া সেই সমস্ত ফললাভে সমর্থ হয়েন। যে মহীপাল স্বেচ্ছাচারশীল, বিদ্বেষবুদ্ধিহীন ও সৰ্ব্বভূতে সমদৃষ্টিসম্পন্ন হইয়া উপযুক্ত ব্যক্তিদিগকে ভোজ্যদ্রব্যের অংশপ্রদান ও পূজনীয় ব্যক্তির অর্চ্চনা করেন, তিনি ব্রহ্মচর্য্যাশ্রমের ফললাভে অধিকারী হয়েন। যিনি জ্ঞানী, ত্যাগশীল, নিগ্রহানুগ্রহপরায়ণ[পালন-শাসনপটু], সদাচারসম্পন্ন ও ধীরপ্রকৃতি, তিনি গৃহস্থাশ্রমের ফললাভে অধিকারী হয়েন। যিনি জ্ঞাতি, সম্বন্ধী ও মিত্রগণকে বিপদ হইতে উদ্ধার করেন, তিনি বানপ্রস্থাশ্রমের ফললাভে অধিকারী হয়েন। যিনি প্রধান প্রধান লোক ও সন্ন্যাসী প্রভৃতি ধাৰ্ম্মিকদিগকে বারংবার সকার, আহ্নিককাৰ্য্য[প্রতিদিন কর্ত্তব্য সন্ধ্যাবন্দনাদি], দেবযজ্ঞ, পিতৃযজ্ঞ, ভূতযজ্ঞ ও মানুষজ্ঞের অনুষ্ঠান, ধনদ্বারা অতিথির সৎকারসাধন এবং লোকরক্ষার্থ বনৌষধি আহরণ করেন, তাঁহার আরণ্যক আশ্রমের ফললাভ হয়। যে রাজা স্বরাষ্ট্রপ্রতিপালন, সমস্ত প্রাণীর রক্ষাবিধান ও বিবিধ যজ্ঞানুষ্ঠান করেন, তাঁহার সত্যাশ্রমের ফললাভ হয়। যিনি ধৰ্ম্মানুসারে আহ্নিক, জপ ও দেবগণের অর্চ্চনা করেন, তাঁহার ধর্ম্মাশ্রমের ফললাভ হয়।
“যে রাজা ব্রাহ্মণরক্ষণনিরপেক্ষ হইয়া সতত বেদাধ্যয়ন, ক্ষমাবলম্বন, আচার্য্যের অর্চ্চনা ও সকলের সহিত সরল ব্যবহার করেন, তাঁহার ব্রহ্মশ্রমের ফললাভ হয়। যিনি বানপ্রস্থ ত্রিবেদী ব্রাহ্মণগণকে প্রার্থনাধিক অর্থদান করেন, তাঁহার আরণ্যক আশ্রমের ফললাভ হয়। যিনি সকলের প্রতি দয়া প্রকাশ এবং অনৃশংস ব্যবহার করেন, তাঁহার সকল পুণ্যের ফললাভ হয়। যে রাজা শত্ৰুকর্ত্তৃক আক্রান্ত ও শরণাগত ব্যক্তিকে আশ্রয়প্রদান, স্থাবরজঙ্গমাত্মক ভূতসমুদয়ের রক্ষণাবেক্ষণ ও উপযুক্ত ব্যক্তিকে যথোচিত উপচারে অর্চ্চনা করেন, তাঁহার গৃহস্থাশ্রমের ফললাভ হয়। জ্যেষ্ঠ ও মধ্যম ভ্রাতার পত্নী, ভ্রাতা, পুত্র ও নপ্তৃগণের[পৌত্রদিগের] প্রতি নিগ্রহ ও অনুগ্রহ-প্রদর্শনই গৃহস্থধৰ্ম্ম ও উৎকৃষ্ট তপস্যা। যে রাজা সচ্চরিত্র অর্চ্চনীয় ব্যক্তিদিগের প্রতিপালন ও আপনার আলয়ে আশ্রমস্থ ব্যক্তিদিগকে ভোজ্য প্রদান করেন, তাঁহার গৃহস্থাশ্রমের ফললাভ হয়। যে রাজা বিধাতুনির্দিষ্ট ধর্ম্মে যথার্থতঃ অবস্থান করেন, তিনি সমগ্র আশ্রমের ফললাভ করিয়া থাকেন। যিনি গুণগ্রামবিহীন না হয়েন, তাঁহাকেই যথার্থ আশ্রমী বলিয়া নির্দেশ করা যায়। যিনি সম্যকরূপে স্থান, কুল ও বয়সের সম্মান রক্ষা করিতে পারেন, তিনি সমস্ত আশ্রমবাসের যথার্থ উপযুক্ত। রাজা দেশধৰ্ম্ম ও কুলধর্ম্ম প্রতিপালন করিলে সর্ব্বাশ্রমের ফলভাগী হয়েন। যিনি সাধু ব্যক্তিদিগকে যথাকালে ঐশ্বৰ্য্য ও উপহারপ্রদান এবং দয়াধর্ম্মপরায়ণ হইয়া সকল লোকের ধৰ্ম্মরক্ষা করেন, তিনিই আশ্রমবাসের সম্যক উপযুক্ত। প্রজারা সুপ্রণালীক্রমে প্রতিপালিত হইয়া যে ধর্ম্মোপার্জ্জন করে, রাজা তাহার অংশভাগী হয়েন; আর তাহারা সুশৃঙ্খল প্রতিপালিত না হইয়া যে অধৰ্ম্মসঞ্চয় করে, তাহাতেও রাজাকে লিপ্ত হইতে হয়। যেসকল লোক ভূপতির সহায়, তাহারাও প্রজাবর্গের ধর্ম্মাধর্ম্মের অংশগ্রহণ করে। পণ্ডিতেরা সকল ধর্ম্ম অপেক্ষা গার্হস্থ্যধৰ্ম্ম অতি পবিত্র বলিয়া অঙ্গীকার করিয়া থাকেন। আমরা সেই ধৰ্ম্মেরই সেবা করি। যে রাজা সকল প্রাণীকে আপনার ন্যায় জ্ঞান এবং ক্রোধ পরিত্যাগপুৰ্ব্বক ন্যায়ানুসারে দণ্ডবিধান করেন, তিনি ইহলোকে ও পরলোকে সুখী হয়েন। রাজধৰ্ম্মরূপ নৌকা ও ত্যাগরূপ বায়ু সত্ত্বরূপ কর্ণধারদ্বারা চালিত এবং ধর্ম্মশাস্ত্ররূপ রঞ্জুদ্বারা সংযত হইয়া ধার্ম্মিক রাজাকে উদ্ধার করে। যখন রাজা সমস্ত বিষয়বাসনাশূন্য হয়েন, তখন তিনি বুদ্ধিমাত্র অবলম্বনপূর্ব্বক ব্রহ্মলাভ করিতে পারেন।
“হে ধৰ্ম্মরাজ! তুমি সুপ্রসন্নমনে লোভাদি বিসর্জ্জনপুৰ্ব্বক প্রজাপালনে নিরত হও, তাহা হইলেই ধর্ম্মোপার্জ্জনে সমর্থ হইবে। এক্ষণে বেদাধ্যয়নরত সদাচারপরায়ণ ব্রাহ্মণগণ ও অন্যান্য লোকের প্রতিপালনে প্রবৃত্ত হওয়াই তোমার উচিত। লোকে বানপ্রস্থ প্রভৃতি আশ্ৰম আশ্রয় করিয়া যে ধৰ্ম্ম উপার্জ্জন করে, রাজা প্রজাপালনে নিরত হইলে তাহার শতগুণ ধর্ম্মলাভে সমর্থ হয়েন। হে ধৰ্ম্মরাজ! আমি এই তোমার সমক্ষে বিবিধ ধৰ্ম্ম কীর্ত্তন করিলাম; এক্ষণে তুমি ঐ সমুদয় পূর্ব্বপুরুষপরম্পরাপ্রচলিত নিত্যধৰ্ম্মপ্রতিপালনে প্রবৃত্ত হও। ধর্ম্মানুসারে প্রজাপালনে নিরত হইলেই তোমার চারিবর্ণ ও চারি-আশ্রমের ধর্ম্মলাভ হইবে।”