হিমালয় গিয়া মহাতপ আরম্ভিল।
কঠোর তপেতে সব তপস্বী তাপিল।।
ফলাহার পত্রাহার কৈল বাতাহার।
অনাহারে কৈল তনু অস্থিচর্ম্ম সার।।
দেবমানে তপ কৈল সহস্র বৎসর।
তপে তুস্টা গঙ্গা দিতে আইলেন বর।।
গঙ্গা বলিলেন, রাজা তপ কেন কর।
প্রীত হইলাম আমি, মাগ ইষ্টবর।।
জাহ্নবীর বাক্য শুনি হয়ে হৃষ্টমন।
করযোড় করি মাগে দিলীপ নন্দন।।
কপিলের কোপানলে পুড়ে পিতৃগণ।
তা সবার মুক্তি হেতু করি আরাধন।।
যাবৎ তোমার জলে না হয় সেচন।
তাবৎ সদগতি নাহি পাবে পিতৃগণ।।
তোমার চরণে করি এই নিবেদন।
উদ্ধার কর গো মাতা মম পিতৃগণ।।
যদি কৃপা করিলা গো, মাগি তব পায়।
আপনি তথায় গিয়া উদ্ধার সবায়।।
গঙ্গা বলে, তব প্রীতে যাইব তথায়।
মম বেগ সহে হেন করহ উপায়।।
ঊর্দ্ধ হৈতে মহাবেগে নামিব যখন।
মম বেগ সহে, হেন নাহি অন্য জন।।
বিনা নীলকণ্ঠ কারো শক্তি নাহি লোকে।
তপস্যায় বশ করি আনহ ত্র্যম্বকে।।
এত শুনি ভগীরথ করিল গমন।
কৈলাশ শিখরে শিবে করেন ভজন।।
তপস্যায় তুষ্ট হইলেন দিগম্বর।
গঙ্গা ধরিবারে ভগীরথ মাগে বর।।
নিজ ইষ্ট জানি তুষ্ট হয়ে মহেশ্বর।
প্রীতিতে বলেন, চল যাব নৃপবর।।
হিমালয় পর্ব্বতে কহেন উমাপতি।
আনহ, কোথায় আছে তব হৈমবতী।।
ভববাক্যে ভগীরথ গঙ্গা চিন্তা করে।
ব্রহ্মলোকে গঙ্গা তাহা জানিল অন্তরে।।
আকাশ হইতে গঙ্গা দেখি শৃলপাণি।
পড়িলেন হরশিরে করি ঘোর ধ্বনি।।
মকর কুম্ভীর মীন পূর্ণ মহাজলে।
মুক্তামালা শোভে যেন চন্দ্রচূড় গলে।।
শিব শির হৈতে গঙ্গা হৈলেন ত্রিধারা।
এক ধারা আসিয়া পড়িল বসুন্ধরা।।
স্বর্গেতে যে ধারা, তার মন্দাকিনী খ্যাতি।
মর্ত্ত্যে অলকানন্দা পাতালে ভোগবতী।।
ভগীরথ প্রতি বলিলেন ভাগীরথী।
তোমার কারণে আমি আইলাম ক্ষিতি।।
পিতৃগণ তোমার আছয়ে কোন্ দিগে।
কোন্ পথে যাইব, চলহ মম আগে।।
আজ্ঞামাত্র আগে চলে দিলীপ নন্দন।
কল কল শব্দে গঙ্গা চলিল তখন।।
হিমালয় পর্ব্বতে হইলা উপনীত।
পথ না পাইয়া গঙ্গা হলেন ভাবিত।।
চিন্তিয়া কহেন দেবী দিলীপ নন্দনে।
গিরিবর পথ রুধিয়াছে নির্গমনে।।
শুনি ভগীরথ সুরধুনীর বচন।
বিনয়েতে কহে, মাতা পথ নির্দ্ধারণ।।
গঙ্গা বলেন, কর রাজা ঐরাবতে ধ্যান।
বিদারিয়া গিরি পথ করুক নির্ম্মাণ।।
মম বাক্যে ঐরাবতে করিলেন স্তুতি।
স্তবেতে হইয়া তুষ্ট আসে গজপতি।।
রাজা বলে, মহাশয় নিস্তার এ দায়।
গিরি বিদারিয়া পথ দেহ গঙ্গা মায়।।
শুনি করী দুষ্টমতি বলিল রাজারে।
পথ করি দিতে পারি যদি ভজে মোরে।।
কর্ণে হাত দিয়া রাজা আইল সত্বর।
ছলেতে জানায় সব পশুর উত্তর।।
গঙ্গা বলে, ভগীরথ কহিবে করীরে।
সহে যদি মম বেগ, ভজিব তাহারে।।
দেখিবে দুর্গতি তার, কিবা দশা ঘটে।
শীঘ্রগতি আন তারে ছলিয়া কপটে।।
মাতঙ্গ নিকটে গিয়া বলে ভগীরথ।
শুনি করী শীঘ্রগতি করি দিল পথ।।
গিরি খণ্ড করি দন্তে টানিয়া ফেলিল।
মহাবেগে মহামায়া গমন করিল।।
সম্মুখে পড়িয়া হস্তী ভাসিয়া চলিল।
আছাড়ে বিছাড়ে তার প্রাণমাত্র ছিল।।
স্তব করে, গজবর, ত্রাহি ত্রাহি ডাকে।
বলে মাগো পশু আমি, কি চিনি তোমাকে।।
দয়াময়ী দয়া করি রাখিল জীবন।
প্রাণ লয়ে ঐরাবত পলায় তখন।।
বেগেতে চলিল গঙ্গা আনন্দিত মনে।
উপনীতা হৈল জহ্নুমুনির আশ্রমে।।
দেখিয়া গঙ্গারে মুনি করিলেন পান।
গঙ্গারে না দেখি রাজা হৈল হতজ্ঞান।।
মুনিবরে স্তব করে কাতর অন্তরে।
তুষ্ট হয়ে মুনিবর গঙ্গা দিল পরে।।
কল কল শব্দে হয় গঙ্গার প্রয়াণ।
কত শত লোক তরে নাহি পরিমাণ।।
তাহা দেখি হর্ষান্বিত নৃপ গুণবান।
বেগেতে আইল গঙ্গা কপিলের স্থান।।
যথায় আছিল ভস্ম সগর সন্তান।
পরশে পরম জল বৈকুণ্ঠে প্রয়াণ।।
চতুর্ভূজ হয়ে স্বর্ণরথে আরোহিল।
ঊর্দ্ধবাহু করি সবে আশীর্ব্বাদ কৈল।।
পিতৃগণে মুক্ত দেখি আনন্দ অপার।
প্রণাম করিয়া নাচে দিলীপ কুমার।।
ভগীরথ হইতে সমুদ্রে হৈল জল।
যাহা জিজ্ঞাসিলে রাজা কহিনু সকল।।
শুনিলে পৃথিবীপাল সগরোপাখ্যান।
ভগীরথ তুল্য আর নাহি পুণ্যবান।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীদাস বিরচিল সগর আখ্যান।।