চতুঃষষ্টিতম অধ্যায়
প্রাচীন রাজ্যসংস্থান
জনমেজয় কহিলেন, হে ব্রহ্মণ! যে সমস্ত রাজার নাম কীর্ত্তন করিলেন এবং যাঁহাদিগের নাম অকীর্ত্তিত রহিল, তাঁহাদিগের সমস্ত বৃত্তান্ত শ্রবণ করিতে ইচ্ছা করি। হে মহাভাগ! সেই মহারথ দেবকল্প ভূপালেরা যে নিমিত্ত এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হইয়াছিলেন, তাহার আদ্যোপান্ত সমুদয় বৃত্তান্ত বলুন।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! আপনি যাহা আদেশ করিতেছেন, এই রহস্য দেবতারাও জানেন কি না, সন্দেহ। এক্ষণে স্বয়ম্ভূ ব্রহ্মাকে নমস্কার করিয়া সেই রহস্য আপনার নিকট নিবেদন করিতেছি, অবধান করুন। পূর্ব্বকালে পরশুরাম পৃথিবীকে একবিংশতিবার নিঃক্ষৎত্রিয়া করিয়া মহেন্দ্রপর্ব্বতে আরোহণপূর্ব্বক তপস্যায় মনোনিবেশ করেন। ভগবান্ ভার্গব ক্ষৎত্রিয়কুল ক্ষয় করিলে ক্ষৎত্রিয়রমণীগণ সুতার্থিনী হইয়া ব্রাহ্মণদিগের নিকট গমন করিলেন। ব্রাহ্মণগণ ঋতুকালে সমাগত ক্ষৎত্রিয়কুল-কামিনীগণের অভিলাষ পরিপূর্ণ করিতেন; কিন্তু কামতঃ বা ঋতু কালাতিক্রমে তাঁহাদিগের সহবাস করিতেন না। ক্ষৎত্রিয়াঙ্গনারা এইরূপে ব্রাহ্মণ-সহযোগে গর্ভবতী হইয়া যথাকালে সাতিশয় বীর্য্যবান্ পুৎত্র ও কন্যা-সকল প্রসব করিতে লাগিলেন। তাহাতেই ক্ষৎত্রিয়-বংশ পুনর্ব্বার ক্রমশঃ পরিবর্দ্ধিত হইল এবং ব্রাহ্মণ প্রভৃতি চারি বর্ণ পুনঃসংস্থাপিত হইল। তৎকালে তির্য্যগযোনি প্রভৃতি অন্যান্য প্রাণীগণও ঋতুকাল উপস্থিত হইলেই ভার্য্যা-সম্ভোগ করিত; কামতঃ বা ঋতুকালাতিক্রমে কদাচ স্ত্রীসংসর্গ করিত না। কেবল ঋতুকালে স্ত্রীসম্ভোগ করিলে যে সন্তান জন্মে, তাহারা ধর্ম্মপরায়ণ, নির্ব্ব্যাধি ও নিরাধি [মনঃপীড়াশূন্য] হইয়া দীর্ঘকাল জীবিত থাকে। ক্ষৎত্রিয়েরা পর্ব্বত-বন-সমাকীর্ণা এই সসাগরা পৃথিবীর অধীশ্বর হইয়া ধর্ম্মানুসারে প্রজাপালন করিতে লাগিলেন দেখিয়া ব্রাহ্মণ প্রভৃতি বর্ণচতুষ্টয় সকলে অতিশয় প্রীত হইলেন। তাঁহারা কাম, ক্রোধ প্রভৃতি দুষ্প্রবৃত্তির বশীভূত না হইয়া দোষাশ্রিত ব্যক্তিদিগের প্রতি ধর্ম্মতঃ দণ্ডবিধানে তৎপর হইলেন এবং তাঁহাদিগের ধর্ম্ম পরায়ণতাপ্রযুক্ত দেবরাজ ইন্দ্র যথাকালে বারিবর্ষণ করিয়া প্রজাপালন করিতে লাগিলেন। হে মহারাজ! তৎকালে লোকের অকাল মৃত্যু হইত না বা যৌবনকাল আগত না হইলে কেহ দারপরিগ্রহ করিত না। এইরূপে সসাগরা ধরা দীর্ঘজীবী প্রজাপুঞ্জে পরিপূর্ণ হইল। সেই সময়ে ক্ষৎত্রিয়েরা প্রচুর ধনদানপূর্ব্বক যজ্ঞানুষ্ঠান করিতেন। ব্রাহ্মণগণ বেদ, বেদাঙ্গ, উপনিষৎ প্রভৃতি অধ্যয়ন করিতেন, তাঁহারা কদাচ বেদ বিক্রয় বা শূদ্রসন্নিধানে বেদোচ্চারণ করিতেন না। বৈশ্যেরা বলবান্ বলীবর্দ্দ দ্বারাই কৃষিকর্ম্ম করিত, দুর্ব্বল গো-সকলকে ভারবহন কার্য্যে নিযুক্ত না করিয়া তাহাদিগকে প্রতিপালন করিত। ফেনপায়ী বৎস সত্ত্বে [বৎসের মুখে ফেন থাকা পর্য্যন্ত] কেহ গো দোহন করিত না; বণিকেরা কূট-পরিমাণে [কম ওজনে] দ্রব্য-সামগ্রী বিক্রয় করিত না। সকল লোকেই ধর্ম্মপরায়ণ ও সদাচারতৎপর ছিল। তৎকালে ধর্ম্মের কিছুমাত্র অপচয় হয় নাই। নারীগণ ও ধেনুগণ যথাকালে সন্তান প্রসব করিত। তরুমণ্ডলী যথাসময়ে ফলপুষ্পে পরিপূর্ণ হইত। সত্যযুগে পৃথিবী এইরূপ বহুসংখ্যক লোকে সমাকীর্ণ হয়।
মনুষ্যলোকের অভ্যুদয়কালে রাজাদিগের ক্ষেত্রে অসুরেরা জন্মগ্রহণ করিতে আরম্ভ করিল। অসুরেরা সুরগণ কর্ত্তৃক বহুশঃ ;পরাজিত এবং ঐশ্বর্য্য ও স্বর্গ হইতে দূরীকৃত হইয়া ধরাতল আশ্রয় করিতে লাগিল। তাহারা ভূলোকে দেবতুল্য প্রভাব অভিলাষ করিয়া গো, মৃগ, হস্তী, অশ্ব, গর্দ্দভ, উষ্ট্র, মহিষ, রাক্ষস প্রভৃতি ভূতযোনিতে উৎপন্ন হইতে লাগিল। জাত ও জায়মান অসুরের ভরে ধরামণ্ডল আপনাকে ধারণ করিতে অক্ষম হইল। অনন্তর দনুর ঔরসে দিতির গর্ভে কতকগুলি অসুর জন্মিল। প্রবলপরাক্রান্ত অতি দুর্দ্দান্ত মদোৎসিক্ত দানবেরা এইরূপে সসাগরা পৃথিবাব্যাপিয়া ব্রাহ্মণ, ক্ষল্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এই চারিবর্ণ ও অন্যান্য প্রাণীগণকে নানাপ্রকারে উৎপীড়ন করিতে আরম্ভ করিল। তাহারা দলবদ্ধ হইয়া প্রাণীদিগকে নিহত ও আহত করিয়া আশ্রমবাসী মহর্ষিদিগের উপর বহুবিধ উপদ্রব করিত এবং পৃথিবীর চারিদিকে ভ্রমণ করিয়া সর্ব্বদা লোকের অনিষ্ট-চেষ্টা করিত।
ভূভার হরণের মন্ত্রণা
হে মহারাজ! তৎকালে অনন্তদেবও দৈত্যভারাক্রান্ত সসাগরা সপর্ব্বতা ধরা ধারণ করিতে অসমর্থ হইলেন। পরে বসুমতী নিতান্ত শঙ্কিতা হইয়া সর্ব্বভূত-পিতামহ ব্রহ্মার শরণাগত হইলেন। ধরণী তথায় উপনীত মহানুভব দেব, দ্বিজ ও মহর্ষিগণে পরিবৃত, গন্ধর্ব্ব ও অপ্সরাগণ কর্ত্তৃক সেবিত, অবিনাশী, সৃষ্টিকর্ত্তা ব্রহ্মাকে দেখিলেন এবং তাঁহার সম্মুখীন হইয়া প্রণাম করিলেন। শরণার্থিনী অবনী সমাগত সমস্ত লোকপালদিগের সমক্ষে ব্রহ্মাকে আত্মসংবাদ নিবেদন করিলেন। সর্ব্বান্তর্য্যামী ভগবান্ ব্রহ্মা ইতিপূর্ব্বেই ভূমির অভিপ্রায় অবগত হইয়াছিলেন। বিশ্বনির্ম্মাতা সর্ব্বদা সকল লোকের মনোমন্দিরে জাগরূক আছেন; সুতরাং তাঁহার পৃথিবীর অভিপ্রায় জানা নিতান্ত বিস্ময়কর ব্যাপার নহে। তখন তিনি পৃথিবীকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে বসুন্ধরে! তুমি যে কারণে আমার শরণাপন্ন হইয়াছ, আমি তোমার সেই বিপদ্-নিরাকরণের নিমিত্ত দেবতাদিগকে নিয়োগ করিব।” এইরূপ সান্ত্বনাবাক্যে পৃথিবীকে বিদায় করিয়া ভূতভাবন ভগবান্ ব্রহ্মা দেবগণকে আদেশ করিলেন; “তোমরা ভূমির ভার-হরণ ও অসুরদিগের অনিষ্ট-সাধন করিবার নিমিত্ত অংশক্রমে ভূতলে জন্মগ্রহণ কর” এবং গন্ধর্ব্ব ও অপ্সরাগণকে আহ্বান করিয়া কহিলেন, “তোমরা নরলোকে যাইয়া উদ্ভুত হও।” সুরগুরু ব্রহ্মার এই হিতকর বাক্য শুনিয়া ইন্দ্রাদি দেবগণ তাহাতে সম্মতি প্রদান করিলেন এবং পৃথিবীতে অবতীর্ণ হইতে কৃতনিশ্চয় হইয়া বৈকুণ্ঠে নারায়ণের নিকট উপনীত হইলেন। ইন্দ্র ভগবান্ চক্রপাণিকে ভূভারহরণের নিমিত্ত জিজ্ঞাসা করিলে তিনি তাঁহাদিগকে অংশক্রমে ভূতলে অবতীর্ণ হইতে পরামর্শ দিলেন।
আদিবংশাবতরণিকা সমাপ্ত।