৬৪তম অধ্যায়
উন্মত্তের ন্যায় দময়ন্তীর বনভ্ৰমণ
বৃহদশ্ব কহিলেন, “মহারাজ! নলিননয়না নলকামিনী মৃগজীবনের জীবনাবসান করিয়া একাকিনী ভীষণ কাননে নানাবিধ ভয়ঙ্কর ও আশ্চৰ্য্য ব্যাপার পৰ্য্যবেক্ষণপূর্ব্বক পৰ্যটন করিতে লাগিলেন। কোন স্থান ঝিল্লিকারবে পরিপূর্ণ হইতেছে, কোন স্থানে ভীষণাকার সিংহ, মহিষ, দ্বীপী, রুরু, ব্যাঘ্র, ভলুক ও মৃগগণ বিচরণ করিতেছে; কোন স্থানে বিবিধ বিহঙ্গমকুল কলরব করিয়া ক্রীড়া করিতেছে; কোন স্থানে ম্লেচ্ছ ও তস্করগণ অধিবাস করিতেছে; কোন স্থান শাল, বেণু, শাকট, অশ্বথ, তিন্দুক, ইঙ্গুদ, কিংশুক, অৰ্জ্জুন, অরিষ্ট, চন্দন, শাল্মলী প্রভৃতি পাদপে সমাকীর্ণ কোন স্থান বন্দরী, বিন্ধ, বট, পিয়াল, তাল, খৰ্জ্জুর, হরীতকি ও বিভীতিক তরুতে মণ্ডিত হইয়া রহিয়াছে; কোন স্থানে বিবিধ ধাতুরঞ্জিত অচলশ্রেণী, কোথাও বা সুমধুর ধ্বনিপূর্ণ নিকুঞ্জনিকর,
কোথাও বা অদ্ভুতদৰ্শন দরী-সকল তাঁহার দৃষ্টিগোচর হইতে লাগিল। স্থানে স্থানে নদী, সরোবর, বাপী, তাড়াগ, গিরিশৃঙ্গ ও চিত্রদর্শন নির্ব্বােরসকল শোভমান হইতেছে। কোথাও বা ভীষণমূর্ত্তি পিশাচ, ভূজঙ্গ ও নিশাচরগণ বিচরণ করিতেছে, কোনদিকে মহিষগণ, কোনদিকে বরাহগণ, কোনদিকে ভলুকগণ, কোনদিকে বা বনপন্নগগণ যুথবদ্ধ হইয়া রহিয়াছে। রূপবতী তেজঃসম্পন্না যশস্বিনী নলকামিনী বিয়োগ-দুঃখিত হইয়া এবংবিধ ভীষণ অরণ্যমধ্যেও অকুতোভয়ে প্ৰাণবল্লাভের গবেষণাপূর্ব্বক [অনুসন্ধান] ইতস্ততঃ ভ্ৰমণ করিতে লাগিলেন।
“অনন্তর পতিবিরহানলসন্তপ্তহৃদয়া নলবিলাসিনী শিলাতলে উপবেশন করিয়া করুণস্বরে বিলাপ করিতে লাগিলেন, “হে মহাবাহো নিষধনাথ! আজি আমাকে এই বিজন বিপিনে বিসর্জ্জন করিয়া কোথায় পলায়ন করিলে? তুমি অশ্বমেধাদি ভূরিদক্ষিণ ভুরি ভুরি যজ্ঞে ধার্ম্মিকতার পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করিয়া এক্ষণে আমার ভাগ্যদোষে কি মিথ্যাচারণে প্রবৃত্ত হইলে? হে মহাভাগ! আমার সমক্ষে যাহা কহিয়াছিলে, এক্ষণে তাহা স্মরণ করা উচিত; হংসগণ তোমার ও আমার সমীপে যে-সকল কথা কহিয়াছিল, এক্ষণে তাহার প্রতিও দৃষ্টিপাত করা সর্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য। সম্যক অধীত সাঙ্গোপাঙ্গ বেদচতুষ্টয় একমাত্ৰ সত্যের তুল্য; অতএব হে রাজন! পূর্ব্বে আমাকে যাহা কহিয়াছিলে, তাহার অন্যথাচরণে প্রবৃত্ত হইয়া সত্য হইতে বিচলিত হওয়া উচিত নহে। হা নাথ! তোমার ভাৰ্য্যা এই ভয়ঙ্কর অরণ্যে প্ৰাণ পরিত্যাগ করিতেছে, তুমি কি নিমিত্ত উপেক্ষা করিতেছ? এই দুৰ্দান্ত ক্ষুধার্ত্ত পশুরাজ বদনব্যাদান করিয়া ভক্ষণ করিতে আসিতেছে। এ সময়ে আমাকে পরিত্রাণ করা কি তোমার উচিত নহে? তুমি পূর্ব্বে আমাকে সর্ব্বদা কহিতে যে, ‘তোমা ভিন্ন আর কেহ আমার প্রতিভাজন নহে’, এক্ষণে সেই বাক্যের যথার্থ্যসম্পাদন কর। হা দময়ন্তী-প্ৰাণবল্লভ! তোমার প্ৰিয়তমা প্ৰণয়িনী উন্মাদিনীর ন্যায় রোদন করিতেছে, এ সময়ে সম্ভাষণ না করা কি তোমার উচিত? আমি রসনাৰ্দ্ধ পরিধান করিয়া অনাথা যূথভ্রষ্টা হরিণীর ন্যায় একাকিনী দীনভাবে রোদন করিতেছি, তুমি শীঘ্ৰ উপস্থিত হইয়া মধুরবাক্যে সান্ত্বনা কর। হা জীবিতনাথ! তোমারা ভাৰ্য্যা দময়ন্তী এই ভীষণ অরণ্যে অসহায়া হইয়া কাতরবচনে বারংবার আহ্বান করিতেছে? তুমি কি নিমিত্ত প্ৰতিবচনপ্রদানে পরাঙ্মুখ হইলে? আজি তোমার সেই মোহিনী মূর্ত্তি আমার নয়নপথের বহির্ভূত হইয়াছে। হে শোকবিবৰ্দ্ধন জীবিতেশ্বর! তুমি সিংহব্যাঘ্রসস্কুল ভয়ানক বনে কোন স্থানে শয়ন বা উপবেশন করিয়া আছ অথবা কোন স্থানে প্রস্থান করিয়াছ, কিছুই জানি না এবং এই কথা কাহার নিকটেই বা জিজ্ঞাসা করি? আমি এখন এই বিজন বিপিনে কোন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করিব যে, “তুমি নলরাজকে কি দেখিয়াছ?” কে বা আমাকে তোমার অনুসন্ধান করিয়া দিবে? “হে অবলে! তুমি যে মহাত্মার অন্বেষণ করিতেছ, সেই এই কমলায়তালোচন নল”, আমি এই মধুর বাক্য কাহার বদনে শ্রবণ করিব? এই ভীষণ চতুর্দ্দন্ত মহাহনু [বিস্তৃতবদনপ্রান্ত—মুখের উভয়প্রান্ত ভীষণভাবে বিস্তৃত] কেশরী আমার অভিমুখে আগমন করিতেছে, নিঃশঙ্ক হইয়া ইহার নিকট গমন করি।”
“অনন্তর স্বামিশোক-বিহ্বলা দময়ন্তী সেই সিংহের সম্মুখীন হইয়া কহিলেন, “হে মৃগাধিরাজ! তুমি সমস্ত মৃগের অধিপতি ও এই কাননের প্রভু; আমি বিদর্ভ-রাজতনয়া! নিষধাধিপতি শত্ৰুঘাতী নলরাজের ভাৰ্য্যা; আমার নাম দময়ন্তী, আমি এক্ষণে অপার শোকসাগরে নিমগ্ন হইয়া প্ৰাণবল্লভের অন্বেষণ করিতেছি, যদি সেই নলরাজ তোমার নয়ন-পথের অতিথি হইয়া থাকেন, তাহা হইলে আমাকে আশ্বাসিত করিয়া জীবন প্রদান কর, নতুবা স্বীয় করাল-কবলে কবলিত করিয়াই এই নিদারুণ দুঃখ হইতে বিমুক্ত কর।
‘হায়! এই মৃগরাজ আমার বিলাপ শ্রবণ করিয়াও কিছুমাত্র প্রত্যুত্তর প্রদান করিল না। এক্ষণে ঐ স্বাদুসলিলশালিনী সমুদ্ৰগামিনী তরঙ্গিণীর সমীপে গমন করি অথবা এই পবিত্ৰ গিরিরাজকে নলরাজের বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করি।” এই বলিয়া গিরিরাজকে সম্বোধন করিয়া কহিতে লাগিলেন, “ভগবান! অচলরাজ! দিব্যদর্শন! বিশ্রুত! শরণ্য মহীধর! আপনাকে নমস্কার; আমি রাজনন্দিনী, রাজস্নুষা ও রাজমহিষী, আমার নাম দময়ন্তী; আমি আপনার নিকটে আগমন করিয়া প্ৰণাম করিতেছি। যিনি চতুর্ব্বর্ণের প্রতিপালক ও রাজসূয় প্রভৃতি ভূরি-দক্ষিণ যজ্ঞসকলের আহর্ত্তা; যিনি সকল পার্থিবের শ্রেষ্ঠ, ব্ৰহ্মপরায়ণ, সদৃত্ত, সত্যবাক, অসূয়াশূন্য, শৌৰ্য্যশালী ও ধর্ম্মজ্ঞ; যিনি অরাতিকুল নির্মূল করিয়া বিদর্ভবাসী প্ৰজাগণকে সম্যকরূপে রক্ষা করিতেন, সেই বিদৰ্ভাধিপতি মহারথ শ্ৰীমান ভীমরাজ আমার পিতা, আমি তাঁহার তনয়া হইয়া তোমার উপাসনা করিতেছি। নিষধাধিপতি, গৃহীতনামা, বিপুলকীর্ত্তি বীরসেন আমার শ্বশুর; শ্যামকলেবর, পুণ্যশ্লোক, বেদবিৎ বাগ্মী, বদান্যবর শ্ৰীমান নলরাজ তাঁহার পুত্র; ইনি পরম্পরাগত পৈতৃকরাজ্যের অধীশ্বর হইয়া সম্যকরূপে তাহা শাসন করিয়াছিলেন। এই দুঃখিনী অবলা তাঁহার ভাৰ্য্যা; এক্ষণে কাননে আসিয়া অনাথা হইয়াছি এবং দারুণ দুরবস্থায় পতিত হইয়া তাঁহারই অন্বেষণ করিতেছি। হে ভূধররাজ! আপনি কি উন্নমিত শিখরশতদ্বারা এই দারুণ কাননে সেই গজেন্দ্রবিক্রম, আয়তাবাহু, মহাবীর, মদীয় ভর্ত্তা নিষধাধিপতিকে নিরীক্ষণ করিয়াছেন?”
“হে পর্ব্বতশ্রেষ্ঠ! আমি একাকিনী সাতিশয় কাতর হইয়া স্বীয় নন্দিনীর ন্যায় আপনার সন্নিধানে বিলাপ করিতেছি, আপনি বাক্যদ্বারাও আশ্বাস প্রদান করিলেন না! হায় কি দুর্ভাগ্য!
‘হে ধর্ম্মজ্ঞ সত্যসন্ধ নালরাজ! যদি এই বনে তুমি বসতি করিয়া থাক, আমাকে দর্শন দাও। কবে সেই মহাত্মার অমৃতায়মান স্নিগ্ধগভীর বাণী আমার কর্ণকুহরে সুধাবর্ষণ করিবে? কবে তিনি আমাকে “বৈদভী” বলিয়া স্পস্টাক্ষরে আহ্বান করিবেন? কবেইবা সেই বেদানুসারিণী শোকবিনাশিনী বাণী শ্রবণ করিব? হে ধর্ম্মবৎসল! এই ভয়বিহুলা অবলোকে অভয় প্রদান কর।”
দময়ন্তীর ঋষিতপোবনে প্রবেশ
“দময়ন্তী এবম্প্রপ্রকার শোক ও পরিতাপ করিয়া তথা হইতে পুনরায় উত্তরদিকে গমন করিলেন। তিনি তিন অহোরাত্র গমন করিয়া এক দিব্যাকাননশোভিত তাপসারণ্য সন্দর্শন করিলেন। তথায় বশিষ্ঠ, ভৃগু ও অত্রিসদৃশ দমপরায়ণ শুদ্ধাত্মা তাপসগণ নিয়ত সংযতাহার হইয়া বাস করিতেছেন। কেহ কেহ জলমাত্রাহার, কেহ কেহ বায়ু-ভক্ষণ, কেহ বা পৰ্ণমাত্রোপযোগ [বৃক্ষপত্ৰম ত্ৰভোজী] হইয়া যোগসাধন করিতেছেন। বল্কল ও অজিন তাঁহাদের পরিধেয়; ইন্দ্ৰয়সংযম তাঁহাদের ব্রত; নানাবিধ মৃগ ও শাখামৃগগণ তাহাদের আশ্রমে ইতস্ততঃ সঞ্চারণ করিতেছে।
“রমণীরত্ন মহাভাগা অসহায়া দময়ন্তী এই সকল অবলোকনপূর্ব্বক আশ্বস্তচিত্তে সেই আশ্রমপদে প্রবেশ করিয়া তাপসগণকে অভিবাদনপূর্ব্বক বিনীতভাবে দণ্ডায়মান হইলেন। তাঁহারা তাঁহাকে স্বাগত প্রশ্নানন্তর যথাবিধি পূজা করিয়া উপবেশন করিতে অনুজ্ঞা করিলেন। দময়ন্তী কহিলেন, “হে মহাভাগ তপোধনগণ! আপনাদিগের তপস্যা, অগ্নি, ধর্ম্ম ও মৃগ-পক্ষিগণের কুশল ত?
“তাঁহারা তৎক্ষণাৎ কুশল-প্রশ্নের প্রত্যুত্তর প্রদান করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “অয়ি কল্যাণি! তুমি কে? তোমার অভিলাষ কি? তুমি কি এই অরণ্যের বা মহীধরের অথবা এই স্রোতস্বতীর অধিষ্ঠাত্রী দেবতা? আমরা তোমার অনুপম রূপ ও মনোহরকান্তিসন্দর্শনে সাতিশয় বিস্ময়াবিষ্ট হইয়াছি। তুমি শোক পরিত্যাগপূর্ব্বক অসন্দিগ্ধরূপে আশ্বাসিত হইয়া স্বীয় পরিচয় প্ৰদান কর।”
“দময়ন্তী কহিলেন, “হে তাপসগণ! আমি মানুষী; বন, গিরি বা নদীর অধিষ্ঠাত্রী দেবতা নহি; বিস্তারিতরূপে আত্মবৃত্তান্ত-সকল বর্ণনা করিতেছি, শ্রবণ করুন। আমি বিদর্ভদেশাধিপতি ভীমের তনয়া এবং যিনি নিষধদেশের অধীশ্বর, অদ্বিতীয় যোদ্ধা, দেবারাধনতৎপর, দ্বিজাতিজনবৎসল, নিষধবংশের প্রতিপালক, তেজের আকর, সত্যের আশ্রয়, বলের আধার ও ধর্ম্মের আগার; যিনি সত্যসন্ধ, অরাতিকুলের অন্তক, তত্ত্বজ্ঞানের আয়তন, বেদবেদাঙ্গের পারদর্শী ও প্রধান প্রধান যজ্ঞের আহৰ্তা; যাঁহার কান্তি দেবরাজের ন্যায় এবং যাঁহার প্রভা প্রভাকর-কিরণের ন্যায়, আমি সেই যশস্বী শ্ৰীমান নলরাজের ভাৰ্য্যা; আমার নাম দময়ন্তী। নিকৃতিপরায়ণ [কুৎসিতকর্ম্মা] কোন অক্ষদেবনদক্ষ ব্যক্তির কপটদ্যূতে সেই ধর্ম্মপরায়ণকে পরাজয়পূর্ব্বক রাজ্য ও সমস্ত ধন অপহরণ করিয়া লইয়াছে। আমি এক্ষণে তাঁহার দর্শন-লালসায় বনে বনে ভ্রমণপূর্ব্বক পল্বল [অল্পজল বশিষ্ট জলাশয়-ডোবা], সরিৎ, সরোবর ও ভূধর প্রভৃতি সমুদয় স্থান অন্বেষণ করিতেছি; কিন্তু কোন স্থানেই তাঁহাকে অবলোকন করি নাই। হে তাপসগণ! আমি যাঁহার নিমিত্ত এই হিংস্ৰজন্তু-সমাকীর্ণ ভয়ানক অরণ্যমধ্যে পতিত হইয়াছি, তিনি কি আপনাদিগের রমণীয় তপোবনে আগমন করিয়াছেন? যদি কতিপয় দিনের মধ্যে তাঁহার সাক্ষাৎকার-লাভ করিতে না পারি, তাহা হইলে শরীর পরিত্যাগ করিয়া আত্মাকে শোক-সন্তাপ হইতে মুক্ত করিব। প্ৰাণেশ্বর ব্যতীত প্রাণরক্ষা করিবার প্রয়োজন নাই। আমি পতিবিরহানল-যন্ত্রণা কোনক্রমেই সহ্য করিতে পারিব না।”
দময়ন্তীর প্রতি ঋষিগণের আশ্বাসবাণী
“অনন্তর সত্যদশী তাপসগণ ভীমনন্দিনীর বিলাপবাক্য শ্রবণ করিয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে কল্যাণি! তুমি উত্তরকালে কল্যাণলাভ করিবে। আমরা তপঃপ্রভাবে অবলোকন করিতেছি, তুমি অনতিবিলম্বেই তোমার জীবিতনাথ নিষধনাথকে প্রাপ্ত হইবে। হে ভৈমি! তুমি অবিলম্বেই সেই ধার্ম্মিকবর নলরাজ সমুদয় পাপ-তাপ হইতে বিনির্ম্মুক্ত, সর্ব্বরত্নের অধীশ্বর ও প্রধান নহরের শাসন কর্ত্তৃত্বপদে অধিরূঢ় হইয়া সুস্থশরীরে শত্রুগণের শোকবৰ্দ্ধন ও সুহৃদগণের শোকাপনোদন করিতেছেন, দেখিতে পাইবে।” তাপসগণ এবম্প্রকার অভিলষিত আশ্বাসনবাক্যে নীলমহিষীকে আশ্বাসিত করিয়া অগ্নিহোত্ৰ-আশ্রমাদির সহিত অন্তর্হিত হইলেন।
“ভীমাঙ্গজ দময়ন্তী তাপসদিগকে আশ্রমাদির সহিত সহসা তিরোহিত হইতে দেখিয়া বিস্ময়াবিষ্টচিত্তে চিন্তা করিতে লাগিলেন, “এ কি আশ্চৰ্য্য ঘটনা উপস্থিত হইল! আমি কি স্বপ্নদর্শন করিলাম? সেই সকল তাপসগণ কোথায় গমন করিলেন? সেই আশ্রমমণ্ডল ও পুণ্যসলিলা মনোহারিণী তরঙ্গিণীই বা কি হইল?” তিনি এইরূপ বহুক্ষণ চিন্তা করিয়া ভৰ্ত্তৃশোকে নিতান্ত কাতর হইয়া উঠিলেন; তাহার বদন-সুধাকর অস্তোন্মুখ নিশাকরের ন্যায় প্রভাহীন হইল।
“অনন্তর নলসীমন্তিনী দময়ন্তী সে স্থান হইতে প্ৰস্থানপূর্ব্বক প্রবালশেখর, কুসুমাভরণ-ভূষিত, বিহগনাদিত এক অশোকতরু অবলোকন করিয়া তাহার নিকটে উপনীত হইলেন এবং গলদশ্রুলোচনে গদগদ বচনে বিলাপ করিতে লাগিলেন, “আহা! এই সুষমাসম্পন্ন অশোকতরু-কাননের অভ্যন্তরে বহুবিধাশেখর পর্ব্বতরাজের ন্যায় বিরাজমান হইতেছে। হে প্রিয়দর্শন অশোকপাদপ! অচিরে আমার শোকপনোদন কর। হে বিগতশোক! তুমি কি দময়ন্তীর প্রিয়পতি নিষধদেশের অধিপতি নল-নৃপতিকে নিরীক্ষণ করিয়াছ? তিনি স্বীয় সুকুমার অঙ্গ অৰ্দ্ধবাসনে আচ্ছাদিত করিয়া এই অরণ্যে আগমন করিয়াছেন। হে অশোক! আমি যাহাতে তোমার নিকট হইতে অশোক হইয়া গমন করিতে পারি, তুমি তাহার উপায়-বিধান কর। হে শোকনাশন! তুমি অশোকনামের সার্থকতা রক্ষা কর।”
বণিকদলের সহিত দময়ন্তীর মিলন
“অনন্তর দময়ন্তী সেই অশোকতরুকে পরিত্যাগ করিয়া নিজ পতির অন্বেষণ করিতে করিতে এক অতি ভীষণপ্রদেশে উপস্থিত হইলেন। তথায় অনেকানেক বৃক্ষ, নদী, পর্ব্বত, মৃগ, পক্ষী ও কন্দর প্রভৃতি অদ্ভুতদৰ্শন বস্তু-সকল দর্শন করিতে লাগিলেন। অনন্তর কিয়দ্দূর অতিক্রম করিয়া এক সুরম্য তরঙ্গিণীতীরে উপনীত হইয়া দেখিলেন, নদীর জল অতি প্ৰসন্ন ও স্বচ্ছ, তার ভূমি বেতসলতায় আচ্ছাদিত হইয়া রহিয়াছে; সলিলোপকণ্ঠে ক্রেীঞ্চ, কুরর, চক্ৰবাক প্রভৃতি জলচর পক্ষিগণ সুমধুর-স্বরে গান করিয়া ইতস্ততঃ সঞ্চরণ করিতেছে; বারিমধ্যে কূর্ম্ম, কুম্ভীর ও মৎস্যদল সন্তরণ করিয়া ক্রীড়া করিতেছে এবং গজতুরগসন্ধুল এক বিপুল সাৰ্থ [বণিকদল] সেই নদী উত্তীর্ণ হইতেছে।
“দময়ন্তী সেই মহাসাৰ্থ সন্দর্শন করিয়া তাহাদিগের মধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। তাহারা সকলে তাঁহাকে উন্মত্তার ন্যায় অৰ্দ্ধবস্ত্ৰধারিণী, কৃশশরীর, মলিনবর্ণ ও তাঁহার ধূলিধূসরিত কেশ্যকলাপ নিরীক্ষণ করিয়া কেহ বা ভয়ে পলায়ন করিল, কেহ। বা সাতিশয় চিন্তান্বিত হইল, কেহ বা চীৎকার করিয়া উঠিল, কেহ তাঁহাকে উপহাস করিতে লাগিল, কেহ বা তাহার প্রতি দোষারোপ করিল; কিন্তু তাহার মধ্যে কতকগুলি লোক কারুণ্যরসবশংবদ [করুণরসে আবিষ্ট—দয়াপরবশ] হইয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল, “কল্যাণি! আপনি কে, কাহার পরিগ্রহ ও এই অরণ্যে কি অন্বেষণ করিতেছেন? আমরা আপনাকে নয়নগোচর করিয়া নিতান্ত কাতর হইয়াছি; অতএব আপনি যথার্থরূপে স্বীয় পরিচয় প্ৰদান করুন। আপনি কি মানুষী অথবা বন, পর্ব্বত বা দিকের অধিষ্ঠাত্রী দেবী কিংবা যক্ষী বা রাক্ষসী? আপনি যে হউন, আমরা আপনার শরণাপন্ন হইলাম, আপনি এক্ষণে এই সার্থবাহগণ যাহাতে এ স্থান হইতে নির্ব্বিঘ্নে প্রস্থান করিতে পারে ও যাহাতে ইহাদের শ্ৰেয়োলাভ হয়, তাহার উপায়বিধান করুন।”
‘কান্তবিরহবিধুরা দময়ন্তী সাৰ্থ-বাক্য শ্রবণানন্তর কহিলেন, ‘সার্থ, সার্থবাহ ও বালক, যুবা, স্থবির প্রভৃতি তোমরা যে কেহই এখানে বিদ্যমান আছ, আমি সকলকেই কহিতেছি, শ্রবণ কর। আমি মানুষী, রাজার কন্যা, রাজার পুত্রবধু ও রাজার ভাৰ্য্যা। বিদৰ্ভরাজ ভীমসেন আমার পিতা ও নিষধরাজ মহাত্মা নল আমার ভর্ত্তা, আমি সেই নিষধাধিপতির অন্বেষণ করিতেছি। যদি তিনি তোমাদিগের নয়নপথের পথিক হইয়া থাকেন, তাহা হইলে শীঘ্ৰ তাঁহার শুভসংবাদ প্ৰদান করিয়া আমার সন্তাপশান্তি কর।”
“শুচি-নামক কোন সার্থিবাহ তাঁহার বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিল, ভদ্রে! আমি এই সার্থের নেতা; কিন্তু নলনামে কোন মনুষ্যই আমার দৃষ্টিপথে পতিত হয় নাই। এই মানবসম্পর্কশূন্য অরণ্যে বহুসংখ্যক কুরঙ্গ, মাতঙ্গ, মহিষ, শার্দ্দুল, দ্বীপী ও ভল্লুক নিরীক্ষণ করিয়াছি; কিন্তু তোমা ভিন্ন কোন মানবই আমার নয়নগোচর হয় নাই। অদ্য যক্ষরাজ মণিভদ্র আমাদিগের প্রতি প্ৰসন্ন হউন, আমরা স্বচ্ছন্দে গমন করি।”
“দময়ন্তী সেই সাৰ্থবাহ ও সমস্ত বণিকগণকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমাদের এই সাৰ্থ কোথায় যাইবে।” তাহারা কহিল, ‘আমরা লাভের নিমিত্ত চেদিরাজ সুবাহুর জনপদে গমন করিব।’