৬৩তম অধ্যায়
ব্রাহ্মণের নিষিদ্ধ ধর্ম্ম
ভীষ্ম কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ! জ্যাকর্ষণ, বৈরনির্য্যাতন, কৃষি, বাণিজ্য, পশুপালন ও ধনোপার্জ্জনের নিমিত্ত অন্যের উপাসনা করা ব্রাহ্মণের নিতান্ত অকৰ্ত্তব্য। পণ্ডিত ব্রাহ্মণগণ গৃহস্থ ধর্ম্মাবলম্বন ও প্রাণায়ামাদি ষট্কাৰ্য্যের অনুষ্ঠানপূর্ব্বক গার্হস্থ্যধর্ম্মে কৃতকাৰ্য্য হইয়া অরণ্যবাস আশ্রয় করিবেন। রাজসেবা, কৃষি, বাণিজ্য, কুটিলতা, লাম্পট্য ও কুসীদগ্রহণ পরিত্যাগ করা ব্রাহ্মণের অবশ্য কর্ত্তব্য। যে সমস্ত ব্রাহ্মণ দুশ্চরিত্র ও স্বধর্ম্মত্যাগী হইয়া শূদ্ৰাগমন, নৃত্য ও গ্রামদৌত্য [কোটনামী] প্রভৃতি পাপকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করে, তাঁহারা বেদাধ্যয়ন করুন বা না করুন, তাঁহাদিগকে শূদ্রতুল্য জ্ঞান করিয়া শূদ্রপংক্তির মধ্যে ভোজন প্রদান ও দেবকার্য্যানুষ্ঠানসময়ে পরিত্যাগ করা বিধেয়। নিয়মবিহীন, অশুচি, ক্রূর, হিংস্রস্বভাব ও স্বধর্ম্মত্যাগী ব্রাহ্মণকে হব্যকব্যাদি প্রদান করিলে কোন ফলই লাভ হয় না। দম, শৌচ ও সরলতা ব্রাহ্মণের নিত্যধৰ্ম্ম। ভগবান্ ব্রহ্মা সর্ব্বপ্রথমে ব্রাহ্মণগণের সৃষ্টি করিয়াছেন; অতএব সমুদয় আশ্রমেই উহাদের অধিকার আছে। দান্ত, সোমপায়ী, সৎস্বভাব, দয়াবান, সহিষ্ণু, লোভশূন্য, সরল, শান্তপ্রকৃতি, অনৃশংস ও ক্ষমতাশালী ব্রাহ্মণই যথার্থ ব্রাহ্মণ। পাপপরায়ণ ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণই নহে। লোকে শূদ্র, বৈশ্য ও ক্ষত্রিয়ের সাহায্যেই ধর্ম্মলাভ করিতে সমর্থ হয়; অতএব উক্ত বর্ণত্রয় শান্তিধৰ্ম্ম অবলম্বন না করিলে কদাচ বিষ্ণুর অনুগ্রহলাভে সমর্থ হয় না। বিষ্ণু প্রসন্ন না হইলে চারিবর্ণের ধর্ম্ম, বেদ, যাগযজ্ঞাদি ক্রিয়াকলাপ ও আশ্রমধর্ম্ম সকলই অকিঞ্চিৎকর হইয়া যায়।
ক্ষত্রিয়ের আচরণীয় ধৰ্ম্ম
“এক্ষণে যে রাজা আপনার রাজ্যস্থ ব্রাহ্মণ, বৈশ্য ও শূদ্রগণকে সমুচিত আশ্রমধৰ্ম্মে অবস্থাপিত করিতে অভিলাষ করেন, তাঁহার অবশ্যজ্ঞাতব্য ধৰ্ম্মসমুদয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। যে শূদ্র আপনার শরীর সামর্থ্যানুসারে সুদীর্ঘকাল তিনবর্ণের সেবা, পুত্রোৎপাদন, ধৰ্ম্মানুষ্ঠান, সদাচারদ্বারা তিনবর্ণের সমতালাভ ও পুরাণশ্রবণদ্বারা আত্মজ্ঞান লাভ করিতে বাসনা করে, সে রাজার আজ্ঞা গ্রহণপূৰ্ব্বক তাহার সমুদয় আশ্রম আশ্রয় করিতে পারে। অতএব স্বধৰ্ম্মনিরত ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রেরও ভৈক্ষ্যধৰ্ম্মগ্রহণে অধিকার আছে। কৃতকাৰ্য্য পরিণতবয়াঃ [প্রৌঢ়বৃদ্ধাদি অবস্থাপ্রাপ্ত] বৈশ্যও রাজার অনুমতি লইয়া আশ্ৰমান্তর গ্রহণ করিতে পারে। রাজা বেদ ও রাজনীতি অধ্যয়ন, সন্তানোৎপাদন, সোমরসপান, রাজসূয়, অশ্বমেধ প্রভৃতি বিবিধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান, ধৰ্ম্মানুসারে প্রজাপালন, বেদপাঠ করাইয়া বিপ্রগণকে দক্ষিণাদান, সংগ্রামে জয়লাভ, স্বীয় পুত্রকে বা অন্য কোন উপযুক্ত ক্ষত্রিয়কে রাজ্যে অভিষেক এবং যত্নপূৰ্ব্বক যজ্ঞদ্বারা দেবগণের, শ্রাদ্ধাদিদ্বারা পিতৃগণের ও বেদাধ্যয়নদ্বারা ঋষিগণের তৃপ্তিসাধন করিয়া শেষাবস্থায় আশ্ৰমান্তরগমনে অভিলাষ করেন, তিনি আনুপূর্ব্বিক সমস্ত আশ্রমে গমন করিয়া সিদ্ধিলাভে সমর্থ হয়েন। রাজা গৃহস্থধর্ম্ম পরিত্যাগপূৰ্ব্বক ঋষি হইয়া আপনার জীবনরক্ষার নিমিত্তই ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করিতে পারেন। ভিক্ষাবৃত্তি-অবলম্বন ক্ষত্রিয়াদি তিনবর্ণের কাম্যধৰ্ম্ম; নিত্যধৰ্ম্ম নহে।
“মানবমণ্ডলীমধ্যে ক্ষত্রিয়েরাই শ্রেষ্ঠতর ধৰ্ম্মের সেবা করিয়া থাকে। বেদে কথিত আছে যে, অন্য তিনবর্ণের যাবতীয় ধর্ম্ম ও উপধৰ্ম্ম সমস্তই রাজধৰ্ম্মের আয়ত্ত। যেমন সমুদয় প্রাণীর পদচিহ্ন হস্তীর পদচিহ্নে লীন হইয়া যায়, তদ্রূপ সমস্ত ধৰ্ম্মই রাজধৰ্ম্মে লীন রহিয়াছে। ধর্ম্মবেত্ত পণ্ডিতগণ অন্যান্য ধর্ম্মকে অল্পফলপ্রদ এবং ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মকে আশ্রমের সারভূত ও কল্যাণের একমাত্র নিদান বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়াছেন। ফলতঃ রাজধৰ্ম্ম সমুদয় ধৰ্ম্মের সারভূত। রাজধৰ্ম্মপ্রভাবেই সমুদয়লোক প্রতিপালিত হইতেছে। দণ্ডনীতি না থাকিলে বেদ ও সমুদয় ধৰ্ম্ম এককালে বিনষ্ট হইয়া যায়। ত্যাগ, দীক্ষা, লোকাচার ও বিদ্যাসমুদয় রাজধৰ্ম্মেই নির্দিষ্ট রহিয়াছে। রাজধর্ম্মের প্রাদুর্ভাব না থাকিলে কেহই আর আপনার ধর্ম্মের প্রতি আস্থা করে না।”