৬২তম অধ্যায়
মহনীয় কীর্ত্তি মান্ধাতার মৃত্যুকথা
নারদ কহিলেন, হে সৃঞ্জয়! যুবনাশ্বের পুত্র সুর, অসুর ও মনুষ্যগণের বিজেতা মহারাজ মান্ধাতাকেও করাল কাল কবলে পতিত হইতে হইয়াছে। স্বর্গ বৈদ্য অশ্বিনীকুমার-দ্বয় মান্ধাতাকে তাঁহার পিতার গর্ভ হইতে নিষ্কাশিত করেন। একদা মান্ধাতার পিতা মহারাজ যুবনাশ্ব মৃগয়ায় গমন করিয়া নিতান্ত তৃষ্ণাতুর ও শ্রান্তবাহন হইয়াছিলেন। ঐ সময় তিনি যজ্ঞধূম লক্ষ্য করিয়া যজ্ঞ স্থলে গমন পূর্ব্বক পৃষদাজ্য ভক্ষণ করেন। ঐ পৃষদাজ্যের প্রভাবে মহারাজ যুবনাশ্বের গর্ভ হইল। ভিষক্গণের অগ্রগণ্য অশ্বিনীকুমার-দ্বয় যুবনাশ্বকে তদবস্থ দেখিয়া তাঁহার গর্ভ হইতে সুকুমার নবকুমার নিষ্কাশিত করিয়া তাঁহার ক্রোড়ে সংস্থাপন করিলেন। দেবগণ সেই দেব সদৃশ তেজসম্পন্ন বালককে পিতার অঙ্কে শয়ান দেখিয়া পরস্পর কহিতে লাগিলেন, এই বালক কি পান করিয়া জীবন ধারণ করিবে? তখন সুররাজ পুরন্দর কহিলেন, এই বালক আমার অঙ্গুলি পান করুক। সুররাজ এই কথা কহিবা মাত্র তাঁহার অঙ্গুলি সমুদায় হইতে অমৃতময় দুগ্ধ নিঃসৃত হইতে লাগিল। সুররাজ অনুগ্রহ করিয়া ‘এই বালক মান্ধাতা অর্থাৎ আমার অঙ্গুলি পান করুক’ বলিয়াছিলেন, এই নিমিত্ত সুরগণ যুবনাশ্বতনয়ের নাম মান্ধাতা রাখিলেন। তখন ইন্দ্রের হস্ত হইতে ঘৃত ও দুগ্ধের ধারা নিঃসৃত হইয়া যুবনাশ্বতনয়ের মুখে নিপতিত হইতে লাগিল। মান্ধাতা এইরূপে সুররাজের অঙ্গুলি পান করিয়া দিন দিন সমধিক পরিমাণে পরিবর্দ্ধিত হইতে লাগিলেন। তিনি দ্বাদশ দিনে দ্বাদশ হস্ত পরিমিত ও মহাবল পরাক্রান্ত হইয়া উঠিলেন।
হে সৃঞ্জয়! ধর্ম্মাত্মা, ধৃতিমান্, সত্যপ্ৰতিজ্ঞ, জিতেন্দ্রিয়, মহাবলশালী, যুবনাশ্বতনয় মান্ধাতা এক দিনে সমুদায় পৃথিবী পরাজয় করেন। মহারাজ জনমেজয়, সুধম্বা, গয়, শূল, বৃহদ্রথ, অমিত ও মৃগ মান্ধাতার কাৰ্ম্মুকবলে পরাজিত হন। সূর্যের উদয়স্থান অবধি অস্তগমন স্থান পর্য্যন্ত যে সকল প্ৰদেশ আছে, তৎসমুদায় অদ্যাপি মান্ধাতার ক্ষেত্র বলিয়া অভিহিত হইতেছে। মহাত্মা মান্ধাতা শত অশ্বমেধ ও শত রাজসুয়ের অনুষ্ঠান করিয়া পদ্মরাগ খনি সম্পন্ন সুবর্ণা কর যুক্ত দশযোজন দীর্ঘ, এক যোজন বিস্তৃত মৎস্য সকল ব্রাহ্মণগণকে প্রদান করিয়াছিলেন। ঐ যজ্ঞে দর্শনার্থী সমাগত জনগণ ব্রাহ্মণ ভোজনাবশিষ্ট বহু প্রকার সুস্বাদু ভক্ষ্য, ভোজ্য ও অন্ন ভোজন করিয়া সমধিক তৃপ্তি লাভ করিয়াছিল। যজ্ঞস্থানে নানাবিধ ভক্ষ্য ও পান এবং অন্ন-পর্ব্বতের অপূর্ব্ব শোভা হইয়াছিল। সূপরূপ পঙ্ক, দধিরূপ ফেন ও গুড়-রূপ সলিলশালিনী মধুক্ষীরবাহিনী নদী সকল ধৃত হ্রদে গমন করত অন্নপর্ব্বত সকল অবরোধ করিত। অসংখ্য বেদ, অসুর, নর, যক্ষ, গন্ধর্ব্ব, উরগ, পক্ষী এবং বহু সংখ্যক দেব বেদাঙ্গপারগ ব্রাহ্মণ ও ঋষিগণ ঐ যজ্ঞে সমুপস্থিত হইয়া ছিলেন। তথায় কোন ব্যক্তিই মূর্খ ছিল না। মহাবীর মান্ধাতা অর্ণব-মেখলা বসুপূর্ণা বসুন্ধরা ব্রাহ্মণসাৎ করিয়া স্বীয় যশ প্রভাবে দশ দিক্ আবরণ পূর্ব্বক পরিশেষে কলেবর
পরিত্যাগ করত পুণ্যাজ্জিত লোকে গমন করেন। হে সৃঞ্জয়! তোমা অপেক্ষা সমধিক তপ, সত্য, দয়া ও দানশালী এবং তোমার পুত্র অপেক্ষা অধিক পুণ্যবান্ মহাত্মা মান্ধাতাকেও কাল গ্রাসে পতিত হইতে হইয়াছে; অতএব তুমি অযাজ্ঞিক অধ্যয়নাদি রহিত স্বীয় পুত্রের নিমিত্ত আর শোক করিও না।