৬২তম অধ্যায়
দুৰ্য্যোধনকর্ত্তৃক ভীষ্মপ্রভৃতির উপেক্ষা
“হে পিতামহ! পাণ্ডবগণ ও মনুষ্য, আমরাও মনুষ্য; অতএব আপনি কি নিমিত্ত কেবল তাহাদিগেরই জয়লাভ আশঙ্কা করিতেছেন? আমরা ও তাহারা উভয় পক্ষই বীৰ্য্য, পরাক্রম, শম, বসয়, প্রতিভা, শাস্ত্রজ্ঞান, শূরগণের সম্পত্তি, অস্ত্র, শস্ত্র, শীঘ্রতা কৌশল ও জাতি-সকল বিষয়েই সমান; তবে আপনি কি প্রকারে অবগত হইলেন যে, পাণ্ডবগণই বিজয় লাভ করিবে? হে পিতামহ! কি দ্রোণ, কি কৃপ, কি বাহ্লিক, কি অন্যান্য নরপতিগণ, আমি ইহাদিগের মধ্যে কাহারও উপর নির্ভর করিতেছি না; কেবল নিজ পরাক্রমে কাৰ্য্যারম্ভ করিব। আমি, কর্ণ ও আমার ভ্ৰাতা দুঃশাসন, আমরা এই তিনজনেই নিশিত শরসমূহে পঞ্চপাণ্ডবকে সংহার করিয়া পরিশেষে বহুদক্ষিণ বহুবিধ মহাযজ্ঞ, গো, অশ্ব ও ধনদ্বারা ব্ৰাহ্মণগণকে পরিতুষ্ট করিব। যেমন মৃগশাবকগণ তন্তুদ্বারা অনায়াসে আকৃষ্ট হয়, যেমন স্রোতদ্বারা কর্ণধারবিহীন নৌকা আবর্তে নিপতিত হয়, সেইরূপ পাণ্ডবগণ যখন আমার সৈন্যসমূহকর্ত্তৃক বাহুদ্বারা আক্রান্ত হইবে, তখন তাহারা ও বাসুদেব রথনাগসমাকুল শক্রগণকে নয়নগোচর করিয়া গর্ব্ব পরিত্যাগ করবে।”
বিদুরের ক্ষমাধৰ্ম-ব্যাখ্যা
বিদূর কহিলেন, “হে রাজেন্দ্ৰ! সিদ্ধান্তবিৎ বৃদ্ধগণ ইহলোকে ব্ৰাহ্মণগণের দমগুণকেই সনাতন ধর্ম্ম ও মোক্ষ বলিয়া নির্দ্দেশ করেন। দমসম্পন্ন ব্যক্তিরই দান, ক্ষমা ও সিদ্ধি প্রকৃতরূপ উৎপন্ন হয়। সেই দমগুণ দান, তপ, জ্ঞান ও অধ্যয়নের অনুসরণ করিয়া থাকে। দিম অতি পবিত্ৰ গুণ, উহাদ্বারা তেজ বৰ্দ্ধিত হয়। তেজ বর্দ্ধিত হইলে পাপসকল বিনষ্ট হয়। পাপ বিনষ্ট হইলে ব্ৰহ্মলাভ হইয়া থাকে। লোকে রাক্ষস হইতে যেরূপ ভীত হয়, আদান্ত ব্যক্তিদিগকে সেইরূপ ভয় করিয়া থাকে। বিধাতা উহাদিগকে দমন করিবার নিমিত্ত ক্ষত্রিয় সৃষ্টি করিয়াছেন। দমব্রত প্রতিপালন করা চতুর্ব্বিধ আশ্রমী ব্যক্তিরই কর্ত্তব্য। হে মহারাজ! এক্ষণে দমগুণসম্পন্ন ব্যক্তিদিগের লক্ষণ শ্রবণ করুন। ক্ষমা, ধৃতি, অহিংসা, সমদৰ্শিতা, সত্য, সরলতা, ইন্দ্ৰিয়জয়, ধৈৰ্য্য, মৃদুতা, লজ্জা, স্থৈৰ্য্য, অকার্পণ্য, অক্রোধ, সন্তোষ ও শ্রদ্ধা-এইসকল গুণসম্পন্ন ব্যক্তিই দান্ত বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হয়েন। দান্ত ব্যক্তি কাম, লোভ, দৰ্প, ক্ৰোধ, নিদ্রা, আত্মশ্লাঘা, অভিমান, ঈৰ্ষা ও শোকের সেবা করেন না। যিনি কুটিলতা ও শঠতা-পরিবর্জিত, শুদ্ধ, আলোলুপ ও কামনাপরাঙ্মুখ, তিনি সমুদ্রের ন্যায় দান্ত বলিয়া পরিকীর্ত্তিত হয়েন। যিনি সদাচার, সুশীল, প্রসন্নস্বভাব, আত্মতত্ত্বজ্ঞ ও পণ্ডিত, তিনি ইহলোকে সম্মানভাজন হইয়া পরলোকে সদগতি লাভ করেন। যিনি অন্য লোক হইতে ভীত হন এবং অন্য লোকও যাহার নিকট ভয় প্রাপ্ত হয় না, তিনি পরিণতবুদ্ধি ও প্রধানমনুষ্য বলিয়া বিখ্যাত। তিনি সকল প্রাণীর হিতকারী ও মিত্র; তাঁহা হইতে কাহারও উদ্বেগের সম্ভাবনা নাই; তিনি প্রজ্ঞাদ্বারা তৃপ্তিলাভপূর্ব্বক সমুদ্রের ন্যায় গভীর ও শান্ত হইয়া থাকেন। দম-ও শমপরায়ণ পুরুষগণ সাধুদিগের আচারব্যবহারের অনুগামী হইয়া আনন্দিত হন। যিনি জ্ঞানতৃপ্ত ও জিতেন্দ্ৰিয় হইয়া সমুদয় কর্ম্মপরিত্যাগপূর্ব্বক সময় প্রতীক্ষা করিয়া ইহলোকে বিচরণ করেন, তিনি ব্ৰহ্মপদপ্রাপ্ত হয়েন। যেমন আকাশে শকুনিগণের সঞ্চারণমার্গ লক্ষিত হয় না, সেইরূপ প্রজ্ঞানতৃপ্ত ঋষিগণের পথও উপলব্ধি করা যায় না; যিনি গৃহপরিত্যাগ করিয়া মোক্ষপথ অবলম্বন করেন, তাহার নিমিত্ত স্বর্গে তেজোময় লোকসকল প্রস্তুত হইয়া থাকে।”