০৬২.কুরু-পাণ্ডবের শত্রুতা-কারণ জিজ্ঞাসা । মহাভারতমাহাত্ম্য

দ্বিষষ্টিতম অধ্যায়
কুরু-পাণ্ডবের শত্রুতা-কারণ জিজ্ঞাসা

জনমেজয় কহিলেন, হে দ্বিজেন্দ্র! আমি ভারতীয় উপাখ্যান সংক্ষেপে শ্রবণ করিলাম। এক্ষণে কুরুবংশীয়দিগের অতিবিচিত্র চরিত্র সবিস্তর কীর্ত্তন করিয়া আমার কৌতূহলাক্রান্ত চিত্তকে সন্তুষ্ট করুন। পূর্ব্বপুরুষদিগের বিশুদ্ধ চরিতাবলী সংক্ষেপে শ্রবণ করিয়া আমার অন্তঃকরণ পরিতৃপ্ত হইল না। ধর্ম্মপরায়ণ পাণ্ডবগণ যে কারণে অবধ্য জ্ঞাতিকুল সংহার করিয়াও লোকের প্রশংসাপাত্র হইয়াছিলেন, বোধ করি, সে কারণ সামান্য কারণ নহে। আর তাঁহারা নিরপরাধ ও প্রতিবিধানসমর্থ হইয়াও শত্রুকৃত দুঃসহ ক্লেশ সহ্য করিয়াছিলেন, তাহারই বা কারণ কি? মহাবল মহাবাহু ভীমসেন এত কষ্ট স্বীকার করিয়াও কি কারণে ক্রোধসংবরণ করিয়াছিলেন? পতিব্রতা দ্রৌপদী সভামধ্যে তাদৃশ অপমানিত হইয়াও কেন ক্রোধ-চক্ষুদ্বারা সেই দুরাত্মা কৌরবদিগকে ভস্মাবশেষ করিলেন না? যখন ধর্ম্মনন্দন যুধিষ্ঠির দ্যূতে আসক্ত হয়েন, তখন ভীম, অর্জ্জুন ও নকুল সহদেব কেন তাঁহাকে নিবারণ করিলেন না? কি প্রকারেই বা অর্জ্জুন কৃষ্ণের সহায়তায় সেই প্রভূত কুরুসেনা পরাভূত করিয়াছিলেন? হে তপোধন! আপনি এই সকল বৃত্তান্ত এবং পাণ্ডবদিগের আচরিত অন্যান্য বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত কীর্ত্তন করুন।

মহাভারতমাহাত্ম্য

বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! কৃষ্ণদ্বৈপায়নপ্রোক্ত এই পবিত্র উপাখ্যান অতি বিস্তীর্ণ, অতএব ইহা শ্রবণ করিবার সময় নির্দ্দেশ করুন, আমি আপনার নিকট উহা সবিস্তার কীর্ত্তন করিব। সত্যবতীপুৎত্র ভগবান্ ব্যাদেব এই গ্রন্থে একলক্ষ শ্লোক রচনা করিয়াছেন। যে-সকল ব্যক্তি উহা শ্রবণ করাইবেন এবং যাঁহারা শ্রদ্ধা ও ভক্তিসহকারে শ্রবণ করিবেন, তাঁহারা ব্রহ্মলোকে গমন করিয়া দেবতুল্য হইবেন। বেদব্যাস-প্রণীত এই পরমপবিত্র রমণীয় ইতিহাস সাক্ষাৎ বেদস্বরূপ। মহর্ষিগণ এই মহাভারতের যথেষ্ট প্রশংসা করিয়া থাকেন। ইহাতে অর্থ ও কামবিষয়ক অশেষ উপদেশ প্রাপ্ত হওয়া যায় এবং এতৎশ্রবণে পরিনিষ্ঠাবতী [আস্তিক্যযুক্তা —নির্ম্মলা] বুদ্ধি জন্মে। বিদ্বান্ ব্যক্তিরা দানশীল, সত্যস্বভাব, ধর্ম্মপরায়ণ ও অকৃপণ ব্যক্তিদিগকে মহাভারত শ্রবণ করাইয়া প্রচুর অর্থলাভ করেন, শ্রোতা অতিনিষ্ঠুর হইলেও এই অপূর্ব্ব ইতিহাস শ্রবণে রাহু হইতে মুক্ত চন্দ্রের ন্যায়, ভ্রূণহত্যাদি মহাপাতক হইতেও আশু বিমুক্ত হইতে পারে। বিজিগীযু [জয়াকাঙ্ক্ষী] ব্যক্তিদিগের এই জয়খ্য ইতিহাস শ্রবণ করা কর্ত্তব্য। রাজারা ইহা শ্রবণ করিলে রাজ্যলাভ ও শত্রুপরাজয় করিতে পারেন। যদি কোন যুবা রাজমহিষীর সহিত এই পুৎত্রফলপ্রদ পরম-স্বস্ত্যয়নস্বরূপ মহাভারত শ্রবণ করেন, তাহা হইলে তাঁহাদিগের বীরপুৎত্র বা রাজ্যভাগিনী কন্যা জন্মে। মহর্ষি বেদব্যাস রচিত এই মহাভারতই পবিত্র ধর্ম্মশাস্ত্র; অর্থশাস্ত্র ও মোক্ষশাস্ত্র, এক ব্যক্তি বক্তা ও অন্যে ইহার শ্রোতা হয়েন। শ্রোতাদিগের পুৎত্র-পৌৎত্রেরও শুশ্রূষাপরায়ণ এবং ভূত্যেরাও প্রভুপরায়ণ হইয়া থাকে। যে-নর মহাভারত শ্রবণ করেন, তিনি কায়িক, বাচিক ও মানসিক ত্রিবিধ পাপরাশি হইতে বিমুক্ত হয়েন। যাঁহারা বিদ্বেষ বুদ্ধিশূন্য হইয়া এই ভারতবংশীয় ইতিবৃত্ত শ্রবণ করেন, তাঁহাদিগের ব্যাধিভয় ও পরলোকভয় নিবারণ হয়। বেদব্যাস স্বগ্রন্থে সর্ব্ববিদ্যা পারদর্শী মহাপ্রভাবশালী পাণ্ডবদিগের ও অন্যান্য রাজর্ষিদিগের কীর্ত্তী বিস্তার করিয়াছেন। ইহা অতি বিচিত্র ও পবিত্র, শ্রবণ করিলে শ্রোত্রযুগল চরিতার্থ হয়। যে মানব জীবলোকে পূণ্যসঞ্চয় করিবার মানসে সদাচারপরায়ণ ব্রাহ্মণগণকে ইহা শ্রবণ করান, তিনি সনাতন-ধর্ম্ম লাভ করেন। যিনি অতি পূতমনে সর্ব্বলোকপ্রখ্যাত এই কুরুবংশীয় ইতিহাস কীর্ত্তন করেন, তাঁহার বংশপরম্পরা ক্রমশঃ বিস্তার হইতে থাকে। যদি বেদপারগ ব্রাহ্মণ ব্রতানুষ্ঠানপরতন্ত্র হইয়া চারি বৎসর ও চারি মাস মহাভারত অধ্যয়ন করেন, তিনি সকল পাপ হইতে মুক্ত হইতে পারেন। এই মহাভারতে দেবতা, রাজর্ষি ও ব্রহ্মর্ষিদিগের বিষয় বর্ণিত ও ভগবান্ বাসুদেবের সুচরিত কীর্ত্তিত আছে। ইহাতে ভগবান্ ভূতভাবন ভবানীপতি দেবী পার্ব্বতীর অনির্ব্বচনীয় মহিমা এবং কার্ত্তিকেয়ের উৎপত্তি ও গোব্রাহ্মণের মাহাত্ম্য বর্ণিত আছে। এই মহাভারত নিখিল বেদের সমষ্টিস্বরূপ। অতএব ধর্ম্মবুদ্ধি লোকদিগের ইহা সর্ব্বদা শ্রবণ করা কর্ত্তব্য। যিনি প্রতি পর্ব্বাহে ব্রাহ্মণগণকে মহাভারত শ্রবণ করান, তাঁহার পাপনাশ ও নিত্যকাল ব্রহ্মলোকে বাস হয়। শ্রাদ্ধকালে ব্রাহ্মণদিগকে ভারতের অন্ততঃ এক চরণমাত্রও শ্রবণ করাইলে পিতৃলোক অক্ষয় অন্নপানে পরিতৃপ্ত হয়েন। মন ও ইন্দ্রিয় দ্বারা অহোরাত্রে জ্ঞানাজ্ঞানকৃত যে-সকল পাপ সঞ্চিত হয়, মহাভারত শ্রবণ করিলে তাহা তৎক্ষণাৎ নষ্ট হয়। এই গ্রন্থে ভারতবংশীয় রাজাদিগের মহাবংশ বর্ণিত আছে বলিয়া ইহার নাম মহাভারত হইয়াছে। যিনি এই মহাভারতের সমুদয় সিদ্ধান্ত স্থির করিতে পারেন, তাঁহার সকল পাপ অপগত হয়। এই অদ্ভুত ইতিহাস শ্রবণ করাইলে শ্রোতা মহাপাতক হইতে পরিত্রাণ পায়। মহর্যি ব্যাস প্রতিদিন প্রাতঃকৃত্যাদি সমাপনানন্তর নিয়মিত তপোজপাদির অব্যাঘাতে [অবিঘ্নে —ব্যাঘাত না হয় এরূপ ভাবের অবকাশে] তিন বৎসরে এই মহাভারত রচনা করেন, অতএব নিয়মবিশিষ্ট হইয়া ইহা শ্রবণ করা কর্ত্তব্য। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন প্রোক্ত এই অপূর্ব্ব মহাভারতীয় কথা যিনি শ্রবণ করান ও যাঁহারা ভক্তি ও শ্রদ্ধাসহকারে শ্রবণ করেন, তাঁহাদিগকে জন্মমৃত্যুরূপ দুর্ভেদ্য শৃঙ্খলে বদ্ধ থাকিয়া আর পাপ-পুণ্যের ফলভোগ করিতে হয় না। যে-নর ধর্ম্মকামনায় এই ইতিহাসের আদ্যোপান্ত সমুদয় শ্রবণ করেন, তাঁহার সকল বাসনা সফল হয় ও তিনি চরমে দেবলোকে গমন করিয়া পরম সন্তোষ লাভ করেন। সমুদ্র ও মহাগিরি সুমেরু যেমন রত্নাকর বলিয়া প্রসিদ্ধ, সেইরূপ বহুবিধ সুচারু শব্দে অলঙ্কৃত এই রমণীয়তর মহাভারতও এক অত্যুৎকৃষ্ট ইতিহাস বলিয়া প্রসিদ্ধ। যে ব্যক্তি অর্থীদিগকে এই শ্রবণ-সুখকর মহাভারত প্রদান করেন, তাঁহার সসাগরা পৃথ্বীদানের ফললাভ হয়। মহারাজ! পুণ্যসঞ্চয় ও বিজয়লাভের নিমিত্ত এই অদ্ভুত কথা শ্রবণ করেন। এই মহাভারতে যাহা বর্ণিত আছে, তাহা অন্যত্রও থাকিতে পারে, কিন্তু ইহাতে যাহা নাই, তাহা আর কুত্রাপি দেখিতে পাইবেন না।