৬২তম অধ্যায়
কলিপ্রভাবিত নলের দময়ন্তী-ত্যাগের কল্পনা
“নলরাজ কহিলেন, “প্রিয়ে! তোমার পিতার যাদৃশ্য ঐশ্বৰ্য্য, আমারও তাদৃশ্য ঐশ্বৰ্য্য ছিল, সন্দেহ নাই; কিন্তু এক্ষণে নিতান্ত দুরবস্থাগ্রস্ত হইয়া কোনপ্রকারেই তথায় গমন করিতে পারিব না। পূর্ব্বে যেস্থানে সমৃদ্ধি-সহকারে গমন করিয়া তোমার হর্ষবর্দ্ধন করিয়াছিলাম, এক্ষণে তথায় নিতান্ত দীনবেশে প্রবেশ করিয়া তোমার শোকবৰ্দ্ধন করিতে পারিব না।” নলরাজ ইহা কহিয়া অৰ্দ্ধবসনাবৃত দময়ন্তীকে বারংবার সান্ত্বনা করিতে লাগিলেন। অনন্তর উভয়ে একমাত্র বসন পরিধান করিয়া ইতস্ততঃ পৰ্যটন করিতে করিতে ক্ষুৎপিপাসায় সাতিশয় কাতর হইয়া কোন নিভৃত স্থানে উপস্থিত হইলেন। অনন্তর ধূলিধূসর মলিনবেশ নিষধাধিপতি প্রিয়াসহ ধরাসনে উপবেশনপূর্ব্বক ক্ষণকালমধ্যেই পরিশ্রমসুলভ নিদ্রায় অভিভূত হইয়া শয়ন করিলেন। সুকুমারী দময়ন্তী সহসা দুঃখসাগরে নিমগ্ন হইয়া নিতান্ত ক্লান্ত ও শ্রান্ত হইয়াছিলেন; পরে তিনি শয়ন করিবামাত্র অতিমাত্ৰ নিদ্রিত হইলেন। নিষধরাজের অন্তঃকরণ শোকানলে দগ্ধ হইতেছিল, সুতরায় তিনি আর পূর্ব্বের শয়ন করিয়া নিদ্রিত হইতে পারিলেন না।
“দময়ন্তী নিদ্রিতা হইলে তিনি আপনার রাজ্যপহরণ, সুহৃদগণবিয়োগ ও বনবাসের দুরবস্থা আলোচনা করিয়া চিন্তা করিতে লাগিলেন, “এক্ষণে বনে বনে ভ্ৰমণ করিলে কি হইবে? অথবা এইরূপ না করিয়াই বা কি করিব? মরণই কি শ্রেয়ঃ? কিংবা দময়ন্তীকে পরিত্যাগ করাই বিধেয়? দময়ন্তী আমার প্রতি অনুরক্ত হইয়া আমার নিমিত্তই কেবল এইরূপ দুঃখভোগ করিতেছে; আমি ইহাকে পরিত্যাগ করিলে অবশ্যই কোন কালে আত্মীয়লোকের নিকট গমন করিতে পরিবে; তাহা হইলে কখন না কখন ইহার ভাগ্যে সুখসম্ভোগও ঘটিতে পারে। এই ভাগ্যবতী যেরূপ তেজস্বিনী ও পতিপরায়ণা, তাহাতে বোধ হয়, কেহই ইহার ধর্ম্মলোপ করিতে সমর্থ হইবে না।” নিষধরাজ এবম্প্রকার বহু আন্দোলন করিয়া প্ৰণয়িনীকে পরিত্যাগ করাই শ্রেয়স্কর বলিয়া অবধারণা করিলেন।
দময়ন্তী পরিত্যাগপূর্ব্বক নলের প্রস্থান
“অনন্তর তিনি কলির দুরভিসন্ধিদ্বারা ললনাকে বিসর্জ্জন করিতে প্ৰবৃত্ত হইলেন, তিনি আপনাকে বিবসন ও প্রিয়তমাকে একবসন অবলোকন করিয়া প্রিয়াপরিহিত বসনের অৰ্দ্ধখণ্ড গ্ৰহণ করিতে অভিলাষ করিলেন। তিনি কি উপায়ে প্ৰেয়সীর নিদ্ৰাভঙ্গ না করিয়া বসনাৰ্দ্ধ কৰ্ত্তন করিবেন, এই চিন্তায় সেই স্থানেই ইতস্ততঃ সঞ্চরণ করিতে করিতে তথায় একখানি কোষনিষ্কাশিত নিশিত অসিপত্র প্রাপ্ত হইয়া তদ্দ্বারা দময়ন্তীর পরিহিত বসনার্দ্ধ কর্ত্তন করিলেন। অরাতিমর্দ্দন নিষধরাজ সেই খড়গখণ্ডিত অম্বরখণ্ড [বস্ত্রখণ্ড—আধখানি কাপড়] গ্রহণপূর্ব্বক বিগতচেতনা নিদ্রিতা নিজ নিতস্বিনীকে পরিত্যাগ করিয়া প্ৰস্থান করিলেন; কিন্তু তৎক্ষণাৎ প্রতিনিবৃত্ত হইয়া দময়ন্তীর প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া গলদশ্রুমুখে কহিতে লাগিলেন, ‘হায়! পূর্ব্বে সূৰ্য্য বা সমীরণ যাহাকে দর্শন করিতে অসমর্থ হইয়াছিলেন, এক্ষণে সেই প্ৰিয়তমা অনাথার ন্যায় ভূমিতলে শয়ন করিয়া রহিল। নিদ্ৰাভঙ্গ হইলে এই চারুহাসিনী কি প্রকারে বসনাৰ্দ্ধ পরিধান করিয়া উন্মাদিনীর ন্যায় একাকিনী হিংস্ৰজন্তুসমাকীর্ণ ভয়ঙ্কর অরণ্যে বিচরণ করিবে? অয়ি মহাভাগে! তুমি ধর্ম্মভূষণে ভূষিতা; অতএব দ্বাদশ আদিত্য, অষ্ট বসু, অশ্বিনীকুমার ও মরুদগণ তোমাকে রক্ষা করিবেন।” কলিকর্ত্তৃক হৃতচেতন নলরাজ নিরুপম-রূপসম্পন্না প্রিয়তমাকে এই প্রকার কহিয়া পুনরায় প্রস্থান করিতে প্ৰবৃত্ত হইলেন। একদিকে কলি, অন্যদিকে প্রণয়িনীর অকৃত্রিম প্রেম তাঁহাকে আকর্ষণ করিতে লাগিল। তিনি এইরূপে উভয়তঃ আকৃষ্যমাণ হইয়া বারংবার গমন ও প্রত্যাবর্ত্তন করিতে লাগিলেন। ফলতঃ তৎকালে তাঁহার হৃদয় দ্বিধাবিভক্ত হইয়া দোলার ন্যায় বারংবার বিচলিত হইতে লাগিল। পরিশেষে কলি তাঁহাকে আকৃষ্ট করিয়া মোহিত করিল। তখন তিনি কলিসংস্পর্শে হতচেতন হইয়া সেই জনশূন্য অরণ্যে নিদ্রিতা প্রিয়তমাকে একাকিনী পরিত্যাগপূর্ব্বক মনে মনে তাহার ভাবী অবস্থা কল্পনাপূর্ব্বক কারুণ্যপূর্ণ হৃদয়ে বিলাপ করিতে করিতে প্ৰস্থান করিলেন।