৬১তম অধ্যায়
সর্ব্বস্বনাশে নলের নিৰ্বেদ—পুরপরিত্যাগ
বৃহদশ্ব কহিলেন, “সারথি প্রস্থান করিলে পুষ্করকর্ত্তৃক ক্রীড়াসক্ত নলরাজের রাজ্য ও যথাসর্ব্বস্ব অপহৃত হইল। পুষ্কর ভ্রাতাকে নিঃসম্বল জানিয়া উপহাস করিয়া কহিলেন, “মহারাজ! পুনর্ব্বার দ্যূতারম্ভ হউক, এবার কি পণ হইবে? কেবল একমাত্র দময়ন্তী অবশিষ্ট আছে; নতুবা আমি অন্য সমস্ত সম্পত্তিই জয় করিয়াছি, অতএব যদি তোমার মত হয়, তবে দময়ন্তীকেই পণ করা।” পুষ্করের এইরূপ কটুক্তি শ্রবণ করিয়া নলের হৃদয় দুঃখে বিদীর্ণপ্ৰায় হইল, কিন্তু তিনি কিছুমাত্র উত্তর প্রদান করিলেন না। পরে পুষ্করের প্রতি দৃষ্টিপাত করিবামাত্র রাজার ক্রোধানল প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। তিনি তৎক্ষণাৎ সর্ব্বাঙ্গ হইতে অলঙ্কার উন্মোচন ও বিপুল রাজশ্ৰী পরিত্যাগপূর্ব্বক একবসনধারী হইয়া অনাবৃতশরীরে পুর হইতে নিৰ্গম করিলেন। তাঁহার তাদৃশী দুরবস্থা দর্শন করিয়া বন্ধুবান্ধবগণের শোকসাগর একেবারে উচ্ছলিত হইয়া উঠিল। দময়ন্তীও একবসন ধারণপূর্ব্বক স্বামীর অনুগামিনী হইলেন। রাজা পত্নী-সমভিব্যাহারে পুরপ্রান্তে ত্রিরাত্র অতিবাহিত করিলেন।
“এদিকে পুষ্কর নগর মধ্যে ঘোষণা করিয়া দিলেন, “যে ব্যক্তি নলের পক্ষ হইবে, আমি তাহার প্রাণদণ্ড করিব।” পুরবাসিগণ পুষ্করের দ্বেষদর্শন ও এই কথা শ্রবণমাত্র অতিমাত্র ভীত হইয়া রাজসৎকারে বিরত হইল, সুতরাং তিনি নগরোপকণ্ঠে থাকিয়া তিন দিবস কেবল জলাহারদ্বারা জীবনযাত্ৰা নির্ব্বাহ করিয়াছিলেন। এইরূপে ক্ষুৎপিপাসায় নিতান্ত ক্লান্ত হইয়া প্রত্যহ ফলমূল আহরণার্থ প্রস্থান করিতেন; দময়ন্তীও তাঁহার অনুগামিনী হইতেন।
পক্ষীরূপধারী কলিকর্ত্তৃক নলের বস্ত্ৰহরণ
“এই অবস্থায় বহুদিবস অতীত হইলে একদা ক্ষুধায় অত্যন্ত কাতর হইয়াছেন, এমন সময়ে কতকগুলি সুবর্ণচ্ছদ পক্ষী তাহার নেত্রপথে পতিত হইল। তদ্দর্শনে নিষধাধিপতি চিন্তা করিলেন, অদ্য ভাগ্যক্ৰমে আমার ভক্ষ্যদ্রব্য ও সম্পত্তি লাভ হইল।
“অনন্তর স্বীয় পরিধেয়-বসনদ্বারা পক্ষীদিগকে আবরণ করিলে তাহারা সেই বস্ত্ৰ লইয়া আকাশমার্গে উড্ডীন হইল। তখন আকাশপ্রস্থিত শকুন্তগণ [পক্ষিগণ] রাজাকে দিগম্বর, দীনহীন ও অধোন্মুখ নিরীক্ষণ করিয়া কহিল, “হে অবোধ বীরসেনসূত!! আমরা সেই অক্ষ; তুমি সবস্ত্ৰে প্ৰস্থান করিতেছ। দেখিয়া অসহমান হইয়া তোমার বস্ত্ৰহরণ করিবার মানসে পক্ষিরুপ ধারণ করিয়া আসিয়াছিলাম।” অনন্তর রাজা দময়ন্তীর সমীপে আপনার বিবস্ত্রত্ব ও পক্ষিরূপী অক্ষবৃত্তান্ত-সমুদয় বর্ণনা করিতে লাগিলেন, “হে ভীরু! যাহাদিগের কোপে আমি রাজ্যচ্যুত ও ক্ষুৎপিপাসায় নিতান্ত ক্লান্ত হইয়া অতিকষ্টে জীবনযাত্ৰানির্ব্বাহ করিতেছি, যাহাদিগের প্রভাবে নিষধবাসীরা আমার সম্মান করে নাই, সেই অক্ষ এক্ষণে পক্ষিরূপ ধারণ করিয়া আমার বস্ত্ৰহরণ করিল। এক্ষণে আমার চেতনা সাতিশয় দশাবৈষম্যবশতঃ দুঃখে বিনষ্টপ্ৰায় হইয়াছে; আমি তোমার ভর্ত্তা, অধুনা আমার নিকট আপন হিতবাক্য শ্ৰবণ করা।
“এই বহুসংখ্যক পন্থা অবন্তীনগর ও ঋক্ষবান পর্ব্বত অতিক্রম করিয়া দক্ষিণাভিমুখে প্রস্থিত হইয়াছে। এই গিরিবর বিন্ধ্যাচল, এই সমুদ্রগামী পয়োষ্ণী নদী প্রবাহিত হইতেছে এবং বিবিধ ফলাফুলে পরিপূর্ণ মহর্ষিগণের আশ্রম-সকল পরিদৃশ্যমান হইতেছে। এই পথ অবলম্বন করিয়া বিদর্ভদেশে উত্তীর্ণ হওয়া যায় এবং এই পথ কোশলাময় গান করিয়াছে, ইহার দক্ষিণভাগস্থিত দেশকে দক্ষিণাপথ বলে।” রাজা সমাহিত হইয়া অতি দুঃখিত— মনে দময়ন্তীকে উদ্দেশ করিয়া পুনঃ পুনঃ এই সকল কথা কহিতে লাগিলেন।
“তদনন্তর দময়ন্তী সাতিশয় দুঃখিত হইয়া বাষ্পাকুলালোচনে করুণ-বচনে রাজাকে কহিলেন, “মহারাজ! তোমার সঙ্কল্প বারংবার চিন্তা করিয়া আমার হৃদয় ব্যাকুল ও শরীর অবসন্ন হইতেছে; রাজ্য, সমস্ত ধনসম্পত্তি ও বস্ত্ৰ পৰ্য্যন্ত অপহৃত হইয়াছে এবং তুমি নিতান্ত শ্রান্ত ও একান্ত ক্ষুধার্ত্ত হইয়া চিন্তাসাগরে মগ্ন হইয়াছ; অতএব ঈদৃশ অবস্থায় নির্জ্জন বনস্থলীতে তোমাকে পরিত্যাগপূর্ব্বক আমি কিরূপে গমন করিব? যখন তুমি জনশূন্য অরণ্যে শ্ৰান্ত, ক্ষুধার্ত্ত ও ভূতপূর্ব্বসুখচিন্তায় উৎকণ্ঠিত হইবে, তখন আমি তোমার ক্লেশ নিবারণ করিব। হে জীবিতনাথ! আমি সত্য কহিতেছি, শাস্ত্রকারেরা কহিয়াছেন, সর্ব্বপ্রকার দুঃখে ভাৰ্য্যাই মহৌষধস্বরূপ; ভাৰ্য্যাসম ঔষধ আর কিছুই নাই।”
“নলরাজ কহিলেন, “প্রিয়ে! যথার্থ কহিয়াছ; দুঃখিত ব্যক্তির ভাৰ্য্যাই একমাত্ৰ মিত্র। আমি ত’ তোমাকে ত্যাগ করিবার মানস করি নাই; তুমি কি নিমিত্ত সহসা এরূপ শঙ্কিত হইতেছ? আমি বরং আত্মাকে পরিত্যাগ করিতে পারি, তথাপি তোমার বিরহে ক্ষণমাত্ৰও জীবিত থাকিতে পারি না।” দময়ন্তী কহিলেন, “নাথ! যদি আমাকে পরিত্যাগ করিবার বাসনা নাই, তবে কি নিমিত্ত বিদৰ্ভদেশের পথনির্দেশ করিলে? তুমি কদাচ আমাকে পরিত্যাগ করিবে না, ইহা নিশ্চয় জানিয়াও সুস্থির হইতে পারি না; কারণ, চিত্তের বৈপরীত্যপ্রযুক্ত আমাকে ত্যাগ করিলেও করিতে পার। বিশেষতঃ বারংবার পথনির্দেশ করাতে আমার শোকাবেগ প্রবল হইয়া উঠিয়াছে। অথবা আমার জ্ঞাতিবর্গের নিকট গমন করা যদি তোমার অভিপ্রায় হয়, তাহা হইলে আমরা উভয়েই একত্র হইয়া বিদৰ্ভনগরে গমন করিব। তথায় তুমি বিদর্ভরাজকর্ত্তৃক আদৃত ও সৎকৃত হইয়া আমাদিগের গৃহে পরমসুখে কালযাপন করিতে পরিবে।’ ”