৬০তম অধ্যায়
চারিবর্ণের সাধারণ-অসাধারণ ধর্ম্ম
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে জনমেজয়! অনন্তর ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির কৃতাঞ্জলিপুটে ভীষ্মকে অভিবাদনপূৰ্ব্বক পুনরায় জিজ্ঞাসা করিলেন, “পিতামহ! সর্ব্ববর্ণের সাধারণ ধর্ম্ম কি? চারিবর্ণের পৃথক পৃথক্ ধৰ্ম্ম কি? রাজধৰ্ম্ম কি? কোন্ বর্ণের লোক কোন আশ্রমগ্রহণে অধিকারী? রাজা এবং তাঁহার রাজ্য, পৌরবর্গ ও ভৃত্য কিরূপে পরিবর্দ্ধিত হয়? কিরূপে কোষ, দণ্ড, দুর্গ, সহায়, মন্ত্রী, ঋত্বিক[নিত্যনৈমিত্তিক ক্রিয়াকারী], পুরোহিত[বিশেষ বিশেষ যাগযজ্ঞাদিকারী] ও আচার্য্য পরিত্যাগ করা রাজার কৰ্ত্তব্য? বিপদ উপস্থিত হইলে কোন কোন ব্যক্তির উপর বিশ্বাস করা বিধেয় এবং কোন্ স্থলেই বা চিত্তস্থৈর্য্য আবশ্যক? তৎসমুদয় কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মনন্দন! আমি ধৰ্ম্ম, কৃষ্ণ এবং ব্রাহ্মণগণকে নমস্কার করিয়া শাশ্বত ধর্ম্মসমুদয় কীৰ্ত্তন করিতেছি শ্রবণ কর। ক্রোধপরিত্যাগ, সত্যবাক্যপ্রয়োগ, সম্যকরূপে ধনবিভাগ, ক্ষমা, স্বীয় পত্নীতে পুত্রোৎপাদন, পবিত্রতা, অহিংসা, সরলতা ও ভৃত্যের ভরণপোষণ এই নয়টি সবর্ণের সাধারণ ধৰ্ম্ম। এক্ষণে ব্রাহ্মণের ধর্ম্ম সবিশেষ কহিতেছি, শ্রবণ কর। ইন্দ্রিয়দমন ও বেদাধ্যয়নই ব্রাহ্মণের প্রধান ধর্ম্ম। শান্তস্বভাব জ্ঞানবান ব্রাহ্মণ যদি অসৎকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান পরিত্যাগপূর্ব্বক সৎপথে থাকিয়া ধনলাভ করিতে পারেন, তাহা হইলে দারপরিগ্রহপূর্ব্বক সন্তান উৎপাদন, দান ও যজ্ঞানুষ্ঠান করা তাঁহার অবশ্য কর্ত্তব্য। সাধু ব্যক্তিরা ধনবিভাগ করিয়া ভোগ করাই বিধেয় বলিয়া নির্দেশ করিয়াছেন। যাহা হউক, ব্রাহ্মণ অন্য কোন কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করুন বা না করুন, তিনি বেদাধ্যয়ননিরত ও সদাচারসম্পন্ন হইলেই ব্রাহ্মণ বলিয়া গণনীয় হয়েন।
“এক্ষণে ক্ষত্রিয়ের ধর্ম্ম কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। ধনদান, যজ্ঞানুষ্ঠান, অধ্যয়ন ও প্রজাপালনই ক্ষত্রিয়ের প্রধান ধর্ম্ম। যা, যাজন বা অধ্যাপন ক্ষত্রিয়ের পক্ষে নিতান্ত নিষিদ্ধ। নিয়ত দস্যুবধে উদ্যত হওয়া ও সমরাঙ্গনে পরাক্রম প্রকাশ করা ক্ষত্রিয়ের অবশ্য কর্ত্তব্য। যেসকল নরপতি যজ্ঞশীল, শাস্ত্রজ্ঞানসম্পন্ন ও সমরবিজয়ী হয়েন, তাঁহারাই লোকসমাজে শ্রেষ্ঠ বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকেন। যে ক্ষত্রিয় অক্ষতশরীরে সমরাঙ্গন হইতে প্রতিনিবৃত্ত হয়েন, পণ্ডিত ব্যক্তিরা কখনই তাঁহার প্রশংসা করেন না। দস্যুবিনাশ ব্যতীত ক্ষত্রিয়ের প্রধান কাৰ্য্য আর কিছুই নাই। দান, অধ্যয়ন ও যজ্ঞদ্বারাই রাজাদিগের মঙ্গললাভ হইয়া থাকে। অতএব ধর্ম্মার্থী নরপতির ধনলাভার্থে যুদ্ধ করা অবশ্য কর্ত্তব্য। রাজা প্রজাগণকে স্ব স্ব ধৰ্ম্মে অবস্থানপূর্ব্বক তাঁহারা যাহাতে শান্তভাবে ধৰ্ম্মানুষ্ঠান করে, তাহার চেষ্টা করেন। রাজা অন্য কোন কাৰ্য্য করুন বা না করুন, আচারনিষ্ঠ হইয়া প্রজাপালন করিলেই ক্ষত্রিয় বলিয়া পরিগণিত হইতে পারেন।
“এক্ষণে বৈশ্যের ধর্ম্ম কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। দান, অধ্যয়ন, যজ্ঞানুষ্ঠান, সদুপায় অবলম্বনপূর্ব্বক ধনসঞ্চয় এবং পুত্র নির্ব্বিশেষে পশুপালন করাই বৈশ্যের নিত্যধর্ম্ম। এতদ্ব্যতীত অন্য কোন কার্য্যের অনুষ্ঠান করিলে বৈশ্যকে অধর্ম্মে লিপ্ত হইতে হয়। ভগবান প্রজাপতি সমস্ত জগৎ সৃষ্টি করিয়া ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়কে মনুষ্যরক্ষা ও বৈশ্যদিগকে পশুপালনের ভার প্রদান করিয়াছেন; সুতরাং বৈশ্য পশুদিগকে প্রতিপালন করিলেই সুখী হইবে সন্দেহ নাই। বৈশ্যের কিরূপে জীবিকানির্ব্বাহ করা কর্ত্তব্য তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। বৈশ্য অন্যের ছয় ধেনুর রক্ষক হইলে একটির দুগ্ধ, শত ধেনুর রক্ষক হইলে সংবৎসরে একটি গোমিথুন, অন্যের ধন লইয়া বাণিজ্যে প্রবৃত্ত হইলে লব্ধধনের সপ্তম ভাগ এবং কৃষিকার্য্যে প্রবৃত্ত হইলে শস্যের সপ্তমাংশের একাংশ আপনার বেতনস্বরূপ গ্রহণ করিবে। পশুপালনবিষয়ে অনাস্থা প্রদর্শন করা বৈশ্যের নিতান্ত অকৰ্তব্য; আর বৈশ্য পশুপালনের ইচ্ছা প্রকাশ করিলে উহাতে অন্যের হস্তক্ষেপ করিবার অধিকার নাই।
“অতঃপর শূদ্রের ধর্ম্ম কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। ভগবান্ প্রজাপতি ব্রাহ্মণাদি বর্ণত্রয়ের দাস হইবে বলিয়া শূদ্রের সৃষ্টি করিয়াছেন; অতএব তিনবর্ণের পরিচর্য্যা করাই শুদ্রের প্রধান ধৰ্ম্ম। ঐ ধর্ম্ম প্রতিপালন করিলেই শুদ্রের পরম সুখলাভ হয়। শূদ্র অর্থসঞ্চয় করিলে ব্রাহ্মণ প্রভৃতি উৎকৃষ্ট জাতি তাহার বশীভূত হইতে পারেন এবং তন্নিবন্ধন তাহাকে পাপগ্রস্ত হইতে হয়; অতএব ভোগাভিলাষে তাহার অর্থসঞ্চয় করা, অতিশয় নিষিদ্ধ; কিন্তু রাজার আদেশানুসারে ধৰ্ম্মকাৰ্য্যের অনুষ্ঠানার্থ অর্থসঞ্চয় করা শুদ্রের অবিহিত নহে। এক্ষণে শুদ্রের ব্যবহার ও জীবিকার বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। বর্ণচতুষ্টয়ের মধ্যে শুদ্রকে ভরণপোষণ এবং ছত্র, বেষ্টন[গাত্রবস্ত্র], শয়ন[শয্যা], আসন, উপানৎযুগল[এক জোড়া জুতা], চামর ও বস্ত্রসকল প্রদান করা অবশ্য কর্ত্তব্য। এ সমুদয় দ্রব্য শুদ্রের ধৰ্ম্মলব্ধ ধন। ধার্মিকেরা কহিয়া থাকেন, শূদ্র শুশ্রূষার্থী হইয়া কোন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় বা বৈশ্যের নিকট আগমন করিলে তাহাকে উহার জীবিকা নির্দিষ্ট করিতে হইবে। শূদ্র পরিচারক পুত্রহীন হইলে, তাহার পিণ্ডদান এবং বৃদ্ধ ও দুর্বল হইলে তাহার ভরণপোষণ করা প্রভুর অবশ্য কর্ত্তব্য। বিপৎকালে প্রভুকে পরিত্যাগ করা শুদ্রের কোনক্রমে কর্ত্তব্য নহে। যদি প্রভুর ধনঞ্জয় হয়, তাহা হইলে শূদ্র আপনার পরিবারবর্গের ভরণপোষণাতিরিক্ত ধনদ্বারা তাহাকে প্রতিপালন করিবে। শূদ্রের অর্থসঞ্চয় করিবার অধিকার নাই, তাহার যে ধন উদ্বৃত্ত হইবে, প্রভু তাহা গ্রহণ করিবে। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় প্রভৃতি বর্ণত্রয়ের যেসমস্ত যজ্ঞ কীৰ্ত্তন করিয়াছি, সেই সমুদয় যজ্ঞে শূদ্রেরও অধিকার আছে, কিন্তু স্বাহাকার ও বষট্কার মন্ত্রে উহার অধিকার নাই। অতএব শূদ্র স্বয়ং ব্রতী না হইয়া বৈশ্বদেব ও গ্রহশান্তি প্রভৃতি ক্ষুদ্র যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিতে পারিবে। ঐ যজ্ঞের দক্ষিণ পূর্ণপাত্র। এইরূপ কিংবদন্তী আছে, পৈজবননামে এক শূদ্র অমন্ত্রক ঐন্দ্রাগ্নিবিধি অনুসারে একলক্ষ পূর্ণপাত্র [২৯২ মুষ্টি—প্রায় সাড়ে তের সের চাউলের ভোজ্য] দক্ষিণা প্রদান করিয়াছিল।
“সমুদয় যজ্ঞমধ্যে সর্বাগ্রে শ্রদ্ধাযজ্ঞের অনুষ্ঠান করা কর্ত্তব্য। শ্রদ্ধা মহৎ দেবতাস্বরূপ। উহা যাজ্ঞিকদিগের পবিত্রতা সম্পাদন করিয়া থাকে। ব্রাহ্মণগণ পরস্পর পরস্পরের পরমদেবতাস্বরূপ। তাঁহারা বিবিধ মনোরথ সফল করিবার মানসে নানাপ্রকার যজ্ঞের অনুষ্ঠান ও সকলকেই হিতকর উপদেশ প্রদান করেন, এই নিমিত্ত তাঁহারা দেবগণেরও দেবতা বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকেন। ব্রাহ্মণ হইতে ক্ষত্রিয় প্রভৃতি বর্ণত্রয় উৎপন্ন হইয়াছে। ঋক্, যজুঃ ও সামবেদবেত্তা ব্রাহ্মণ দেবতার ন্যায় সকলেরই পূজ্য। আর যে ব্রাহ্মণ বেদবিহীন, তিনি ব্রহ্মার উপদ্রবস্বরূপ। মানসযজ্ঞে সকল বর্ণেরই অধিকার আছে। শ্রদ্ধাপূৰ্ব্বক যজ্ঞানুষ্ঠান করিলে দেবতা ও অন্যান্য প্রাণীগণ সকলেই উহার অংশগ্রহণে অভিলাষী হইয়া থাকেন; অতএব চারিবর্ণমধ্যে শ্রদ্ধাযজ্ঞের অনুষ্ঠান করা অতি কৰ্ত্তব্য। ব্রাহ্মণ বর্ণত্রয়েরই যজ্ঞসাধন করিয়া থাকেন। ব্রাহ্মণ বৈশ্যসংসর্গী হইলেও তাঁহার বর্ণত্রয়ের যজ্ঞসাধনে সম্পূর্ণ অধিকার আছে। ফলতঃ ব্রাহ্মণ ব্ৰহ্মণ্যদেবস্বরূপ। আর যখন ক্ষত্রিয় প্রভৃতি বর্ণত্রয় ব্রাহ্মণ হইতে উৎপন্ন হইয়াছে, তখন ঐ তিনবর্ণ ব্রাহ্মণের জ্ঞাতিস্বরূপ। তত্ত্বনির্ণয় করিতে হইলে ঋক্, যজুঃ ও সামবেদের প্রচার নিমিত্ত অগ্রে ব্রাহ্মণের সৃষ্টি হইয়াছে, ইহা প্রতিপন্ন হইয়া থাকে।
“বানপ্রস্থাশ্রমী মহর্ষিগণের যজ্ঞানুষ্ঠানে অভিলাষ হইলে পুরাবিৎ পণ্ডিতেরা যেরূপ কহিয়াছিলেন, শ্রবণ কর। জিতেন্দ্রিয় ব্রাহ্মণ সূর্য্যোদয়ের পূর্বে বা পরে শ্রদ্ধা ও ধর্ম্মানুসারে হুতাশনে আহুতি প্রদান করিবেন। শ্রদ্ধাই প্রধান যজ্ঞ। যজ্ঞ নানাপ্রকার ও যজ্ঞের ফলও অসংখ্য। যে ব্রাহ্মণ জ্ঞানবলে তৎসমুদয় বিদিত ও শ্রদ্ধান্বিত হইতে পারেন, তিনিই যজ্ঞানুষ্ঠানের উপযুক্ত পাত্র। লোকে চৌর্য্য প্রভৃতি পাপকাৰ্য্যে আসক্ত হইয়াও যদি যজ্ঞানুষ্ঠান করে, তাহা হইলেও তাহাকে সাধু বলিয়া নির্দেশ করা যাইতে পারে এবং মহর্ষিগণও প্রশংসা করিয়া থাকেন। হে ধৰ্ম্মরাজ! এক্ষণে ইহার স্থির-সিদ্ধান্ত হইল যে, সকল বর্ণই সর্ব্বপ্রকার যজ্ঞের অনুষ্ঠান করিতে পারেন। ত্রিলোকমধ্যে যজ্ঞের তুল্য আর কিছুই নাই। অতএব অসূয়াশূন্য হইয়া পরমশ্রদ্ধাসহকারে সাধ্যানুরূপ যজ্ঞানুষ্ঠান করিবে।”