৫ম অধ্যায়
সংসারাসক্তির স্বরূপ নির্দেশ
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে বিদুর! যে বুদ্ধিপ্রভাবে ধর্ম্মগহনে প্রবেশ করা যায়, সেই বুদ্ধির বিষয় সবিস্তর কীৰ্ত্তন কর।”
বিদুর কহিলেন, “মহারাজ! আমি ভগবান্ ব্রহ্মাকে নমস্কার করিয়া আপনার আদেশানুরূপ কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ করুন। মহর্ষিগণ সংসারকে বনস্বরূপ বলিয়া নির্দেশ করেন। পূর্বে এক ব্রাহ্মণ ভ্রমণ করিতে করিতে এক দুর্গম অরণ্যে প্রবেশ করিয়াছিলেন। ঐ বন সিংহ, ব্যাঘ্র, গজ ও নিশাচরগণে সমাকীর্ণ ও ভীষণ শব্দে পরিপূরিত। উহা এরূপ ভয়ানক যে, দর্শন করিবামাত্র কৃতান্তকেও একান্ত ভীত হইতে হয়। সেই ভীষণ অরণ্য দর্শন করিয়া দ্বিজবরের অন্তঃকরণ নিতান্ত উদ্বিগ্ন ও সর্ব্বশরীর রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিল। তখন তিনি ‘কাহার শরণাপন্ন হইব’ এই ভাবিয়া দশদিক নিরীক্ষণ করিতে করিতে প্রাণভয়ে ধাবমান হইলেন। কিন্তু কোনক্রমেই সেই বনচরদিগকে অতিক্রম করিতে সমর্থ হইলেন না। পরিশেষে তিনি পৰ্য্যটন করিতে করিতে দেখিলেন যে, ঐ ভীষণ কানন বন্ধনজালে সমাবৃত ও শৈলের ন্যায় সমুন্নত পঞ্চশীর্ষ নাগগণে সমাকীর্ণ। এক বৃহৎকায় কামিনী বাহুদ্বয়দ্বারা ঐ অরণ্য আক্রমণ করিয়া রহিয়াছে। ঐ কাননে সুদৃঢ় তৃণলতাদিমণ্ডিত একটা বৃহৎ কূপ বিদ্যমান ছিল। দ্বিজবর ভ্রমণ করিতে করিতে সেই লতাবিতানজড়িত গভীর কূপে নিপতিত ও লতাজালে লগ্ন হইয়া ঊৰ্দ্ধপাদে অধোমস্তকে বৃন্তসংলগ্ন[বোঁটাযুক্ত] পনস[কাঁটাল]ফলের ন্যায় লম্বমান রহিলেন। ব্রাহ্মণ যে কূপমধ্যে লম্বমান হইয়াই নিষ্কৃতি লাভ করিলেন, এমন নহে, ঐ স্থানেও তাঁহার অন্য এক উপদ্রব উপস্থিত হইল। তিনি তথায় সেই অবস্থায় অবস্থানপূর্ব্বক দেখিলেন যে, একটা মহাসর্প ঐ কূপের অধোভাগে অবস্থিত রহিয়াছে এবং একটা ষড়বক্ত্র[ছয় মুখ] দ্বাদশচরণ কৃষ্ণবর্ণ মদমত্তমাতঙ্গ ক্রমে ক্রমে ঐ কূপমুখস্থিত বৃক্ষের সমীপে আগমন করিতেছে। ঐ বৃক্ষের প্রশাখায় নানারূপধারী ভয়ঙ্কর মধুকরগণ মধুক্রম আবৃত করিয়া নিরন্তর প্রাণীগণের প্রার্থনীয় ব্রহ্মারও লোভনীয় অতি উপাদেয় মধু পান করিবার চেষ্টা করিতেছে এবং কতকগুলি কৃষ্ণসর্প ও শ্বেতবর্ণ মূষিক দশনদ্বারা ঐ পাদপচ্ছেদনে [বৃক্ষকৰ্ত্তনে] প্রবৃত্ত হইয়াছে। হে মহারাজ! সেই বৃক্ষশাখা হইতে অনবরত মধুধারা নিঃসৃত হইতেছিল। ব্রাহ্মণ ঐ সঙ্কটসময়েও সতত সেই মধুধারা পান করিতে লাগিলেন; কিন্তু কিছুতেই তৃপ্তিলাভে সমর্থ হইলেন না; বরং উত্তরোত্তর তাঁহার অধিক লাভের প্রত্যাশা বলবতী হইতে লাগিল। তখন ঐ অবস্থাতেও তাঁহার জীবনে কিছুমাত্র নির্বেদ উপস্থিত হইল না। হে মহারাজ! ঐ অরণ্যে প্রথমতঃ হিংস্র জন্তুগণ, দ্বিতীয়তঃ সেই ঘোররূপা কামিনী, তৃতীয়তঃ কূপের অধঃস্থিত মহাসর্প, চতুর্থতঃ কূপমুখস্থ বৃক্ষাভিমুখে ধাবমান মত্তমাতঙ্গ, পঞ্চমতঃ মূষিকদশনচ্ছিন্ন বৃক্ষের পতন ও ষষ্ঠতঃ মধুলুব্ধ মধুকরগণ হইতে বিষম শঙ্কা বিদ্যমান রহিয়াছে। কিন্তু ব্রাহ্মণ স্বচ্ছন্দে সেই অরণ্যে কূপমধ্যে সেই অবস্থায় অবস্থান করিতে লাগিলেন, কোনক্রমেই জীবিতাশা পরিত্যাগ করিতে পারিলেন না।”