মরুত্তের পৌরোহিত্যে বৃহস্পতিকে অনুরোধ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “ভগবন্! মহীপতি মরুত্ত কিরূপ পরাক্রমশালী ছিলেন? কি প্রকারে তাঁহার প্রভূত সুবর্ণলাভ হইল? এক্ষণেই বা সেই সুবর্ণরাশি কোন্ স্থানে নিপতিত হইয়াছে? আর কিরূপেই বা তাহা আমাদিগের হস্তগত হইবে, আপনি তৎসমুদয় কীৰ্ত্তন করুন।”
তখন মহর্ষি বেদব্যাস যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! দেবতা ও অসুরগণ যেমন উভয়পক্ষই প্রজাপতি দক্ষের দৌহিত্র হইয়াও পরস্পর পরস্পরের প্রতি স্পর্দ্ধা করেন, তদ্রূপ মহাতেজস্বী বৃহস্পতি ও তপোধন সংবৰ্ত্ত ইঁহারা উভয়েই অঙ্গিরার পুত্র হইয়াও পরস্পর পরস্পরের প্রতি স্পর্দ্ধা করিতেন। কিয়দ্দিন পরে বৃহস্পতি, বিদ্বেষবশতঃ বারংবার সংবৰ্ত্তকে নিপীড়িত করিতে আরম্ভ করিলে সংবৰ্ত্ত বিষয়স্পৃহা পরিত্যাগপূৰ্ব্বক দিগম্বর বেশে অরণ্যে গমন করিলেন। ঐ সময় দেবরাজ ইন্দ্র অসুরগণকে পরাজিত করিয়া ত্রিলোকের অধিপতি হইয়া বৃহস্পতিকে পৌরোহিত্যকার্য্যে নিযুক্ত করিয়াছিলেন কুলপুরোহিত ছিলেন। এই ভূমণ্ডলমধ্যে করন্ধমের তুল্য বলবান ও সদ্ব্যবহারসম্পন্ন আর কেহই ছিল না। তিনি ধার্ম্মিক, ব্রতপরায়ণ ও ইন্দ্রের তুল্য পরাক্রমশালী ছিলেন। তাঁহার ধ্যানবল ও মুখমারুতপ্রভাবে উৎকৃষ্ট বাহন, যোদ্ধা, নানাবিধ বন্ধু ও মহার্হ শয়নীয় সমুৎপন্ন হইয়াছিল। তিনি স্বীয় অসাধারণ গুণরাশিদ্বারা অন্যান্য সমুদয় নরপতিকে বশীভূত করিয়া আপনার অভিলাষানুরূপ দীর্ঘকাল জীবিত থাকিয়া পরিশেষে সশরীরে স্বর্গলাভ করেন। তাঁহার পুত্র অবিক্ষিৎ মহাবলপরাক্রান্ত যাতির ন্যায় ধার্ম্মিক এবং পিতার ন্যায় বিক্রম ও সদ্গুণশালী হইয়া বসুন্ধরাকে স্ববশে সমানীত করিয়াছিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত মরুত্তরাজা সেই অবিক্ষিৎ নরপতির পুত্র। সসাগরা পৃথিবী মরুত্তের প্রতি একান্ত অনুরক্ত হইয়াছিলেন।
মরুত্ত-পৌরোহিত্যে ইন্দ্রের বাধাদান
“ঐ মহীপাল দেবরাজ ইন্দ্রের সহিত প্রতিনিয়ত স্পর্দ্ধা করিতেন। দেবরাজ ইন্দ্র যত্নবান্ হইয়াও তাঁহাকে অতিক্রম করিতে পারেন নাই। পরিশেষে সুররাজ মরুত্তকে অতিক্রম করিবার মানসে বৃহস্পতিকে আহ্বান করিয়া দেবগণসমক্ষে তাঁহাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “ভগবন্! যদি আপনি আমার প্রিয়চিকীর্ষ হন, তাহা হইলে কখনই মরুরাজার পৌরোহিত্য কাৰ্য্য স্বীকার করিতে পারিবেন না। আমি ত্রিলোকের অধীশ্বর। কিন্তু মরুত্ত কেবল মর্ত্যলোকের অধিপতি। অতএব আপনি মৃত্যুবিহীন সুরগণের যাজক হইয়া কিরূপে মৃত্যুর বশবর্ত্তী মরুক্তরাজার যাজনক্রিয়া সম্পাদন করিবেন? যাহা হউক, যদি আপনি মরুত্তের পৌরোহিত্য স্বীকার করেন, তাহা হইলে আপনাকে আমার পৌরোহিত্য পরিত্যাগ করিতে হইবে। অতএব এক্ষণে আপনি হয় মরুত্তকে পরিত্যাগ করিয়া আমার, না হয় আমাকে পরিত্যাগ করিয়া মরুত্তের পুরোহিত হউন।’
“দেবরাজ ইন্দ্র এই কথা কহিলে বৃহস্পতি ক্ষণকাল চিন্তা করিয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, “দেবেন্দ্র! তুমি জীবগণের অধিপতি। সমুদয় লোকই তোমাতে প্রতিষ্ঠিত রহিয়াছে। তুমি নমুচি, বিশ্বরূপ ও বলদৈত্যের নিহন্তা। তোমা হইতেই দৈত্যগণের দর্পচুর্ণ হইয়াছে। তুমি সর্ব্বদা স্বর্গ ও মর্ত্যলোকের ভরণপোষণ করিতেছ; অতএব তোমার পৌরোহিত্য সম্পাদন করিয়া কিরূপে মর্ত্যলোকস্থিত মরুত্তের যাজনক্রিয়া স্বীকার করিব? এক্ষণে আমি তোমার নিকট প্রতিজ্ঞা করিয়া কহিতেছি যে, আমি কদাচ মনুষ্যের যজ্ঞকার্য্যের স্রুব গ্রহণ করিব না। যদি অনল শীতল, পৃথিবী পরিবর্ত্তিত ও সূৰ্য্য প্রভারহিত হয়েন, তথাপি আমার বাক্য মিথ্যা হইবে না।’
“সুরগুরু বৃহস্পতি এই কথা কহিলে দেবরাজ ইন্দ্র তাঁহার বাক্যশ্রবণে পরম পরিতুষ্ট হইয়া স্বভবনে প্রবেশ করিলেন।”