৫৯তম অধ্যায়
‘রাজা’ পদের উৎপত্তি নিদান-সার্থকতা
বৈশম্পায়ন কহিলেন, পরদিন প্রাতঃকালে পঞ্চপাণ্ডব ও কৃষ্ণ প্রভৃতি মহাত্মারা গাত্রোত্থানপূৰ্ব্বক পূর্ব্বাহ্নিককৃত্য সমাধান করিয়া নগরাকার প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড রথে আরোহণপূর্ব্বক কুরুক্ষেত্রে যাত্রা করিলেন এবং অচিরাৎ তথায় সমুপস্থিত হইয়া নিস্পাপ ভীষ্মদেবকে রাত্রির কুশলবাৰ্ত্তা জিজ্ঞাসা ও বেদব্যাস প্রভৃতি মহর্ষিগণের চরণবন্দনপূৰ্ব্বক আনন্দিতমনে শান্তনুতনয়ের চতুর্দ্দিকে উপবিষ্ট হইলেন। তখন মহাতেজাঃ ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ভীষ্মকে যথাবিধি পূজা করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, “পিতামহ! ‘রাজা’ এই শব্দটি কিরূপে সমুৎপন্ন হইল? রাজার হস্ত, গ্রীবা, পৃষ্ঠ, মুখ, উদর, শুক্র, অস্থি, মজ্জা, মাংস, শোণিত, নিশ্বাস, উচ্ছ্বাস, প্রাণ, শরীর, বুদ্ধি, ইন্দ্রিয়, সুখ, দুঃখ, জন্ম ও মরণ যেরূপ, প্রজাগণেরও তদ্রূপ। তবে রাজা কিরূপে একাকী অসংখ্য বিশিষ্টবুদ্ধি মহাবলপরাক্রান্ত পুরুষের উপর আধিপত্য করিয়া সমুদয় পৃথিবী পালন করিতে সমর্থ হয়েন? সকল লোকে কি নিমিত্ত রাজার প্রসাদলাভের আকাঙ্ক্ষা করে এবং তিনি প্রসন্ন হইলে সকলেই প্রসন্ন ও তাঁহার বিপদে সকলেই বিপদগ্রস্ত হয়, আমি এই সমুদয় কথা শ্রবণ করিতে বাঞ্ছা করি; অতএব আপনি উহা সবিস্তারে কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! সত্যযুগে প্রথমে যেরূপে রাজত্বের সৃষ্টি হয়, তাহা অবহিত হইয়া শ্রবণ কর। সৰ্ব্বপ্রথমে পৃথিবীতে রাজ্য, রাজা, দণ্ড বা দণ্ডাৰ্থ ব্যক্তি কিছুই ছিল না। মনুষ্যেরা একমাত্র ধর্ম্ম অবলম্বনপূৰ্ব্বক পরস্পরকে রক্ষা করিত। মানবগণ এইরূপে কিছুদিন কালযাপন করিয়া পরিশেষে পরস্পরের রক্ষণাবেক্ষণ নিতান্ত কষ্টকর বোধ করিতে লাগিল। ঐ সময় মোহ তাহাদিগের মনোমন্দিরে প্রবিষ্ট হইল। মোহের আবির্ভাববশতঃ ক্রমশঃ জ্ঞান ও ধর্ম্মের লোপ হইতে লাগিল এবং মানবগণ ক্রমে ক্রমে লোভপরতন্ত্র, পরধনগ্রহণতৎপর, কামপরায়ণ, বিষয়াসক্ত ও কার্য্যাকার্য্যবিবেকশূন্য হইয়া উঠিল। অগম্যাগমন, বাচ্যাবাচ্য, ভক্ষাভক্ষ্য ও দোষাদোষের বিচার কিছুমাত্র রহিল না। নরলোক এইরূপে কুমার্গগামী হইলে বেদ বিনষ্ট ও ধৰ্ম্ম এককালে বিলুপ্ত হইয়া গেল।
“তখন দেবগণ নিতান্ত শঙ্কিতচিত্তে লোকপিতামহ ভগবান ব্রহ্মার শরণাপন্ন হইয়া তাঁহাকে প্রসন্ন করিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, “ভগবন্! লোভমোহাদি নীচবৃত্তিসমুদয় নরলোকস্থ সনাতন বেদ গ্রাস করাতে আমরা ভীত হইয়াছি। বেদ ধ্বংস হওয়াতে ধর্ম্মও বিনষ্ট হইয়াছে। অতঃপর আমরা মনুষ্যের ন্যায় অবস্থা প্রাপ্ত হইলাম। মানবগণ হোমাদি কাৰ্য্যদ্বারা উৰ্দ্ধবর্ষী [দেবগণ উদ্দেশে ভূতল হইতে আকাশপথে হোমাহুতি প্রেরণকারী] বলিয়া বিখ্যাত ছিল এবং আমরা বারিবর্ষণাদিদ্বারা অধোবর্ষী [আকাশ হইতে ভূতলে হোমফলস্বরূপ বৃষ্টিবর্ষণকারী] বলিয়া প্রসিদ্ধ ছিলাম; কিন্তু এক্ষণে মানবদিগের ক্রিয়াকলাপ উচ্ছিন্ন হওয়াতে আমাদিগের অন্নাভাব হইয়াছে। অতএব যাহাতে আপনার প্রভাবসম্ভূত এই প্রাকৃতিক নিয়ম ধ্বংস না হয়, আপনি স্বীয় বুদ্ধিপ্রভাবে তাহার সদুপায় উদ্ভাবন করুন।
“তখন ভগবান্ কমলযোনি সুরগণকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘হে দেবগণ! তোমরা ভীত হইও না; আমি অচিরাৎ উহার উপায় চিন্তা করিতেছি।’ প্রজাপতি দেবগণকে এই কথা বলিয়া বুদ্ধিবলে একখানি লক্ষ অধ্যায়যুক্ত নীতিশাস্ত্র রচনা করিলেন। ঐ নীতিশাস্ত্রে ধর্ম্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ এবং মোক্ষের সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ [ধর্ম্ম, অর্থ ও কাম বিস্তাররূপে বর্ণনপূৰ্ব্বক উহাকে ত্রিবর্গ নামে অভিহিত করিলেন। ঐ ত্রিবর্গের বিপরীত ফলদায়ক পৃথকগুণবিশিষ্ট চতুর্থ মোক্ষ নামক আর এক বর্গ উহার সহিত মিলিত করিলেন। এই মোক্ষেরই সকাম কৰ্ম্মভেদে সত্ত্ব, রজঃ ও তমো রূপ ত্রিবর্গ এবং নিষ্কামভেদে অতিরিক্ত মোক্ষবর্গ নির্দিষ্ট হইল।] নামে বর্গ; বৃদ্ধি, ক্ষয় ও সমানত্ব[তাপসগণের বৃদ্ধি, তস্করগণের ক্ষয় এবং বণিকগণের সাম্য]নামে দণ্ডজ ত্রিবর্গ; চিত্ত, দেশ, কাল, উপায়, কাৰ্য্য ও সাহায্যাখ্য [দুঃখিত চিত্ত প্রসন্ন করা, কুদেশকে সুদেশে পরিণত করা, পাপময় কালকে পুণ্যময় করা, জীবিকার উপায়, লেখাপড়া শিক্ষার ব্যবস্থা, উপযুক্ত কার্য্যপ্রদান ও সাহায্য ব্যবস্থা।] নীতিজ ষড়্বর্গ; কর্ম্মকাণ্ড, জ্ঞানকাণ্ড, কৃষিবাণিজ্যাদি জীবিকাকাণ্ড, দণ্ডনীতি, অমাত্যরক্ষাৰ্থ নিযুক্ত চর ও গুপ্তচরগণের বিষয়, রাজপুত্রের লক্ষণ, চরগণের বিবিধোপায়, সাম, দান, ভেদ, দণ্ড, উপেক্ষা, ভেদকারণ মন্ত্রণা ও বিভ্রম, মন্ত্রসিদ্ধি ও অসিদ্ধির ফল, ভয়, সৎকার ও বিত্তগ্রহণার্থ, অধম, মধ্যম ও উত্তম এই তিনপ্রকার সন্ধি, চতুর্ব্বিধ যাত্রাকাল, ত্রিবর্গের বিস্তার, ধৰ্ম্মযুক্ত বিজয়, অর্থদ্বারা বিজয় ও আসুরিক বিজয়, অমাত্য, রাষ্ট্র, দুর্গ, বল ও কোষ এই পঞ্চবর্গের ত্রিবিধ লক্ষণ, প্রকাশ্য সেনার বিষয়, অষ্টবিধ গৃঢ়বিষয় প্রকাশ, হস্তী, অশ্ব, রথ, পদাতি, ভারবহ, চর, পোত ও উপদেষ্টা এই অষ্টবিধ সেনাঙ্গ, বস্ত্রাদি ও অন্নাদিতে বিষযোগ, অভিচার, অরি, মিত্র ও উদাসীনের বিষয়, পথগমনের গ্রহনক্ষত্রাদিজনিত সমগ্ৰ গুণ, আত্মরক্ষা, আশ্বাস, রথাদি নির্ম্মাণের অনুসন্ধান, মনুষ্য, হস্তী, অশ্ব ও রথসজ্জার উপায়, বিবিধ ব্যূহ, বিচিত্র যুদ্ধকৌশল, ধূমকেতু প্রভৃতি গ্রহগণের উৎপাত, উল্কাদির নিপাত, সুপ্রণালীক্রমে যুদ্ধ, পলায়ন, অস্ত্রশস্ত্রের শাণপ্রদান, অস্ত্রজ্ঞান, সৈন্যব্যসনমোচন[শত্ৰুকৃত বিপদ হইতে সৈন্যগণের মুক্তি], সৈন্যের হর্ষোৎপাদন, পীড়া, আপদকাল, পদাতিজ্ঞান[সেনা-পরিচয়], খাত-খনন[পরিখা-খনন—বর্ত্তমান য়ুরোপ-যুদ্ধের ট্রেঞ্চ], পতাকাদি প্রদর্শনপূৰ্ব্বক শত্রুর অন্তঃকরণে ভয়সঞ্চারণ, চৌর, উগ্ৰস্বভাব, অরণ্যবাসী, অগ্নিদাতা, বিষপ্রযোক্তা, প্রতিরূপকারী[কৃত্রিম-চিত্রাদি প্রদর্শনে কার্য্যোদ্ধারকারী] প্রধান ব্যক্তির ভেদ, বৃক্ষচ্ছেদন, মন্ত্রতন্ত্রাদিপ্রভাবে হস্তীদিগের বলহ্রাস, শঙ্কা উৎপাদন এবং অনুরক্ত ব্যক্তির আরাধন ও বিশ্বাসজননদ্বারা পররাষ্ট্রে পীড়া প্রদান, সপ্তাঙ্গ রাজ্যের হ্রাস, বৃদ্ধি ও সমতা, কাৰ্য্যসামর্থ্য, কার্য্যের উপায়, রাষ্ট্রবৃদ্ধি, শথ্রুমধ্যস্থিত মিত্রের সংগ্রহ, বলবানের পীড়ন ও বিনাশসাধন, সূক্ষ্মব্যবহার, খলের উন্মূলন, ব্যায়াম, দান, দ্রব্যসংগ্রহণ, অভৃত [জীবিকা-হীন] ব্যক্তির ভরণপোষণ, ভৃত্য ব্যক্তির পর্য্যবেক্ষণ, যথাকালে অর্থদান, ব্যসনে অনাসক্তি, ভূপতির গুণ, সেনাপতির গুণ, ত্রিবর্গের কারণ ও গুণ, দোষ, অসৎ অভিসন্ধি, অনুগতদিগের ব্যবহার, সকলের প্রতি শঙ্কা, অনবধানতা পরিহার, অলব্ধ বস্তুর বৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধ ধনের বিধানানুসারে সৎপাত্রে দান, ধর্ম্ম, অর্থ, কাম এবং ব্যসন বিনাশের নিমিত্ত অর্থদান; মৃগয়া, অক্ষক্রীড়া, সুরাপান, স্ত্রীসম্ভোগ, এই চারিপ্রকার কামজ আর বাক্পারুষ্য [বাক্যে নিষ্ঠুরতা], উগ্রতা, দণ্ডপারুষ্য [দণ্ডদানে নিষ্ঠুরতা], নিগ্রহ, আত্মত্যাগ ও অর্থদূষণ, এই ছয়প্রকার ক্রোধজ সমুদয়ে দশপ্রকার ব্যসন, বিবিধ যন্ত্র ও যন্ত্রকাৰ্য্য, চিহ্নবিলোপ, চৈত্যচ্ছেদন [সীমাবৃক্ষের কৰ্ত্তন], অবরোধ, কৃষাদি কার্য্যের অনুশাসন, নানাপ্রকার উপকরণ, যুদ্ধযাত্রা, যুদ্ধোপায়, পণব, আনক, শঙ্খ, ভেরী, দ্রব্যোপার্জ্জন, ছয়প্রকার[মণি, পশু, ভূমি, দুর্গাদি, দাসদাসী, সুবর্ণ] দ্রব্য, লব্ধরাজ্যে শান্তিস্থাপন, সাধুলোকের পূজা, বিদ্বান্ ব্যক্তিদিগের আত্মীয়তা, দান, ও হোমের পরিজ্ঞান [অভিজ্ঞতা], মাঙ্গল্যবস্তুর স্পর্শ, শরীর-সংস্কার, আহার, আস্তিকতা, এক পথ অবলম্বনপূৰ্ব্বক অভ্যুদয়লাভ, সত্য, মধুরবাক্য, সামাজিক উৎসব, গৃহকাৰ্য্য, চত্বরাদিস্থানের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ব্যবহারের অনুসন্ধান[উঠান প্রভৃতি স্থানে জড় হইয়া কে কিরূপ রাজনীতির আলোচনা করে, তৎপ্রতি লক্ষ্য], ব্রাহ্মণের অদণ্ডনীয়তা, যুক্তি অনুসারে দণ্ডবিধান, অনুজীবিগণের মধ্যে জাতি ও গুণগত পক্ষপাত, পৌরজনের রক্ষাবিধান, দ্বাদশ রাজ মণ্ডলবিষয়ক চিন্তা[জয়শীল প্রতিপক্ষের প্রতিকুলে চতুর্দিকে নিযোক্তব্য—প্রত্যেক দিকে ৩টি করিয়া কপট শত্রু, কপট মিত্র ও কপট উদাসীন], দ্বিসপ্ততি প্রকার শারীরিক প্রতিকার[শৌচ, তৈলাদি মাখা ও স্নানাদি ৭২ রকমের আয়ুৰ্ব্বেদোক্ত বিধান], দেশ, জাতি ও কুলের ধৰ্ম্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ, উপায়, অর্থস্পৃহা, কৃষ্যাদি মূলকার্য্যের প্রণালী, মায়াযোগ, নৌকানিমজ্জনাদিদ্বারা নদীর পথরোধ এবং যে যে উপায়দ্বারা লোকসকল স্ব স্ব ধৰ্ম্মে ব্যবস্থিত থাকে, তাহার বিষয় সবিশেষ কীৰ্ত্তিত হইয়াছে।
কালভেদে নীতিশাস্ত্রের সংহিতা-প্রণয়ন
“ভগবান্ পদ্মযোনি ঐ নীতিশাস্ত্র প্রণীত করিয়া ইন্দ্র প্রভৃতি দেবগণকে হৃষ্টমনে কহিলেন, “সুরগণ! আমি ত্রিবর্গসংস্থাপন ও লোকের উপকারসাধনের নিমিত্ত বাক্যের সারস্বরূপ এই নীতিশাস্ত্র উদ্ভাবন করিয়াছি। ইহা পাঠ করিলে নিগ্রহ ও অনুগ্রহ দর্শনপূর্ব্বক লোকরক্ষা করিবার বুদ্ধি জন্মিবে। এই শাস্ত্ৰদ্বারা জগতের যাবতীয় লোক দণ্ডপ্রভাবে পুরুষার্থলাভে সমর্থ হইবে; অতএব ইহার নাম দণ্ডনীতি হইল। এই নীতিসার শাস্ত্র মহাত্মাদিগের আদরণীয় হইবে। ধৰ্ম্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষের বিষয় ইহাতে সবিশেষ কীৰ্ত্তিত হইয়াছে।
“হে মহারাজ! মহাত্মা কমলযোনি ঐরূপে সেই লক্ষাধ্যায়যুক্ত নীতিশাস্ত্র প্রণীত করিলে বহুরূপধারী বিশালাক্ষ ভগবান ভবানীপতি প্রথমে উহা গ্রহণ করিলেন এবং প্রজাবর্গের আয়ুর অল্পতা অবগত হইয়া উহা সংক্ষেপে কীৰ্ত্তন করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। মহেশ্বর সেই ব্রহ্মকৃত নীতিশাস্ত্র সংক্ষিপ্ত করিয়া দশসহস্র অধ্যায়ে পর্য্যবসিত করিলে সেই সংক্ষিপ্ত নীতিশাস্ত্র বৈশালক্ষনামে প্রসিদ্ধ হইল। তৎপরে ভগবান্ ইন্দ্র ঐ শাস্ত্রকে পঞ্চসহস্র অধ্যায়ে সংক্ষেপে কীৰ্ত্তন করিয়া বাহুদন্তক নাম প্রদান করিলেন। অনন্তর মহাত্মা বৃহস্পতি ঐ বাহুদন্তক গ্রন্থ সংক্ষিপ্ত করিয়া তিনসহস্র অধ্যায়ে কীৰ্ত্তনপূৰ্ব্বক বাৰ্হস্পত্য নাম প্রদান করিলেন।
বেণরাজের জন্ম-বেণ হইতে পৃথুর উৎপত্তি
“পরিশেষে যোগাচাৰ্য্য ভগবান্ শুক্রাচার্য্য ঐ শাস্ত্রকে একসহস্র অধ্যায়ে সংক্ষেপে কীৰ্ত্তন করিলেন। মহাত্মারা এইরূপে মর্ত্যদিগের অয়ুর অল্পতা অবগত হইয়া লোকানুরোধে সেই নীতিশাস্ত্রকে সংক্ষিপ্ত করিলে দেবগণ ভগবান নারায়ণের সমীপস্থ হইয়া কহিলেন, “ভগবন্! এক্ষণে আজ্ঞা করুন, মনুষ্যদিগের মধ্যে কোন্ ব্যক্তি শ্ৰেষ্ঠ হইবে? তখন ভগবান বিষ্ণু কিয়ৎক্ষণ চিন্তা করিয়া বিরজানামে এক মানসপুত্রের সৃষ্টি করিলেন। কিন্তু ঐ মহাত্মা পৃথিবীর আধিপত্য অভিলাষ না করিয়া সন্ন্যাসধৰ্ম্মে অনুরক্ত হইলেন। তাঁহার কীর্ত্তিমাননামে এক বিষয়বাসনাপরিশূন্য পুত্র হইয়াছিল। কীর্ত্তিমানের কর্দ্দমনামে এক মহাতপা পুত্র জন্মে। প্রজাপতি কর্ম্ম অনঙ্গনামে এক পুত্র উৎপাদন করিলেন। ঐ মহাত্মা প্রজাপালনতৎপর, সাধু ও দণ্ডনীতিবিশারদ ছিলেন, তাঁহার অতিবলনামে এক পুত্র জন্মে। অতিবল পিতার পরলোকপ্রাপ্তির পর বিশাল রাজ্য প্রাপ্ত হইয়া নিতান্ত ইন্দ্রিয়পরবশ হইয়াছিলেন। উহার ঔরসে মৃত্যুর সুনীথানাম্নী মানসী কন্যার গর্ভে বেণের জন্ম হয়। বেণ পিতার নিধনানন্তর রাজ্যলাভ করিয়া যারপরনাই অধৰ্ম্মনিরত হইয়া উঠিলেন। ব্রহ্মবাদী মহর্ষিগণ তাঁহাকে ক্রোধদ্বেষ পরিপূর্ণ ও অধার্ম্মিক দেখিয়া মন্ত্রপূত কুশদ্বারা তাঁহার প্রাণসংহার করিলেন। তৎপরে তাঁহারা মন্ত্রপ্রভাবে বেণের দক্ষিণ ঊরু ভেদ করাতে উহা হইতে এক হ্রস্বাঙ্গ, তালোচন ও দগ্ধ কাষ্ঠের ন্যায় বিকৃত পুরুষ সমুৎপন্ন হইবামাত্র মহর্ষিগণ উহাকে ‘এই স্থানে নিষগ্ন হও’ বলিয়া অনুজ্ঞা করিলেন। ঐ নিমিত্তই ঐ পুরুষের বংশসম্ভূত শৈল, বন ও বিন্ধ্যাচলবাসী ক্রূরস্বভাব স্লেচ্ছগণ নিষাদনামে বিখ্যাত হইয়াছে। অনন্তর মহর্ষিগণ পুনরায় বেণের দক্ষিণহস্ত ভেদ করিলেন। তখন ঐ হস্ত হইতে এক খড়্গ কবচধারী, শরশরাসনসম্পন্ন, বেদবেদাঙ্গবেত্তা, দণ্ডনীতিকুশল, ধনুৰ্ব্বেদবিশারদ, ইন্দ্রের ন্যায় পরমসুন্দর পুরুষ প্রাদুর্ভূত হইলেন। উঁহার নাম পৃথু। পৃথু বেণ হইতে সমুৎপন্ন হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে মহর্ষিদিগকে কহিলেন, “হে তপোধনগণ! আমার ধর্ম্মার্থদর্শিনী অতি সূক্ষ্মবুদ্ধি সমুৎপন্ন হইয়াছে। আমি এই বুদ্ধিপ্রভাবে এক্ষণে কি কার্য্যের অনুষ্ঠান করিব, আপনারা আমাকে উহা সবিশেষ নির্দেশ করিয়া দিন। আপনারা আমাকে যেরূপ আজ্ঞা করিবেন, আমি কিছুমাত্ৰ পর্য্যালোচনা না করিয়া তাহারই অনুষ্ঠান করিব।’
“অনন্তর দেবতা ও মহর্ষিগণ তাঁহাকে সম্বোধনপুৰ্ব্বক কহিলেন, মহারাজ! তুমি অশঙ্কিতমনে নিয়ত ধৰ্ম্মানুষ্ঠান, প্রিয় ও অপ্রিয় পরিত্যাগপূৰ্ব্বক সমুদয় জীবের প্রতি সমভাবে দৃষ্টিপাত, কাম, ক্রোধ, লোভ ও মদ দূরে পরিহার, কেহ ধৰ্ম্মপথপরিভ্রষ্ট হইলে ধর্ম্মানুসারে তাহার দণ্ডবিধান, কায়মনোবাক্যে ভূমিস্থ বেদনির্দিষ্ট ধৰ্ম্ম সম্যক প্রতিপালনের চেষ্টা এবং অশঙ্কিতচিত্তে দণ্ডনীতিমূলক ধৰ্ম্ম নিয়ত প্রতিপালন কর। ব্রাহ্মণের প্রতি কদাচ দণ্ডবিধান করিবে না এবং লোকসঙ্করতা নিবারণের সম্যক্ চেষ্টা করিবে বলিয়া প্রতিজ্ঞারূঢ় হও, আর স্বেচ্ছানুসারে কদাচ কোন কার্য্যের অনুষ্ঠান করিও না।’
পৃথুর রাজ্যাভিষেক—পৃথিবীপালন
“বেণতনয় দেবতা ও মহর্ষিদিগের বাক্য শ্রবণ করিয়া তাঁহাদিগকে কহিলেন, ব্রাহ্মণগণ সততই আমার নমস্য হউন। তখন দেবতা ও মহর্ষিগণ কহিলেন, মহারাজ! ব্রাহ্মণেরা অবশ্যই তোমার নমস্য হইবেন।’ অনন্তর মহর্ষি শুক্রাচার্য্য তাঁহার পুরোহিত, বালখিল্য ও সারস্বতগণ তাঁহার মন্ত্রী এবং মহর্ষিগণ তাঁহার জ্যোতিষিক[জ্যোতিষশাস্ত্রসম্পর্কিত ব্যবস্থাপক] হইলেন। ভগবান্ বিষ্ণু মহাত্মা পৃথুকে অষ্টম সৃষ্টিকর্তা বলিয়া নির্দেশ করিলেন। ঐ সময় সূত ও মাগধনামে তাঁহার দুই স্তুতিপাঠক উৎপন্ন হইল। ইহার পূৰ্ব্বে স্তুতিপাঠকের আর সৃষ্টি হয় নাই। তখন মহারাজ পৃথু প্রীতমনে সূতকে অনূপদেশ ও মাগধকে মগধদেশ প্রদান করিলেন। পূৰ্ব্বে মন্বন্তরপ্রভাবে পৃথিবী অতিশয় উন্নতানত হইয়াছিল, মহাত্মা পৃথু ধনুষ্কোটিদ্বারা শিলাজাল উৎসারিত করিয়া উহার সমতা সম্পাদন করিলেন। তিনি ভূতল সমতল করিবার অভিলাষে যেসমস্ত শিলা অপসারিত করিয়াছিলেন, তদ্বারা পৰ্ব্বতের সৃষ্টি হইয়াছে।
‘অনন্তর বিষ্ণু ও ইন্দ্র প্রভৃতি দেবতা, মহর্ষি ও ব্রাহ্মণগণ মহারাজ পৃথুকে রাজ্যে অভিষিক্ত করিলেন। পৃথিবী মূর্ত্তিমতী হইয়া বিবিধ ধনরত্ন গ্রহণপূর্ব্বক তাঁহার নিকট সমুপস্থিত হইলেন। মহাসাগর, হিমাচল ও ত্রিদশরাজ ইন্দ্র তাঁহাকে অক্ষয় ধন, সুমেরুপর্ব্বত রাশি রাশি সুবর্ণ এবং যক্ষরাক্ষসগণের অধিপতি কুবের তাঁহাকে ধৰ্ম্ম, অর্থ ও কামনির্ব্বাহাৰ্থ প্রচুর অর্থ প্রদান করিলেন। বেণতনয় চিন্তা করিবামাত্র অসংখ্য হস্তী, অশ্ব, রথ ও মনুষ্য তাঁহার নিকট সমুপস্থিত হইল। তাতাঁর রাজ্যকালে জরা, ব্যাধি, দুর্ভিক্ষ ও মনঃপীড়ার কিছুমাত্র প্রাদুর্ভাব ছিল না। তাঁহার শাসনপ্রভাবে তস্কর ও সরীসৃপগণ হইতে লোকের কিছুমাত্র অপকার হইত না। তিনি সমুদ্রযাত্রা করিলে সাগরের সলিলরাশি স্তব্ধ হইয়া থাকিত, পর্ব্বতসমুদয় তাঁহাকে পথ প্রদান করিত এবং কুত্রাপি তাঁহার আজ্ঞাভঙ্গ হইত না। তিনি যক্ষ, রাক্ষস, নাগ প্রভৃতি জীবগণের আহারার্থে পৃথিবী হইতে সপ্তদশ প্রকার শস্য সমুৎপাদন করেন। তাঁহার প্রভাবেই লোকসকল ধর্ম্মপরায়ণ হইয়াছে। তিনি সুপ্রণালীক্রমে প্রজারঞ্জন করিতেন বলিয়া রাজা উপাধিপ্রাপ্ত এবং ব্রাহ্মণগণকে ক্ষত বা বিনাশ হইতে রক্ষা করাতে ক্ষত্রিয় বলিয়া বিখ্যাত হইয়াছিলেন।
“এইরূপে এই বহুলোকপূর্ণা পৃথিবী পৃথুর প্রভাবে ধৰ্ম্মে অবনত হইয়াছিল। সনাতন বিষ্ণুও‘ তোমাকে কেহ অতিক্রম করিতে পারিবে না’ বলিয়া স্বয়ং পৃথুকে মর্য্যাদা প্রদান করিলেন। তৎকালে ভগবান বিষ্ণু তপঃপ্রভাবে সেই মহাত্মা ভূপতির দেহে প্রবিষ্ট হইয়াছিলেন বলিয়াই জগতের যাবতীয় লোক তাঁহাকে দেবতুল্য জ্ঞান করিয়া নমস্কার করে। হে মহারাজ! দণ্ডনীতির অনুসারে রাজ্যপালন করা রাজার অবশ্যকর্ত্তব্য কৰ্ম্ম। নরপতি স্থিরচিত্ত হইয়া শুভকার্য্যের অনুষ্ঠান করিলে অবশ্যই শুভফল লাভ করিতে পারেন। দৈবগুণপ্রভাবেই প্রজারা রাজার বশীভূত হয়। পৃথুর রাজ্যপ্রাপ্তির সময়ে বিষ্ণুর ললাট হইতে এক সুবর্ণময় কমল সমুৎপন্ন হইয়াছিল। ধর্ম্মের পত্নী শ্রী সেই কমল হইতে সমুদ্ভূত হয়েন। ধৰ্ম্ম ও শ্রী হইতে অর্থ সমুৎপন্ন এবং তৎপরে ধর্ম্ম, শ্রী ও অর্থ রাজ্যমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়।
“স্বর্গীয় লোক পূণ্যক্ষয়নিবন্ধন স্বর্গ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক দণ্ডনীতি বিশারদ রাজা হইয়া বিষ্ণুর অংশে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেন। এই নিমিত্তই ভূপতিগণ বুদ্ধিমান ও মাহাত্ম্যবিশিষ্ট হইয়া থাকেন। দেবগণ ভূপতিকে রাজ্য প্রদান করেন বলিয়া কেহই তাঁহাকে অতিক্রম করিতে পারে না, প্রত্যুত সকলেই তাঁহার বশবর্ত্তী হয়। রাজার পূৰ্ব্বকৃত সুকৃতনিবন্ধনই অন্যান্য মানবগণ তাঁহার তুল্য হস্তপদাদিবিশিষ্ট হইয়াও তাঁহার আদেশ প্রতিপালন করে। যে ব্যক্তি রাজাকে প্রসন্নবদন অবলোকন এবং ভাগ্যবান, ধনশালী ও রূপবান্ বলিয়া জ্ঞান করে, রাজা তাঁহার বশবর্ত্তী, সন্দেহ নাই।
“হে ধৰ্ম্মরাজ! দণ্ডপ্রভাবেই জনসমাজে নীতি ও ধর্ম্মের প্রচার হইয়াছে। লোকপিতামহ ব্রহ্মা যে নীতিশাস্ত্র প্রণীত করিয়াছিলেন, তাহাতে পুরাণশাস্ত্র, মহর্ষিগণের উৎপত্তি, তীর্থ ও নক্ষত্ৰসমুদয়, চারি-আশ্রম, চারি-হোম, চারিবর্ণ, চারি-বিদ্যা, ইতিহাস, বেদ, ন্যায়, তপস্যা, জ্ঞান, অহিংসা, সত্য, অসত্য, বৃদ্ধসেবা, দান, শৌচ, পুরুষকার, সৰ্ব্বভূতানুকম্পা এবং ভূতল ও পাতালস্থিত অন্যান্য বিষয়সমুদয় কীৰ্ত্তিত হইয়াছে। ঐ গ্রন্থের অনুসারেই বুধগণ নরদেবগণকে দেবতুল্য বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া থাকেন। হে মহারাজ! এই আমি তোমার জিজ্ঞাসানুসারে রাজার বৃত্তান্ত সবিস্তারে কীৰ্ত্তন করিলাম।”