চলিলেন ধর্ম্মরাজ সহ মুনিগণে।
কত দিনে উপনীত নৈমিষ কাননে।।
গোমতীতে স্নান করি, করি বহু দান।
তথা হৈতে পরতীর্থে করেন প্রয়াণ।।
যেখা প্রয়াগ তীর্থ যমুনা সঙ্গম।
কত দিনে উপনীত অগস্ত্য আশ্রম।।
লোমশ কহিল তবে পূর্ব্ব বিবরণ।
দৈত্য মারি আশ্রম করিল তপোধন।।
স্বচ্ছন্দে সকল পৃথ্বী করিল ভ্রমণ।
এক দিন শুন রাজা তার বিবরণ।।
এক দিন এক গর্ত্তে দেখে মুনিরাজ।
পিতৃগণ অধোমুখে আছে তার মাঝ।।
দেখিয়া হইল শঙ্কা জিজ্ঞাসে সবারে।
কি হেতু পড়িলে সবে গর্ত্তের ভিতরে।।
সবে বলে, না করিলে বংশের উৎপত্তি।
তেঁই আমা সবাকার হৈল হেন গতি।।
যদি শ্রেয়ঃ চাহ তুমি আমা সবাকার।
বংশ জন্মাইয়া তুমি করহ উদ্ধার।।
পিতৃগণ বচন শুনিয়া মুনিরাজ।
বংশ হেতু চিন্তিত হইল হৃদিমাঝ।।
বিদর্ভ রাজার কন্যা অতি অনুপমা।
রূপে গুণে মনোহরা লোপামুদ্রা নামা।।
যৌবন সময় তার দেখিয়া রাজন।
কারে দিব লোপামুদ্রা চিন্তে মনে মন।।
হেনকালে উপনীত মহা তপোধন।
যথোচিত পূজা করি জিজ্ঞাসে রাজন।।
কি হেতু আসিলে, আজ্ঞা কর মুনিবর।
শুনি মুনিরাজ তবে করিল উত্তর।।
পিতৃগণ আদেশে জন্মাব সন্ততি।
তব কন্যা লোপামুদ্রা দেহ নরপতি।।
এত শুনি নরপতি হৈল অচেতন।
প্রত্যুত্তর দিতে মুখে না আসে বচন।।
উঠিয়া গেলেন রাজ মহাদেবী স্থানে।
রাণীকে কহেন রাজা করুণ বচনে।।
মাগে লোপামুদ্রারে অগস্ত্য মহাঋষি।
নাহি দিলে শাপেতে করিবে ভস্মরাশি।।
এত বিচারিয়া দোঁহে সন্তাপিত শোকে।
শুনি লোপামুদ্রা কহে জননী জনকে।।
মম হেতু তাপ কেন ভাবহ হৃদয়।
আমারে অগস্ত্যে দিয়া খণ্ডাহ এ ভয়।।
তবে লোপামুদ্রার বুঝিয়া যে অন্তর।
বিধিমতে মুনি করে দেন নৃপবর।।
লোপামুদ্রা প্রতি তবে কহে তপোধন।
মম ভার্য্যা হৈলে, কর মম আচরণ।।
দিব্য বস্ত্র ত্যজ রত্ন ভূষণ সকল।
শিরেতে ধরহ জটা, পিন্ধহ বাকল।।
মুনিবাক্যে সেইক্ষণে সকলি ত্যজিল।
জটাচীর লোপামুদ্রার ভূষণ করিল।।
তবে ত অগস্ত্য মুনি ভার্য্যারে লইয়া।
গঙ্গাতীরে মহামুনি রহিলেন গিয়া।।
নিরন্তর করে কন্যা মুনির সেবন।
তপ শৌচ আচমন মুনি আচরণ।।
হেনমতে তথা থাকি বহুদিন গেল।
এক দিন মুনিরাজ ভার্য্যারে কহিল।।
পুত্র হেতু করিয়াছি তোমারে গ্রহণ।
বংশ না হইল তোমার কিসের কারণ।।
এত শুনি লোপামুদ্রা যুড়ি দুই কর।
বিনয় পূর্ব্বক কহে মুনির গোচর।।
কামদেবে কৈল ধাতা সৃষ্টির কারণ।
বিনা কামে নাহি হয় বংশের সৃজন।।
জটাচীর ফলাহার ধূলাতে ধূসর।
ইথে কাম কি মতে জন্মিবে মুনিবর।।
আপনি কি জান মুনি এই বংশকাজ।
বংশ হেতু ইচ্ছা যদি শুন মুনিরাজ।।
পূর্ব্বে যথা ছিল মম বস্ত্র অলঙ্কার।
দিব্য গৃহ দাসগণ ভক্ষ্য উপহার।।
সে সকল বস্তু যদি পাই পুনর্ব্বার।
তবে ত জন্মিবে পুত্র উদরে আমার।।
এত শুনি অগস্ত্যের চিন্তা হৈল মনে।
উপায় চিন্তিল পুনঃ কন্যার বচনে।।
শ্রুতপর্ব্বা নামে রাজা ইক্ষবাকু নন্দন।
ভার্য্যা সহ তথাকারে গেল তপোধন।।
দেখি শ্রুতপর্ব্বা রাজা পূজে বহুতর।
জিজ্ঞাসিল কি হেতু আইলা মুনিবর।।
মুনি বলে, বৃত্তিহেতু আসিলাম আমি।
বৃত্তি অর্থ কিছু রাজা মোরে দেহ তুমি।।
যে কিছু মাগিল মুনি, সব দিল রাজা।
পাত্র মিত্র সহিত করিল বহু পূজা।।
দিব্য গৃহ আসন ভূষণ দাসগণ।
বাঞ্ছামত পাইয়া রহিল তপোধন।।
তবে যত প্রজাগণ রাজার সংহতি।
অগস্ত্যেরে কহে তারা, করিয়া মিনতি।।
ইল্বল নামেতে দৈত্য মায়ার সাগর।
বাতাপি নামেতে আছে তার সহোদর।।
মায়াবলে ধরে ধুষ্ট গাড়ল মূরতি।
কাটিয়া রন্ধন করি ভুঞ্জিয়া যে থাকে।।
এইমতে মারে দুষ্ট বহু দ্বিজগণ।
অদ্যাবধি হিংসা করে পাপিষ্ঠ দুর্জ্জন।।
ইল্বলের ভয়েতে তাপিত এ নগর।
শুনিয়া অগস্ত্য মুনি চিন্তিত অন্তর।।
আশ্বাসিয়া সবাকারে করিল নির্ভয়।
একাকী চলিল মুনি ইল্বল আলয়।।
মুনি দেখি ইল্বল পূজিল বহুতর।
জিজ্ঞাসিল সবিনয়ে করিয়া আদর।।
কি হেতু আসিলে, আজ্ঞা কর তপোধন।
শুনিয়া উত্তর কৈল কুম্ভক নন্দন।।
বহু পরিশ্রমে আসিলাম তব পুর।
বহুদিন উপবাসী, ভুঞ্জাও প্রচুর।।
সম্পূর্ণ করিয়া মোরে করাহ ভোজন।
হাসিয়া ইল্বল বলে, বৈস তপোধন।।
কাটিয়া মায়াবী মেষ করিল রন্ধন।
অগস্ত্য মুনিরে দিল করিতে ভোজন।।
মুনি বলে, এই মাংসে কি হবে আমার।
সকলি আনিয়া দেহ যত আছে আর।।
শির কটি চারি পদ আনি দেহ মেষ।
তাবৎ খাইব আমি না রাখিব শেষ।।
মুনিবাক্য শুনিয়া ইল্বল আনি দিল।
অস্থি সহ মুনিবর সকলি খাইল।।
কতক্ষণে ইল্বল ডাকিল সহোদরে।
বাহিরাও বাতাপি, ডাকিল বারে বারে।।
হাসিয়া বলেন মুনি কেন ডাক পাপী।
অগস্তের ঠাঁই কোথা পাইবে বাতাপি।।
বাতাপি পাইবে আর না করিহ আশ।
এত দিনে হৈল দুরাচারের বিনাশ।।
এত শুনি ইল্বল যুড়িয়া দুই কর।
স্তুতি করি কহে তবে মুনির গোচর।।
কি করিব প্রিয় তব, কহ মুনিবর।
মুনি বলে, প্রাণী হিংসা করিলে বিস্তর।।
যত রত্ন ধন তুমি পাইয়াছ তায়।
সকলি আমায় দিয়া রাখ আপনায়।।
সেইক্ষণে দুষ্ট দৈত্য আনি সব দিল।
দ্রব্য লয়ে মুনিরাজ আশ্রমে চলিল।।
বসন ভূষণ দিব্য রত্ন অলঙ্কার।
দেখি লোপামুদ্রা হৈল আনন্দে অপার।।
সন্তুষ্টা হইয়া কন্যা ভাবে মনে মন।
বংশ হেতু মুনিবরে করে নিবেদন।।
মুনি বলে, পুত্র বাঞ্ছা কতেক তোমার।
লোপামুদ্রা বলে হৌক একটী কুমার।।
এক পুত্র গুণবান হোক তপোধন।
অকৃতি সহস্র পুত্রে নাহি প্রয়োজন।।
তবে প্রীত হয়ে কাম বাড়িল দোঁহার।
মুনির ঔরসে তাঁর জন্মিল কুমার।।
অগস্ত্য সমান হৈল পরম পণ্ডিত।
শুনিলে পূর্ব্বের কথা অগস্ত্যা চরিত।।
অগস্ত্য মুনির কথা অদ্ভূত মানুষে।
হেলায় সমুদ্র পান করিল গণ্ডূষে।।
সূর্য্য পথ রুদ্ধ করিলেক বিন্ধ্যাচল।
অন্ধকারে ব্যাপিলেক পৃথিবীমণ্ডল।।
অগস্ত্য প্রভাবে লোকে সে ভয় ঘুচিল।
অন্ধকার দূর হৈল, সূর্য্য পথ পাইল।।
এত শুনি জিজ্ঞাসেন ধর্ম্মের নন্দন।
কহ মুনিরাজ সে অগস্ত্য বিবরণ।।
কি কারণে মুনিরাজ সমুদ্র শুষিল।
কোন হেতু অন্ধকার, কিরূপে খণ্ডিল।।