৫৯তম অধ্যায়
পাণ্ডবজয়ার্থ ভীষ্মের অভিযান
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! মহাত্মা শান্তুনুতনয় আমার পুত্রের বাক্যে ক্রুদ্ধ হইয়া উক্ত প্রকার প্রতিজ্ঞা করিয়া পাণ্ডবদিগের সহিত ও পাঞ্চালগণই বা তাহার সহিত কিরূপ সংগ্রাম করিয়াছিল, তৎসমুদয় কীর্ত্তন কর।”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! ঐ দিবসের পূর্ব্বাহ্ণ গতিপ্রায় ও দিনকর পশ্চিমদিকে কিঞ্চিৎ অবনত হইলে মহাত্মা পাণ্ডবগণ জয়লাভ করিলেন। তখন সর্ব্বধর্ম্মজ্ঞ মহাবীর দেবব্রত মহাবেগশালী অশ্বযুক্ত রথে আরোহণ করিয়া মহতী সেনাসমভিব্যাহারে পাণ্ডবসৈন্যমধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। তখন পাণ্ডবগণের সহিত কৌরবগণের ঘোরতর লোমহর্ষণ সংগ্রাম সমুপস্থিত হইল। ধনুঃকূজিত [ধনুকের টঙ্কার] ও তলাভিঘাতদ্বারা গিরিবিদারণ শব্দের ন্যায় তুমুল শব্দ সমুত্থিত হইল। চতুর্দ্দিকে কেবল ‘থাক, আমি রহিয়াছি, ইহাকে জান, নিবৃত্ত হও, স্থির হও, প্রহার কর’, এই শব্দই শ্রুত হইতে লাগিল। কাঞ্চনময় বর্ম্ম, কিরীট ও ধ্বজে শরনিকর নিপতিত হওয়াতে শৈলনিপতিত শিলার ন্যায় শব্দ সমুত্থিত হইল। দিব্যাভরণভূষিত সহস্ৰ সহস্র মস্তক ও বাহু ভূতলে নিপতিত ও বিলুষ্ঠিত হইল; কোন যোদ্ধা মস্তক ছিন্ন হইলেও পূর্ব্বের ন্যায় ধনুর্ব্বাণ ধারণ করিয়া রহিল; নর, অশ্ব ও গজের শোণিতে মহাবেগশালিনী তরঙ্গিণী প্রবাহিত হইতে লাগিল; মাতঙ্গকলেবর উহার শিলা, মাংস ও মেদ কর্দ্দমস্বরূপ হইল। সেই শোণিতস্রোতস্বতী [রক্তের নদী] সন্দর্শনে গৃধ্র ও গোমায়ুগণের আহ্লাদের আর পরিসীমা রহিল না।
“হে মহারাজ! কৌরব ও পাণ্ডবগণের যেমন সংগ্রাম দেখিলাম, এরূপ সংগ্রাম পূর্ব্বে কখন দৃষ্ট বা শ্রুত হয় নাই। নর ও গিরিশৃঙ্গসদৃশ নীলগজসমুদয়ের কলেবরে রণস্থল আবৃত হওয়াতে তথায় রথচালনের পথ রহিল না। বিচিত্র কবচ ও শিরস্ত্ৰাণসকল বিকীর্ণ হওয়াতে সংগ্রামস্থল শরৎকালীন আকাশমণ্ডলের ন্যায় শোভমান হইল। কোন কোন যোদ্ধা শ্রেণী [নিজ দল] হইতে বহির্গত ও দর্পসহকারে অদীনভাবে শক্রগণের প্রতি ধাবমান হইয়া তাহাদের মনপীড়ন করিতে লাগিল। রণে নিপতিত ব্যক্তিগণ ‘হা ভ্ৰাতঃ! হা বন্ধো! হা বয়স্য! হা মাতুল! আমাকে পরিত্যাগ করিও না,’ বলিয়া উচ্চস্বরে রোদন করিতে আরম্ভ করিল। ‘আগমন কর, কেন ভীত হইয়াছ? কোথায় যাইতেছ? আমি যুদ্ধে রহিয়াছি, ভয় নাই’, বলিয়া অন্যান্য যোদ্ধারা চীৎকার করিতে লাগিল।
ভীষ্মকর্ত্তৃক বহু পাণ্ডবসৈন্যবধ
“হে মহারাজ! সেই ভীষণ সংগ্রামস্থলে মহাবীর শান্তনুতনয় শরাসন মণ্ডলীকৃত করিয়া আশীবিষসদৃশ দীপ্তাগ্র [যাহার অগ্রভাগ উজ্জ্বল] শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন, শরদ্বারা দশদিক একাকার করিয়া পাণ্ডবপক্ষীয় মহারথগণের নামোল্লেখপূর্ব্বক তাঁহাদিগকে নিহত করিতে লাগিলেন এবং পাণিলাঘব [হস্তকৌশল] প্ৰদৰ্শন করিয়া, রথমার্গে ইতস্ততঃ অলাতচক্রের ন্যায় নৃত্য করিতে লাগিলেন। পাণ্ডব ও সৃঞ্জয়গণ ঐ মহাবীরের অসাধারণ লাঘব্যবশতঃ সংগ্রামস্থলে সহস্ৰ সহস্র ভীষ্মকে দেখিয়া তাঁহাকে মায়াবী বলিয়া বোধ করিলেন। সেই সমরাঙ্গনস্থ। ব্যক্তিগণ তাঁহাকে এই পূর্ব্বদিকে, তৎক্ষণাৎ পশ্চিমদিকে, পরে উত্তরদিকে এবং মুহূৰ্তমধ্যে দক্ষিণদিকে সন্দর্শন করিয়া বিষ্ময়াপন্ন হইল। পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণ কেবল ভীষ্মের শরাসননির্ম্মুক্ত শরসমুদয়ই দেখিতে লাগিলেন, তাঁহাকে কেহই দেখিতে পাইলেন না। তাঁহারা শান্তনুতনয়কে অমানুষকর্ম্মসম্পাদনপূর্ব্বক সৈন্যগণকে নিহত করিয়া সংগ্রামস্থলে সঞ্চরণ করিতে দেখিয়া বহুবিধ চীৎকার করিতে লাগিলেন। শলভস্বরূপ ভূপতিগণ বিমোহিত হইয়া আত্মবিনাশের নিমিত্ত ভীষ্মরূপ অগ্নিতে নিপতিত হইতে লাগিলেন। ভীষ্মের শর নর, হস্তী ও অশ্বের মধ্যে কাহারও গাত্রে নিপতিত হইয়া ব্যর্থ হইল না। যেমন বজ্রদ্বারা পর্ব্বত বিদীর্ণ হয়, তদ্রূপ ভীষ্মের এক-এক বাণে এক-এক হস্তী বিদীর্ণ হইতে লাগিল। তিনি এক-এক নারাচ নিক্ষেপ করিয়া দুই-তিন গজারোহীকে নিধন করিতে আরম্ভ করিলেন। ফলতঃ যে যে ব্যক্তি সংগ্রামে ভীষ্মের সম্মুখীন হইলেন, তাঁহাদের সকলকেই মুহূৰ্তমধ্যে ভূতলে নিপতিত হইতে হইল।
“হে মহারাজ! এইরূপে মহাবীর ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরের সৈন্যগণকে সংহার করিতে আরম্ভ করিলে, হতাবিশিষ্ট সেনাসমুদয় ভীষ্মের শরে নিপীড়িত ও কম্পিত হইয়া প্রাণভয়ে বাসুদেব ও অর্জ্জুনের সমক্ষেই ইতস্ততঃ পলায়ন করিতে লাগিল। মহারথীগণ সেই পলায়মান সৈন্যসমুদয়কে নিবারণ করিতে অনেক চেষ্টা করিলেন, কিন্তু কোনক্রমেই কৃতকাৰ্য্য হইতে পারিলেন না; তাহারা ভীষ্মশরে নিতান্ত ব্যথিত ও এরূপ ভগ্ন হইয়া নানা দিকে ধাবমান হইল যে, দুইজনকে একত্ৰ গমন করিতে দেখা গেল না। রথ, নাগ ও অশ্বসমুদয় বিদ্ধ হইল; রথাকুবর নিপতিত হইল ও যোধগণ হাহাকার করিয়া অচেতন হইতে লাগিল। পিতা পুত্ৰকে, পুত্ৰ পিতাকে ও প্রিয়সখা সখীকে বিনাশ করিতে আরম্ভ করিল, অনেকে কবচ পরিত্যাগপূর্ব্বক কেশকলাপ বিকিরণ করিয়া পলায়ন করিতে লাগিল। ফলতঃ তৎকালে পাণ্ডবসৈন্যগণকে গোসমূদয়ের ন্যায় উদভ্ৰান্ত হইয়া আর্ত্তম্বর করিতে দৃষ্ট হইল।
অর্জ্জুনের প্রতি কৃষ্ণের উৎসাহ
“যদুবংশাবতংস মহামতি বাসুদেব সেই পাণ্ডবসৈন্যকে ভগ্ন দেখিয়া রথ স্থগিত করিয়া অর্জ্জুনকে কহিতে লাগিলেন, “হে ধনঞ্জয়! এক্ষণে তোমার অভিলষিত কাল সমুপস্থিত হইয়াছে, অতএব যদি মুগ্ধ না হইয়া থাক, ভীষ্মকে প্রহার কর। তুমি পূর্ব্বে ভূপতিগণের সমক্ষে কহিয়াছিলে যে, কৌরবপক্ষীয় ভীষ্ম, দ্ৰোণ, কৰ্ণপ্রভৃতি যে কেহ আমার সহিত সংগ্রামে অগ্রসর হইবে, তাহাকে সমূলে উন্মূলন করিব; অতএব এক্ষণে সেই বাক্য সত্য কর। ঐ দেখ, তোমাদের সৈন্যগণ ভগ্ন হইতেছে, ভূপতিগণ পলায়ন করিতেছেন, ক্ষুদ্র মৃগেরা যেমন সিংহকে দেখিয়া বিদ্রূত হয়, তদ্রূপ বীরগণ ভীষ্মকে দেখিয়া ইতস্ততঃ ধাবমান হইতেছে।”
“মহাবীর ধনঞ্জয় বাসুদেবের বাক্যশ্রবণে তাঁহাকে কহিলেন, ‘হে কৃষ্ণ! সত্বর এই সৈন্যসাগরের মধ্য দিয়া রথচালনপূর্ব্বক ভীষ্মসমীপে গমন কর, আজি আমি রণদুর্ম্মদ বৃদ্ধ কুরুকুলপিতামহ ভীষ্মকে সংহার করিব।” মহাত্মা মাধব অর্জ্জুনের বচনানুসারে সূৰ্য্যসদৃশ দুর্নিরীক্ষ্য ভীষ্মের রথাভিমুখে রজতবর্ণ অশ্বসমুদয় চালনা করিলে পাণ্ডবসৈন্যগণ অর্জ্জুনকে ভীষ্মের প্রতি সমুদ্যত দেখিয়া পুনরায় সংগ্রামে সমাগত হইতে লাগিল। তখন মহাবীর ভীষ্ম অর্জ্জুনকে সম্মুখীন দেখিয়া বারংবার সিংহনাদ করিয়া সত্বর শরনিকর দ্বারা অর্জ্জুনের রথ সমাচ্ছাদিত করিলেন। ভীষ্মের শরজালপ্রভাবে মুহুর্ত্তমধ্যে অর্জ্জুনের রথ, ধ্বজ ও সারথির সহিত অদৃশ্য হইল। ঐ সময়ে মহাত্মা বাসুদেব ধৈৰ্য্য অবলম্বন পূর্ব্বক অসম্ভ্রান্তচিত্তে সেই ভীষ্ম-সায়ক-নিমগ্ন অশ্বসমুদয় চালিত করিতে লাগিলেন। মহাবলপরাক্রান্ত ধনঞ্জয় জলদগম্ভীর নিঃস্বনী দিব্যচাপ গ্রহণপূর্ব্বক বাণ নিক্ষেপ করিয়া ভীষ্মের শরাসন ছেদন করিলেন। মহাবীর ভীষ্ম স্বীয় শরাসন ছিন্ন অবলোকন করিয়া তৎক্ষণাৎ অন্য ধনু গ্রহণপূর্ব্বক তাহাতে জ্যারোপণ করিলেন। ধনঞ্জয়ও নিমেষমধ্যে শরাসন আকর্ষণপূর্ব্বক ভীষ্মের সেই শরাসন ছেদন করিলে, মহাত্মা শান্তনুতনয় অর্জ্জুনের হস্তলাঘবের প্রশংসা করিয়া কহিতে লাগিলেন, ‘সাধু পার্থ। সাধু! তুমি যে কাৰ্য্য করিলে, ইহা তোমারই উপযুক্ত। আমি তোমার প্রতি যৎপরোনাস্তি প্রীত হইয়াছি; তুমি আমার সহিত স্বচ্ছন্দে যুদ্ধ কর।”
“মহাবীর ভীষ্ম অর্জ্জুনকে এরূপে প্রশংসা করিয়া মহাশরাসন গ্রহণপূর্ব্বক তাঁহার রথে বাণ নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। মহাপ্রভাবসম্পন্ন বাসুদেব এই সময় সত্বর মণ্ডলচারে [মণ্ডলাকার গতিতে] রথচালনপূর্ব্বক অশ্বচালনে স্বীয় অসাধারণ ক্ষমতা প্রদর্শন করিলেন। তখন মহাবীৰ্য্যসম্পন্ন ভীষ্ম কৃষ্ণ ও ধনঞ্জয়ের সর্ব্বাঙ্গে নিশিত শরনিকর বিদ্ধ করিতে লাগিলেন; নরোত্তম কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন ভীষ্মের শরে ক্ষতবিক্ষতাঙ্গ হইয়া বিষাণবিক্ষতদেহ [শৃঙ্গভিন্নকলেবর-শিঙের আঘাতে ছিন্নভিন্নদেহ] গর্জ্জমান বৃষভদ্বয়ের ন্যায় শোভমান হইলেন। মহাত্মা ভীষ্ম পুনরায় ক্রুদ্ধ হইয়া শরনিকরে কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনের দশদিক্ আবৃত করিয়া তীক্ষ্ন বাণসমুদয়দ্বারা কৃষ্ণকে কম্পিত করিয়া অট্ট অট্ট হাস্য করিতে লাগিলেন।
ভীষ্মসমরে অসহমান সৈন্যের পলায়ন
“মহাত্মা মধুসূদন সমরে অর্জ্জুনকে মৃদুভাব অবলম্বন ও ভীষণাপরাক্রম ভীষ্মকে সূর্যের ন্যায় পাণ্ডবসেনাগণের মধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক প্রধান প্রধান সৈনিক পুরুষদিগের সংহার করিতে দেখিয়া পাণ্ডবসৈন্যগণ সমূলে উন্মূলিত হইয়াছে স্থির করিলেন এবং ভাবিলেন, “মহাবীর ভীষ্ম একদিনেই সসৈন্য সানুচর পাণ্ডবগণের কথা দূরে থাকুক, সমুদয় দৈত্যদানবগণকে বিনষ্ট করিতে পারেন। পাণ্ডবসৈন্যগণ ভগ্ন হইয়া সমরভূমি হইতে পলায়ন করিতেছে; কৌরবগণ সোমাকদিগকে ভগ্ন দেখিয়া ভীষ্মের হৰ্ষবৰ্দ্ধনপূর্ব্বক রণস্থলে ধাবমান হইয়াছে। অতএব আমিই অদ্য পাণ্ডবগণের নিমিত্ত ভীষ্মকে সমরে নিহত করিয়া উহাদের ভার লাঘব করিব। অর্জ্জুন তীক্ষ্নশরে একান্ত আহত হইয়াও ভীষ্মের গৌরবানুরোধে [মৰ্য্যাদাহেতু] আপনার কর্ত্তব্যবিষয়ে মনোযোগ করিতেছেন না।”
“মহাত্মা মধুসূদন এইরূপ চিন্তা করিতেছেন, ইত্যবসরে মহাবল পরাক্রান্ত ভীষ্ম ক্রোধাভরে পার্থের রথে শর নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলেন। শান্তনুতনয়ের শরনিকরে দশদিক সমাচ্ছন্ন হওয়াতে অন্তরীক্ষ, দিক, বিদিক, ভূমি বা ভাস্কর কিছুই লক্ষিত হইল না। সাধূম বায়ু প্রবাহিত হইতে লাগিল, দিকসমুদয় ক্ষুভিত হইল। মহাত্মা ভীষ্মের নির্দেশানুসারে দ্রোণ, বিকৰ্ণ, জয়দ্ৰথ, ভূরিশ্রবা, কৃতবর্ম্মা, কৃপ, অম্বষ্ঠাপতি, শ্রুতায়ু, বিন্দ, অনুবিন্দ, সুদক্ষিণ এবং প্রাচ্য, সৌবীর, বসতি, ক্ষুদ্রক ও মানবগণ সত্বর কিরাটীর প্রতি বাণ নিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলেন। অর্জ্জুন বহুসহস্ৰ অশ্ব, পদাতি ও রথে পরিবেষ্টিত হইয়াছেন এবং অসংখ্য পদাতি, হস্তী, অশ্ব ও রথিসমুদয় কৃষ্ণ ও অর্জ্জুনের প্রতি ধাবমান হইতেছে দেখিয়া সাত্যকি সত্বর সেই সৈন্যমধ্যে প্রবেশ করিলেন এবং বিষ্ণু যেমন ইন্দ্রের সহায়তা করেন, তদ্রূপ অর্জ্জুনের সাহায্য করিতে লাগিলেন। মহাবীর ভীষ্মের শরাঘাতে পাণ্ডবপক্ষীয় হস্তী, অশ্ব, ধ্বজ ও রথসমুদয় বিনষ্ট এবং যোদ্ধৃগণ বিত্ৰাসিত হইল। মহাবীর সাত্যকি তদ্দর্শনে নির্ভয়চিত্তে বীরসমুদয়কে কহিতে লাগিলেন, “হে ক্ষত্ৰিয়গণ! তোমরা কোথায় পলায়ন করিতেছ? ইহা কি ক্ষত্ৰিয়ের ধর্ম্ম? হে বীরগণ! আপনাদিগের প্রতিজ্ঞা পরিত্যাগ করিও না; স্বীয় ধর্ম্ম প্রতিপালন কর।”
“তখন মহাত্মা মধুসূদন ভূপতিগণের পলায়নবার্ত্তা শ্রবণ এবং সংগ্রামে অর্জ্জুনের মৃদুতা, ভীষ্মের পরাক্রমাধিক্য ও কৌরবগণের দর্পসহকারে সমাগমদর্শনে ক্রোধান্বিত হইয়া সাত্যকিকে কহিতে লাগিলেন, “হে শিনিবংশাবতংস! সৈন্যগণের মধ্যে যাহারা পলাইয়াছে, তাহাদের ত’ কথাই নাই; যাহারা আছে, তাহারাও পলায়ন করুক; আমি একাকী ভীষ্ম ও দ্রোণকে তাহাদের অনুগামিগণের সহিত সংহার করিব। আমি সংগ্রামস্থলে ক্রুদ্ধ হইলে কৌরবপক্ষীয় কাহারও নিস্তার নাই। এক্ষণে আমি চক্রগ্রহণপূর্ব্বক অগ্ৰে ভীষ্মের প্রাণবিনাশ ও তৎপরে সসৈন্য দ্রোণকে সংহার করিয়া ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জ্জুন, নকুল ও সহদেবের প্রীতিসাধন করিব। আমি অদ্যই সমুদয় ধৃতরাষ্ট্রনন্দন ও তৎপক্ষীয় প্রধান প্রধান ভূপতিগণকে সংহার করিয়া হৃষ্টচিত্তে অজাতশত্রু ধর্ম্মরাজকে রাজ্যে অভিষিক্ত করিব, সন্দেহ নাই।”
ভীষ্মবধার্থ চক্ৰপাণি শ্ৰীকৃষ্ণের অভিযান
“ভগবান বাসুদেব এই বলিয়া সুনাভিসম্পন্ন [মধ্যভাগস্থ ছিদ্র], সূৰ্য্যসমপ্ৰভ, সহস্ৰবজ্রতুল্য, ক্ষুরধার চক্ৰ উদভ্ৰামণপূর্ব্বক [ঘূর্ণন করিয়া—ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া] আশ্বসমুদয় পরিত্যাগ করিয়া, রথ হইতে অবতরণ করিলেন এবং পদভরে ধরাতল কম্পিত করিয়া মদান্ধ বারাণসংহারে সমুদ্যত সিংহের ন্যায় ভীষ্মকে বধ করিবার নিমিত্ত সৈন্যমধ্যে তাঁহার অভিমুখে ধাবমান হইলেন। তাঁহার গাত্রে বিলম্বিত পীতাম্বরখণ্ড আকাশমণ্ডলে চিরসংলগ্ন মেঘের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল। কৃষ্ণের কোপরূপ সূৰ্য্যকিরণে প্রস্ফুটিত, ক্ষুরসদৃশ তীক্ষ্ন অগ্রভাগরূপ পত্ৰসম্পন্ন, বাসুদেবের দেহরূপ সরোবরে সঞ্জাত, বাহুরূপ নালে অধিষ্ঠিত, সুদৰ্শনরূপ পদ্ম, নারায়ণনাভিজাত, তরুণার্কবৰ্ণ আদিপদ্মের ন্যায় শোভা ধারণ করিল। তত্রস্থ সমুদয় মানবগণ কৃষ্ণকে ক্রুদ্ধচিত্তে চক্রগ্রহণপূর্ব্বক উচ্চৈঃস্বরে সিংহনাদ করিতে দেখিয়া কুরুকুল ধ্বংস হইল মনে করিয়া চীৎকার করিতে আরম্ভ করিল। মহাপ্রভাব বাসুদেব সমুদয় জীবলোক ধ্বংস করিবার নিমিত্তই যেন সুদৰ্শনগ্রহণপূর্ব্বক ধাবমান হইয়া জীবধ্বংসকারী ধূমকেতুর ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন।
“মহাত্মা শান্তনুতনয় নরশ্রেষ্ঠ বাসুদেবকে চক্রগ্রহণপূর্ব্বক আগমন করিতে দেখিয়া ধনুর্ব্বাণহস্তে অসম্ভ্রান্তচিত্তে কহিতে লাগিলেন, “হে জগন্নিবাসী! হে দেবেশ! আগমন কর। হে খড়্গধারিন! হে শার্ঙ্গপাণে! হে গদাধর! তোমাকে নমস্কার। হে ভূতশরণ্য! হে লোকনাথ! আমাকে অবিলম্বে রথ হইতে পাতিত কর। হে কৃষ্ণ! তুমি আমাকে সংহার করিলে আমার ইহলোক ও পরলোক উভয়লোকেই শ্রেয়োলাভ ও ত্ৰিলোকমধ্যে প্রভাব প্রথিত হইবে।” মহাত্মা মধুসূদন ভীষ্মের বাক্যশ্রবণানন্তর মহাবেগে তাহার অভিমুখে গমন করিয়া কহিতে লাগিলেন, “হে ভীষ্ম! তুমিই এই মহাক্ষয়ের মূলীভূত; তোমার নিমিত্তই আজি দুৰ্য্যোধন বিনষ্ট হইবে। হে শান্তনুতনয়! দূতাসক্ত নৃপতিকে নিবারণ করাই ধর্ম্মপন্থাবলম্বী মন্ত্রীর অবশ্যকর্ত্তব্য। যদি রাজা কালবিপাকবশতঃ উপদেশে অনাস্থা প্রদর্শনপূর্ব্বক ধর্ম্মনিপেত কর্ম্মে প্রবৃত্ত হয়, তবে তাহাকে পরিত্যাগ করা উচিত।” মহাত্মা ভীষ্ম যদুবংশাবতংস। বাসুদেবের বাক্য শ্রবণ করিয়া তাঁহাকে কহিলেন, “হে জনাৰ্দন! দৈবই বলবান; যদুগণহিতার্থকংসকে পরিত্যাগ করিয়াছেন; আমি এই কথা ধৃতরাষ্ট্রকে বারংবার বলিয়াছিলাম; তিনি দৈবদুর্বিপাকবশতঃ আমার সেই হিতবাক্যে প্রতিবোধিত হইলেন না।’
অর্জ্জুনকর্ত্তৃক কৃষ্ণের ক্ৰোধপ্রশমন
“ভীষ্ম ও বাসুদেবের এইরূপ কথোপকথন হইতেছে এমন সময় মহাবাহু ধনঞ্জয় সত্বর রথ হইতে অবতীর্ণ হইয়া পাদচারে কৃষ্ণের সমীপে গমনপূর্ব্বক তাঁহার লম্বমান পীনবাহুযুগল ধারণ করিলেন। মহাবায়ু যেমন বৃক্ষ লইয়া গমন করে, তদ্রূপ মহাত্মা বাসুদেব সমধিক ক্রোধান্বিতচিত্তে অর্জ্জুনকে লইয়া ভীষ্মাভিমুখে ধাবমান হইলেন। তখন অর্জ্জুন প্ৰাণপণে কৃষ্ণের চরণদ্বয় ধারণ করিয়া তাঁহার দশম পাদনিক্ষেপসময়ে গতিরোধ করিলেন এবং প্ৰণতিপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “হে কেশব! ক্ৰোধ পরিত্যাগ কর, তুমি পাণ্ডবদিগের একমাত্র গতি; আমি পুত্র ও ভ্রাতৃগণের শপথ করিয়া কহিতেছি, স্বীয় প্রতিজ্ঞা মিথ্যা করিব না; তোমার নির্দেশানুসারে অবশ্যই কুরুকুল সমূলে উন্মূলন করিব।”
“মহাপ্রভাব জনাৰ্দন অর্জ্জুনের প্রতিজ্ঞাশ্রবণে পরমপ্রীত হইয়া চক্রহস্তে পুনরায় রথে আরোহণ ও অশ্বরজ্জু গ্রহণপূর্ব্বক পাঞ্চজন্যনিনাদে আকাশ ও দিঙ্মুণ্ডল প্ৰতিধ্বনিত করিতে লাগিলেন। কৌরবপক্ষীয় প্রধান প্রধান ব্যক্তিগণ নিষ্ক, অঙ্গদ ও কুণ্ডলবিভূষিত, রজোবিকীর্ণপক্ষ্ম [ধূলিলিপ্ত অক্ষিপল্লব—ধূলিপূৰ্ণ চক্ষুর পাতা], বিশুদ্ধদন্ত, পাঞ্চজন্যধারী বাসুদেবকে অবলোকন করিয়া চীৎকার করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সময় কুরুসৈন্যমধ্যে মৃদঙ্গ, ভেরী, পটহ ও দুন্দুভির ধ্বনি এবং রাথনেমির শব্দ বীরগণের সিংহনাদের সহিত মিলিত হওয়াতে তুমুল হইয়া উঠিল।
কৃষ্ণসন্তোষার্থ অর্জ্জুনের অধিকতর যুদ্ধোদ্যম
“এদিকে অর্জ্জুনের ঘন-নিৰ্ঘোষসদৃশ গাণ্ডীবশব্দে দিকসকল ও গগনমণ্ডল পরিপূর্ণ হইল ও নির্ম্মল শরসমুদয় চারিদিক সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। তখন কৌরবাধিরাজ দুৰ্য্যোধন ধনুর্ব্বাণ ধারণপূর্ব্বক ভীষ্ম ও ভূরিশ্রবাসমভিব্যাহারে সৈন্যসমুদয়ে পরিবৃত হইয়া কক্ষদহনোদ্যত পাবকের ন্যায় অর্জ্জুনের সম্মুখীন হইলেন। ভূরিশ্রবা সুবর্ণপুঙ্খ সাত ভল্ল, দুৰ্য্যোধন উগ্ৰ তোমর, শল্য গদা ও ভীষ্ম ভীষণ শক্তি অর্জ্জুনের উপর নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর ধনঞ্জয় অবিলম্বে সাতবাণদ্বারা ভূরিশ্রবার সাত ভল্ল ও শাণিত ক্ষুরাস্ত্রে দুৰ্য্যোধনের তোমর নিরাকৃত করিয়া, দুই বাণ নিক্ষেপপূর্ব্বক ভীষ্মপ্রযুক্ত বিদ্যুৎসদৃশ প্রভাসম্পন্ন শক্তি ও শল্যের গদা ছেদন করিয়া ফেলিলেন।
“অসামান্য বলবিক্রমশালী মহাবীর পার্থ এইরূপে সেই বীরগণের অস্ত্রসমুদয় ছেদন করিয়া বিচিত্র গাণ্ডীবশরাসন আকর্ষণপূর্ব্বক অন্তরীক্ষে অদ্ভুত মহেন্দ্ৰ অস্ত্র প্রাদুর্ভূত [ধনুকে যোজিত] করিলেন এবং সেই উত্তমাস্ত্র ও বিমলাগ্নিবৰ্ণ অন্যান্য বিবিধ শরনিকর দ্বারা সমুদয় কৌরবসৈন্যগণকে নিবারণ করিলেন। অর্জ্জুনশরাসনবিমুক্ত শরসমুদয় রথ, ধ্বজাগ্ৰ, ধনু ও বাহু ছেদন করিয়া নরেন্দ্ৰ, নাগেন্দ্র ও তুরঙ্গমগণের দেহে প্রবেশ করিতে লাগিল। মহাবীর ধনঞ্জয় এইরূপে নিশিত-ঘোর-শরনিকর দ্বারা সমুদয় দিগবিদিক সমাচ্ছন্ন করিয়া গাণ্ডীবশব্দে বিপক্ষ সৈন্যগণের মন ব্যথিত করিতে আরম্ভ করিলেন। সেই তুমুল সংগ্রামে ধনঞ্জয়ের গাণ্ডীবাশব্দপ্রভাবে শঙ্খনিনাদ ও দুন্দুভি-নিঃস্বন অন্তর্হিত হইল। ঐ সময় অতি ভীষণ রথশব্দ হইতে লাগিল। তখন পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ ও বিরাটরাজপ্রমুখ বীরগণ গাণ্ডীবধন্বার গাণ্ডীবনিঃস্বন বুঝিতে পারিয়া অদীনচিত্তে সেইস্থানে সমুপস্থিত হইলেন।
“হে মহারাজ! ঐ সময় যাবতীয় কৌরবসৈন্যগণ গাণ্ডীবশব্দানুসারে অর্জ্জুনের সমীপে গমন করিল; কিন্তু সেই মহাশরাসনের ভীষণ শব্দে ভীত হইয়া কেহই তাঁহাকে আক্রমণ করিতে পারিল না। সেই নৃপতিকুলকালান্তক [কৌরবগণের ক্ষয়কর] ঘোরতর সংগ্রামে অসংখ্য বীর, রথী, সারথি, মহাপতাকাযুক্ত সুবৰ্ণরজ্জু-সুশোভিত গজ, অশ্ব ও পদাতিসমুদয় অর্জ্জনের ঐন্দ্র, নিশিত নারাচ, ভল্ল শরনিকরে দৃঢ়াহত ও ভিন্নদেহ হইয়া প্ৰাণ পরিত্যাগপূর্ব্বক সহসা ধরাতালে নিপতিত হইতে লাগিল। ভূপতিগণের ধ্বজসমুদয় মহাবীর ধনঞ্জয়বিমুক্ত ঐন্দ্র অস্ত্রে ছিন্নযন্ত্র [সমরসঙ্কেতজ্ঞাপক যন্ত্রাদি ছিন্ন] ও নিহতেন্দ্ৰজাল [মায়াজালবিযুক্ত—শত্রুসৈন্যের মোহ জন্মাইবার জন্য নিযুক্ত কুহক পরিত্যক্ত] হইয়া সেনামুখে পতিত হইল। মহাবীর কিরীটীর শরে যোদ্ধৃগণের শরীর ক্ষতবিক্ষত হইয়া রুধিরধারা নিপতিত হওয়াতে রণস্থলে মহাবৈতরণীসদৃশ শোণিত নদী প্রবাহিত হইল; নরগণের মেদ উহার ফেনস্বরূপ, মৃত নাগ ও অশ্বগণের শরীর তীরস্বরূপ, নরদিগের মজা ও মাংস কর্দ্দমস্বরূপ, অসংখ্য রাক্ষসগণ তীরস্থ বৃক্ষস্বরূপ এবং মনুষ্যগণের কেশকলাপ শাদ্বলম্বরূপ, বিকীর্ণ কবচসমুদয় তরঙ্গস্বরূপ, নর, নাগ ও অশ্বসমুদয়ের অস্থিসকল কক্করণস্বরূপ [কাঁকর] হইয়া শোভা পাইতে লাগিল। ঐ নদীতে সহস্ৰ সহস্র নরকলেবর প্লবমান হইতে এবং গোমায়ু, শালাবৃক, তরক্ষু ও ক্রব্যাদগণ ঐ নদীর কূলে অবস্থান করিতে লাগিল।
বহু কৌরবসৈন্য হতাহত—যুদ্ধের বিশ্রাম
“অর্জ্জুন-বাণপ্রভাবে মেদ, বসা ও রুধিরাবাহিনী নদী সমুৎপন্ন হইয়াছে এবং আরাতিকুলভয়াবহ মহাবীর ধনঞ্জয় কৌরবসৈন্যসমূদয়ের মধ্যে বীরপুরুষসকলকে নিহত করিয়াছেন দেখিয়া চেদি, পাঞ্চাল, করূষ, মৎস্য ও পাণ্ডবগণ একত্র হইয়া জয়প্ৰগলভচিত্তে কৌরবপক্ষীয় যোদ্ধৃগণকে সন্ত্ৰাসিত করিয়া বীরনাদ করিতে লাগিলেন। সিংহ যেমন মৃগগণকে ত্ৰাসিত করে, তদ্রূপ গাণ্ডীবধারী ধনঞ্জয় ও মহাত্মা বাসুদেব কৌরবসেনাগণকে বিত্ৰাসিত করিয়া হৃষ্টচিত্তে সিংহনাদ করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সময় শস্ত্রবিক্ষতাঙ্গ ভীষ্ম, দ্রোণ, দুৰ্য্যোধন ও বাহ্লীকপ্রভৃতি কৌরবপক্ষীয় বীরগণ সূৰ্য্যকে সংবৃতরশ্মি [অস্তগমনোন্মুখ] সন্ধ্যা সমাগত ও অর্জ্জুন-নির্ম্মুক্ত ভীষণ ঐন্দ্রাস্ত্ৰ বিতত [সর্ব্বত্র ব্যাপ্ত] দেখিয়া সংগ্রামে ক্ষান্ত হইলেন। মহাবীর ধনঞ্জয়ও অরাতিকুল বিমৰ্দনপূর্ব্বক অসাধারণ যশ ও কীর্ত্তি লাভ করিয়া ভ্রাতৃগণসমভিব্যাহারে শিবিরে গমন করিলেন।
“ঐ সময় কৌরবগণের শিবিরে ঘোরতর শব্দ সমুত্থিত হইল। “হে মহারাজ! মহাবীর ধনঞ্জয় সংগ্রামে অযুত রথ ও সপ্তশত গজ এবং প্রাচ্য, সৌবীর ও ক্ষুদ্রক মানবগণকে সংহার করিয়াছেন, উনি যেরূপ মহৎ কাৰ্য্য করিয়াছেন, উহা অন্যের অসাধ্য। ঐ মহারথ স্বীয় বাহুবলপ্ৰভাবে অম্বষ্ঠপতি, শ্রুতায়ু, দুর্ম্মর্ষণ, চিত্ৰসেন, দ্ৰোণ, কৃপ, সৈন্ধব, বাহ্লীক, ভূরিশ্রবা, শল, শল্য ও ভীষ্মপ্রভৃতি অন্যান্য সহস্ৰ সহস্ৰ বীরপুরুষগণকে পরাজিত করিয়াছেন।” কৌরবপক্ষীয় সৈন্যগণ এই বলিতে বলিতে রণস্থল হইতে সহস্ৰ সহস্র উল্কা ও প্রদীপে সমুজ্জ্বল শিবির মধ্যে গমনপূর্ব্বক বাস করিতে লাগিলেন।”