মুনি বলে, শুন পরীক্ষিৎ বংশধর।
কাম্যবনে নিবসরে চারি সহোদর।।
হেনকালে আইল লোমশ মুনিবর।
দীপ্তিমান তেজ যেন দীপ্ত বৈশ্বানর।।
মুনি দেখি যুধিষ্ঠির সহ ভ্রাতৃগণ।
প্রণাম করিয়া দেন বসিতে আসন।।
জিজ্ঞাসেন কি হেতু আইলা মুনিবর।
আশিস্ করিয়া মুনি করিল উত্তর।।
ইচ্ছা অনুসারে আমি করি পর্য্যটন।
একদিন সুরপুরে করিনু গমন।।
দেখিয়া আশ্চর্য্যবোধ করিলাম মনে।
ইন্দ্রসহ ধনঞ্জয় বৈসে একাসনে।।
আমারে কহিল তবে সহস্র লোচন।
যুধিষ্ঠির স্থানে তুমি করহ গমন।।
কহিবে সংবাদ এই তাঁহার গোচরে।
কুশলে নিবসে পার্থ অমর নগরে।।
দেবকার্য্য সাধি অস্ত্র পারগ হইলে।
আসিবেন ধনঞ্জয় কতদিন গেলে।।
ভ্রাতৃগণ সহ তুমি তীর্থে কর স্নান।
তপ আচরণ কর, দ্বিজে দেহ দান।।
তপের উপর আর অন্য কর্ম্ম নাই।
যাহা ইচ্ছা হয় তাহা তপোবলে পাই।।
কিন্তু আমি কর্ণেরে যে ভালমতে জানি।
অর্জ্জুনের ষোল অংশে তারে নাহি গণি।।
তার ভয় অন্তরে যে আছে ধর্ম্মরায়।
তাহা ত্যজ, ধর্ম্ম তার করিবে উপায়।।
তব ভ্রাতা পার্থ যে কহিল সমাচার।
নিবেদন করি শুন কুন্তীর কুমার।।
হিমালয়ে হৈমবতী করিয়া সেবন।
সুরাসুরে অগোচর পাইয়াছে ধন।।
সমুদ্র মথনে যেই অস্ত্র উপজিল।
মন্ত্র সহ পাশুপত পশুপতি দিল।।
যে অস্ত্র থাকিলে হস্তে ত্রৈলোক্য বিজিত।
হেন অস্ত্র দিল হর হয়ে হরষিত।।
কুবের বরুণ যম দিল অস্ত্রগণ।
সম্প্রীতে আছে সে সুখে ইন্দ্রের ভবন।।
নৃত্য গীত বিশ্বাবসু তনয়া শিখায়।
তার হেতু তাপ নাহি ভাব সর্ব্বদায়।।
আমারে বলিল পুণঃ বিনয় বচন।
আপনি থাকিয়া তীর্থ করাবে ভ্রমণ।।
তীর্থে নিবসয়ে দৈত্য দানব দুর্জ্জন।
তুমি রক্ষা করিবে গো মোর ভ্রাতৃগণ।।
রাখিল দধীচি যথা দেব পুরন্দরে।
অঙ্গিরা রাখিল যথা দেব দিবাকরে।।
ইন্দ্রের বচনে তব অনুজ সম্মতি।
তীর্থস্থানে নরপতি চল শীঘ্রগতি।।
দুইবার দেখিয়াছি তীর্থ আছে যথা।
তব সহ যাইব তৃতীয়বার তথা।।
বিষম সঙ্কট স্থানে আছে তীর্থগণ।
বিনা সব্যসাচী যেতে নারে অন্যজন।।
তুমিও যাইতে রাজা পার ধর্ম্মবলে।
পরাক্রম বিশেষ অনুজগণ মিলে।।
হইবে বিপুল ধর্ম্ম, অধর্ম্মের ক্ষয়।
নিজরাজ্য পাবে শেষে, হবে শত্রু জয়।।
লোমশের বচন শুনিয়া যুধিষ্ঠির।
আনন্দেতে পুলকিত হইল শরীর।।
বিনয় পূর্ব্বক করিলেন সদুত্তর।
কহে নহে, সুধাবৃষ্টি কৈলা মুনিবর।।
কি বলিব প্রত্যুত্তর মুখে না আইসে।
বাঞ্ছা পূর্ণ লাগি মোর তব কৃপাবশে।।
যে অর্জ্জুন লাগি মোর নাহি ক্ষণ সুখ।
চক্ষু মেলি নাহি চাহি ভ্রাতৃগণ মুখ।।
পাইলাম তাহার কুশল সমাচার।
ইহার অধিক লাভ কি আছে আমার।।
সবার ঈশ্বর যেইইন্দ্র দেবরাজ।
আপনি করেন বাঞ্ছা অর্জ্জুনের কাজ।।
যে আজ্ঞা করিলে মুনি তীর্থের কারণ।
পূর্ব্ব হইতে আমি এই করিয়াছি পণ।।
বিশেষ আমার সঙ্গে যাবেন আপনি।
তীর্থযাত্রা মোর পক্ষে বহু লাভ গণি।।
লোমশ বলেন, রাজা যাইবে কি মতে।
এই দ্বিজগণ আছে তোমার সঙ্গেতে।।
বিষম দুর্গম পথ পর্ব্বত কানন।
ফল মূল নাহি মিলে, দুষ্ট জন্তুগণ।।
যাইতে নারিবে সবে থাকিলে সংহতি।
ইহা সবে বিদায় করহ নরপতি।।
যুধিষ্ঠির কহে তবে শুন দ্বিজগণ।
হস্তিনা নগরে সবে করহ গমন।।
যেই যাহা বাঞ্ছ, ধৃতরাষ্ট্রেরে মাগিবে।
নিজ নিজ বৃত্তি যদি তথা না পাইবে।।
পাঞ্চাল দেশেতে সবে করিবে গমন।
যথোচিত পূজা তথা পাবে সর্ব্বজন।।
এত বলি সবারে পাঠান হস্তিনায়।
যোগ্য বৃত্তি দিল ধৃতরাষ্ট্র সে সবায়।।
অল্প দ্বিজ সঙ্গে নিয়া ধর্ম্ম নরপতি।
তিন রাত্রি বঞ্চি তথা লোমশ সংহতি।।
চারি ভাই কৃষ্ণা সহ ধৌম্য পুরোহিত।
তীর্থ করিবারে যাত্রা করেন ত্বরিত।।
হেনকালে উপনীত কৃষ্ণদ্বৈপায়ন।
নারদ পর্ব্বত আর বহু মুনিগণ।।
যথোচিত পূজিলেন ধর্ম্মের নন্দন।
আশিস্ করিয়া কহিছেন মুনিগণ।।
তীর্থযাত্রা করিবারে যদি আছে মন।
মন শুদ্ধ কর রাজা করিয়া যতন।।
নিয়মী সুবুদ্ধি হৈলে তীর্থফল পায়।
মন শুদ্ধ কর রাজা করিয়া যতন।।
নিয়মী সুবুদ্ধি হৈলে তীর্থফল পায়।
মন শুদ্ধ নহিলে সকলি মিথ্যা হয়।।
চারি ভাই কৃষ্ণা সহ করিয়া স্বীকার।
মুনিগণ চরণে করেন নমস্কার।।
অভেদ্য কবচ সবে অঙ্গেতে পরিল।
দ্রৌপদী সহিত রাজা রথে আরোহিল।।
পুরোহিত আদি আর যত ভ্রাতৃগণ।
চতুর্দ্দশ রথে আরোহিল সর্ব্ব জন।।
মার্গশীষ মাস গেল, পূর্ব্বমুখে গতি।
তীর্থযাত্রা করিলেন পাণ্ডব সুকৃতী।।
মহাভারতের কথা পুণ্যফল দাতা।
কাশীদাস রচে পয়ার প্রবন্ধে গাঁথা।।