৫৭তম অধ্যায়
স্বয়ংবরসভায় দময়ন্তীর পতি-অন্বেষণ
বৃহদশ্ব কহিলেন, “মহারাজ ভীম শুভ কাল, পুণ্য তিথি ও পবিত্ৰ ক্ষণে মহীপালগণকে স্বয়ংবরসভায় আহ্বান করিলেন। পার্থিবেরা রাজসন্দেশ-শ্রবণমাত্র অতিমাত্র ব্যস্ত ও মদনবাণে একান্ত আহত হইয়া দময়ন্তীলাভলোভে তথায় আগমন করিতে লাগিলেন। কেশরী যেমন গিরিমধ্যে প্রবেশ করে, তদ্রূপ মণিকুণ্ডলালকৃত সুগন্ধি মাল্যধারী ধরাপতিগণ কনক-স্তম্ভযুক্ত তোরণরাজিবিরাজিত রঙ্গস্থলে প্রবেশ করিয়া বহুবিধ বিচিত্র আসনে আসীন হইলেন। যেমন ব্যাঘ্রসমূহ গিরিগুহা ও ভুজঙ্গ মগণে ভগবতী ভোগবতী সম্পূর্ণ হয়েন, তদ্রূপ সেই সমিতিমণ্ডপ ভূপালগণে পরিপূর্ণ হইয়া অনির্ব্বচনীয় শোভা সম্পাদন করিল। তথায় রাজপুরুষদিগের চিক্কণমনোহর অর্গলতুল্য পীন ভুজযুগল পঞ্চশীর্ষ ভুজযুগর ন্যায় পরিদৃশ্যমান হইতে লাগিল। যাদৃশ নভোমণ্ডলে নক্ষত্রগণ শোভমান হয়, তদ্রূপ কচনিচয়াচুম্বিত [সুকেশ-শোভিত], সুচারু নয়নালকৃত, নাসাপুটমণ্ডিত পার্থিবদিগের মুখমণ্ডল-সকল বিরাজমান হইতে লাগিল।
“অনন্তর দময়ন্তী স্বীয় প্রভাপ্রভাবে ভূপালগণের নয়ন-মন অপহরণ করিয়া রঙ্গস্থলে প্ৰবেশ করিলেন। রাজগণ নির্নিমেষলোচনে রাজনন্দিনী দময়ন্তীকে সন্দর্শন করিতে লাগিলেন; তাহাদিগের চক্ষু ক্ষণকালের নিমিত্তও লক্ষ্যান্তরে পরিচালিত হইল না। পরে অধিকৃত লোকেরা ভূপালগণের নামোল্লেখ করিতে লাগিল। এই অবসরে ভীমদুহিতা দময়ন্তী নির্ব্বিশেষাকার পুরুষপঞ্চক [নল ও তদীয় অভিন্নমূর্ত্তি ইন্দ্ৰাদি দেবচতুষ্টয়] নিরীক্ষণপূর্ব্বক সাতিশয় সন্দিহান হইয়া নল-রাজাকে নিরূপণ করিতে পারিলেন না। তিনি তখন তাঁহাদিগের মধ্যে যাঁহাকে অবলোকন করিলেন, তাঁহারই প্রতি নলভ্রান্তি জন্মিয়া উঠিল। তখন দময়ন্তী অসীম চিন্তাসাগরে নিতান্ত নিমগ্ন হইয়া মনে করিলেন, আমি কিরূপে দেবগণকে জানিতে পারিব ও নলরাজকেই বা কি প্রকারে নিরূপণ করিব? ইহা চিন্তা করিতেছেন, এই অবসরে স্থবিরপরম্পরায় শ্রুতপূর্ব্ব দেবচিহ্নের বিষয় সহসা তাহার মনোমধ্যে উদিত হইল। কিন্তু তিনি ভূতলস্থ সেই পঞ্চপুরুষের মধ্যে কাহাকেও তাদৃশ লক্ষণাক্রান্ত দেখিতে পাইলেন না।
“তিনি এইরূপে বারংবার নানাপ্রকার বিচার করিয়াও নিঃসন্দিগ্ধ হইতে অসমর্থ হইয়া পরিশেষে দেবগণের শরণাপন্ন হইলেন এবং বাক্য-মনে দেবগণকে নমস্কার করিয়া কম্পিত্যকলেবরে কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, “আমি হংসের বাক্য শ্রবণ করিয়া অবধি নৈষধকেই পতিত্বে বরণ করিয়াছি; অতএব হে দেবগণ! এক্ষণে যথার্থরূপে তাঁহাকে নির্দেশ করুন। আমি যেন অন্য-পুরুষগামিনী হইয়া জ্ঞানতঃ পাপচারিণী না হই। অতএব হে সুরগণ! এক্ষণে যথার্থরূপে তাঁহাকেই নির্দেশ করুন। দেবতারা নলরাজকেই আমার পতিরূপে নির্ণীত করিয়াছেন; অতএব হে দেবগণ! এক্ষণে যথার্থরূপে তাঁহাকেই নির্দেশ করুন। আমি নললাভের নিমিত্ত ব্ৰতানুষ্ঠান করিতেছি; অতএব হে দেবগণ! এক্ষণে যথার্থরূপে তাঁহাকে নির্দেশ করুন। আপনার স্বীয় স্বীয় আকার স্বীকার করিলেই আমি পুণ্যশ্লোক নল-ভূপতিকে নিরূপণ করিতে পারিব।”
দময়ন্তীর নলবরণ
“দেবগণ দময়ন্তীর এইরূপ কারুণ্যপূর্ণ পরিবেদনবাক্য শ্রবণ করিয়া নলেই ইঁহার প্রগাঢ় অনুরোধ, মনোবিশুদ্ধি, বুদ্ধি ও ভক্তি দৃঢ় রূপে সংযুক্ত হইয়াছে বোধ করিয়া স্বীয় স্বীয় চিহ্ন ধারণ করিলেন। তখন দময়ন্তী, স্বেদবিন্দুবিরহিত স্তব্ধনেত্ৰ অম্লান পরাগশূন্য মাল্যধারী, ভূতলস্পর্শশূন্য ও শূন্যাসনোপবিষ্ট সুরগণ ও নিমেষযুক্তনেত্র, স্নান ও পরাগসহকৃত মাল্যধারী, ছায়ানুগতিকায়, স্বেদসমন্বিত ও ভূপৃষ্ঠোপবিষ্ট পুণ্যশ্লোক নলকে নিরীক্ষণ করিয়া হৃষ্ট হইলেন।
“অনন্তর লজ্জাবনতমুখী বৈদর্ভী বস্ত্ৰাঞ্চল গ্রহণ করিয়া বরমাল্য প্রদানপূর্ব্বক নলরাজকে পতিত্বে বরণ করিবামাত্র তত্ৰস্থ নরপতিগণ হাহাকার করিতে লাগিলেন এবং দেব ও মহর্ষিগণ বিস্মিত হইয়া নলের বহুবিধ প্রশংসা করিয়া সাধুবাদ প্রদান করিয়া উঠিলেন। নলরাজ প্রীত ও প্ৰসন্ন-মনে দময়ন্তীকে আশ্বাসদানপূর্ব্বক কহিলেন, “হে কল্যাণি! তুমি সুরগণসন্নিধানে আমাকেই ভজনা করিলে, এক্ষণে আমি তোমার ভর্ত্তা ও বচনানুবর্ত্তী হইলাম। সত্যই কহিতেছি, আমি যতদিন জীবনধারণ করিব, ততকাল তোমারই প্ৰণয়পরবশ হইয়া থাকিব।” দময়ন্তীও নিষধাধিপতিকে ঐ রূপ প্রণয়সম্ভাষণপূর্ব্বক সাতিশয় অভিনন্দন করিলেন।
নলের বরলাভানন্তর দময়ন্তী-পরিনয়
‘অনন্তর তাহারা পরস্পর প্রীতি ও প্রসন্ন হইয়া হুতাশন-প্রমুখ দেবগণকে অবলোকনপূর্ব্বক মনে মনে তাঁহাদিগেরই শরণ-গ্ৰহণ করিলে, লোকপালগণ প্ৰহৃষ্টমনে নলরাজকে আটটি বর প্রদান করিলেন। শচীপতি ইন্দ্ৰ প্ৰসন্ন হইয়া কহিলেন, “হে নল! তুমি বরপ্রভাবে আমার প্রত্যক্ষদর্শন ও চরমে পরামগতিলাভ করিবে।” অগ্নি কহিলেন, “হে নৈষধ! তুমি যথায় অভিলাষ করিবে, তথায় আমি আবির্ভূত হইব এবং আত্মসদৃশ লোকসকল দান করিব।” যম কহিলেন, “হে নল! তুমি যদৃচ্ছাক্রমে রন্ধন করিলে তাহা সুস্বাদু হইবে ও তোমার ধর্ম্মনিষ্ঠাও অবিচলিত হইয়া থাকিবে।” বরুণ কহিলেন, “হে নল! তুমি যথায় ইচ্ছা করিবে, আমি তথায় আবির্ভূত হইব। এক্ষণে এই চিরস্থায়ী সুগন্ধি মাল্য গ্ৰহণ কর।” এইরূপে লোকপালগণ বরপ্রদান করিয়া স্বৰ্গে প্রস্থান করিলে নৃপতিগণ নল-দময়ন্তীর বিবাহ সন্দর্শন করিয়া স্ব স্ব স্থানে প্রতিগমন করিলেন। অনন্তর মহারাজ ভীম প্রীতমনে স্বীয় তনয়ার বৈবাহিক-কাৰ্য্য সম্পাদনা করিলে নলরাজ যদৃচ্ছাক্রমে তথায় কিয়দ্দিবস বাস করিয়া ভীমের আদেশানুসারে স্বকীয় নগরে প্রত্যাগমন করিলেন। পরে যাদৃশ দেবরাজ শচীর সহিত আমোদ করেন, সেইরূপ নলরাজ রমণীরত্ন দময়ন্তীকে লাভ করিয়া তাঁহার সহিত আমোদ-প্ৰমোদে কালব্যাপন করিতে লাগিলেন। তিনি দিনকরের ন্যায় প্রতাপশালী হইয়া হৃষ্টমনে ধর্ম্মমার্গানুসারে রাজকার্য্য পর্য্যালোচনা করিয়া প্রজাদিগকে অনুরক্ত করিলেন; পরে ভূরিদক্ষিণ অশ্বমেধ ও অন্যান্য বহুবিধ যজ্ঞ সম্পন্ন করিয়া পরিশেষে পরমরমণীয় বন ও উপবনে অভিলাষানুসারে দময়ন্তীর সহিত বিহার করিতে লাগিলেন। কিয়ৎকাল গত হইলে মহারাজ নল দময়ন্তীর গর্ভে ইন্দ্ৰসেননামে এক পুত্র ও ইন্দ্ৰসেনানামী এক কন্যা লাভ করিলেন। হে মহারাজ! এইরূপে বসুধাধিপতি নৈষধ যাগ-যজ্ঞ সম্পাদনাপূর্ব্বক বিহার করিয়া বসুপূর্ণ বসুধাকে রক্ষা করিয়াছিলেন।”