৫৬তম অধ্যায়
যুধিষ্ঠির-প্রশ্নে ভীষ্মের রাজধৰ্ম্ম-কীৰ্ত্তন
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! তখন রাজা যুধিষ্ঠির ভীষ্ম ও বাসুদেবকে নমস্কার ও অন্যান্য গুরুজনদিগকে যথোচিত সম্মান করিয়া ভীষ্মকে কহিলেন, “পিতামহ! ধৰ্ম্মবিৎ মহাত্মারা কহিয়া থাকেন, রাজাদিগের পক্ষে রাজধৰ্ম্মই সকল ধৰ্ম্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ পদার্থ। ঐ ধৰ্ম্মের ভার বহন করা নিতান্ত সুকঠিন; অতএব আপনি সবিস্তার সেই রাজধৰ্ম্মের বিষয় কীৰ্ত্তন করুন। ঐ ধৰ্ম্মই এই জীবলোকের একমাত্র অবলম্বন। ধর্ম্মার্থকামের সহিত উহার বিলক্ষণ সংশ্রব আছে এবং রশ্মি যেমন অশ্বকে এবং অঙ্কুশ যেমন কুঞ্জরকে নিয়ন্ত্রিত করে, তদ্রূপ রাজধৰ্ম্ম সমুদয় লোককেই নিয়ন্ত্রিত করিয়া রাখিয়াছে। রাজা যদি রাজধৰ্ম্ম-প্রতিপালনে অক্ষম হয়েন, তাহা হইলে লোকসকল কখনই সুশৃঙ্খল থাকে না। দিবাকর যেমন উদিত হইয়া অন্ধকার বিনাশ করেন, তদ্রূপ রাজধৰ্ম্ম উদ্যত হইয়া লোকের অপ্রত্যক্ষ নরকভয় নিবারণ করিয়া থাকে। অতএব হে পিতামহ! আপনি এক্ষণে আমাকে সেই রাজধৰ্ম্মের উপদেশ প্রদান করুন। আপনা হইতেই আমাদিগের শাস্ত্রজ্ঞান সমুৎপন্ন হইয়াছে। আর মহাত্মা বাসুদেবও আপনাকে বুদ্ধিমানদিগের শ্রেষ্ঠ বলিয়া কীৰ্ত্তন করিতেছেন।”
ধৰ্ম্মরাজ এই কথা কহিলে মহাত্মা ভীষ্ম তাঁহাকে সম্বোধন পূৰ্ব্বক কহিলেন, “বৎস! আমি ধৰ্ম্ম, জগদ্বিধাতা কৃষ্ণ ও ব্রাহ্মণগণকে নমস্কার করিয়া শাশ্বত রাজধৰ্ম্ম কীৰ্ত্তন করিতেছি, অবহিত হইয়া উহা এবং অন্য যাহা কিছু তোমার অভিলাষ থাকে, তৎসমুদয় শ্রবণ কর।
দেবদ্বিজাদির গৌরবে রাজধৰ্ম্মের উৎকর্ষ
“রাজার সর্বাগ্রে দেবতা ও দ্বিজগণের প্রতিসম্পাদনের নিমিত্ত বিধানানুসারে যত্ন করা কর্ত্তব্য। দেবতা ও ব্রাহ্মণগণকে যথোচিত উপচারে অর্চ্চনা করিলে রাজা ধৰ্ম্মের ঋণজাল হইতে বিমুক্ত ও সকলের আদরভাজন হইয়া থাকেন। পুরস্কারদ্বারা কাৰ্য্যসাধন করিতে প্রযত্ন করাই রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। পৌরুষবিরহিত দৈবকাৰ্য্য ভূপালগণের কোন ফলোপধায়ক হয় না। দৈব ও পুরুষকার এই উভয়েরই প্রভাব তুল্য! কিন্তু তন্মধ্যে পৌরুষ প্রত্যক্ষ ফল উৎপন্ন করে বলিয়া শ্রেষ্ঠ; আর দৈব ফলসিদ্ধিদ্বারা নির্ণীত হয় বলিয়া দৈবকে পুরুষকার অপেক্ষা। কিঞ্চিৎ ন্যূন বলিয়া গণনা করা যায়। কাৰ্য্য আরম্ভ করিলে যদি কোন ব্যাঘাত জন্মে, তাহাতে কিছুমাত্র সন্তপ্ত হইও না, প্রত্যুত যাহাতে কার্য্যসিদ্ধি হয়, তদ্বিষয়ে গাঢ়তর যত্ন করিবে। পণ্ডিতগণের মতে উহাই ভূপতিদিগের কাৰ্য্যসম্পাদনের একমাত্র উপায়। সত্য ব্যতিরেকে ভূপালগণের ফলসিদ্ধির কোন সম্ভাবনাই নাই। সত্যপরায়ণ রাজা ইহলোক ও পরলোকে আনন্দিত হইয়া থাকেন। সত্য মহর্ষিগণেরও পরমধন। সত্য অপেক্ষা রাজার বিশ্বাসের কারণ আর কিছুই নাই। গুণবান, সচ্চরিত্র, অতিবদান্য, শান্ত প্রকৃতি, ধর্ম্মপরায়ণ, জিতেন্দ্রিয় ও প্রিয়দর্শন রাজা কদাচ শ্রীভ্রষ্ট হয়েন না। সমস্ত কাৰ্য্যে সরলভাব অবলম্বনপুৰ্ব্বক সত্যবাক্য প্রয়োগ করিবে। স্বচ্ছিদ্র গোপন ও পরিচ্ছিদ্রান্বেষণাদি কার্য্যের অনুষ্ঠানসময়ে মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ করাও দোষাবই নহে। রাজা অতিশয় মৃদুস্বভাব হইলে লোকে তাঁহাকে পরাভূত করিয়া থাকে এবং অতিশয় উগ্ৰস্বভাব হইলে তাহাকে দেখিয়া সকলেই ভীত হয়; অতএব নিতান্ত মৃদুভাব বা নিতান্ত উগ্রভাব অবলম্বন না করা সৰ্ব্বতোভাবে অবিধেয়। ব্রাহ্মণগণের কদাচ দণ্ডবিধান করিবে না। ব্রাহ্মণ এই জীবলোকে সর্বোৎকৃষ্ট জীব বলিয়া অভিহিত হইয়া থাকে। এই বিষয়ে মনু যেরূপ আপনার অভিপ্রায় ব্যক্ত করিয়া গিয়াছেন, তাহা স্মরণ করা কর্ত্তব্য। মনুর মতে সলিল হইতে অগ্নি, ব্রাহ্মণ হইতে ক্ষত্রিয় এবং প্রস্তর হইতে লৌহ উৎপন্ন হইয়াছে। ইহাদিগের সৰ্ব্বব্যাপী তেজ স্ব স্ব উৎপত্তিস্থানে উপস্থিত হইলেই উপশমিত হইয়া যায়। লৌহ প্রস্তরকে চূর্ণন, অগ্নি সলিলকে শোষণ ও ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণকে বিনাশ করিতে উদ্যত হইলে অচিরাৎ আপনারাই অবসন্ন হইয়া পড়ে। হে যুধিষ্ঠির! ব্রাহ্মণেরাই পূজিত হইয়া ভূতলস্থ বেদ রক্ষা করিয়া থাকেন। অতএব ব্রাহ্মণগণ ক্ষত্রিয়দিগের নমস্য; কিন্তু যদি ব্রাহ্মণেরা অত্যাচারপরায়ণ হয়েন, তাহা হইলে তাঁহাদিগের দণ্ডবিধান অবশ্য কৰ্ত্তব্য। এ বিষয়ে মহর্ষি শুক্রাচার্য্য যেরূপ কহিয়াছেন, তাহা একাগ্রমনে শ্রবণ কর। ধর্ম্মপরায়ণ রাজা বেদবেদান্তপারগ ব্রাহ্মণকে রণস্থলে শস্ত্র উদ্যত করিয়া আগমন করিতে দেখিলে স্বধৰ্ম্মানুসারে প্রহার করিবেন। যিনি বিনাশোন্মুখ ধৰ্ম্মকে রক্ষা করিয়া থাকেন, তিনি যথার্থ ধার্ম্মিক; সুতরাং অধর্ম্মে প্রবৃত্ত ব্রাহ্মণকে প্রহার করিলে অধৰ্ম্মদোষে দূষিত হইতে হয় না; কেননা ক্রোধই সেই প্রহারের কারণ। যাহা হউক, ব্রাহ্মণকে বিনাশ করিয়া তাঁহার প্রাণরক্ষা করাই কৰ্ত্তব্য। ব্রাহ্মণ অপরাধী হইলে তাঁহাকে রাজ্য হইতে নিঃসারিত করিবে। ব্রাহ্মণ সত্য বা মিথ্যা দোষে লিপ্ত হইলে তাঁহার প্রতি দয়া প্রকাশ করিবে। ব্রাহ্মণ ব্রহ্মহত্যা, গুরুতল্প[গুরুপত্নী]গমন, ভ্রূণহত্যা[গর্ভস্থ সন্তাননাশ] অথবা রাজার প্রতি বিদ্বেষ করিলে তাঁহাকে রাজ্য হইতে নিষ্কাশিত[বহিষ্কৃত] করাই কৰ্ত্তব্য। কশাঘাতাদিদ্বারা ব্রাহ্মণের শারীরিক দণ্ডবিধান করা কোনক্রমেই বিধেয় নহে। যাহারা ব্রাহ্মণের প্রতি ভক্তিপ্রদর্শন করে, তাহারাই ভূপতির প্রিয়পাত্র হইয়া থাকে।
প্রজারঞ্জনাদির প্রয়োজনীয়তা
“লোকসংগ্রহ অপেক্ষা রাজাদিগের পরমধন আর কিছুই নাই। পণ্ডিতেরা ছয়প্রকার দুর্গমধ্যে নরদুর্গকেই নিতান্ত দুস্তর বলিয়া স্থির করিয়াছেন, অতএব বিজ্ঞলোকে সকলেরই প্রতি প্রতিনিয়ত দয়া প্রকাশ করিবেন। রাজা ধাৰ্ম্মিক ও সত্যবাদী হইলেই প্রজারঞ্জনে কৃতকাৰ্য্য হইতে পারেন। সৰ্ব্বদা ক্ষমাবান্ হওয়া রাজার কর্ত্তব্য নহে। একান্ত ক্ষমাশীল রাজা হস্তীর ন্যায় নিতান্ত অধম বলিয়া পরিগণিত হয়। গজনিয়ন্তা যেমন গজের মস্তকে আরোহণ করে, তদ্রূপ নীচ ব্যক্তি ক্ষমাশীল নরপতির মস্তকে পদার্পণ করিয়া থাকে; অতএব নিয়ত মৃদু বা নিয়ত তীক্ষ্ণ হওয়া রাজার কর্ত্তব্য নহে। বসন্তকালীন সূর্য্যের ন্যায় অনতিমৃদু ও অনতিতেজস্বী হইয়া থাকাই বিধেয়। সতত প্রত্যক্ষ, অনুমান, সাদৃশ্য ও শস্ত্রদ্বারা স্বকীয় ও পরকীয় মণ্ডল পরীক্ষা করা কর্ত্তব্য। ব্যসনে নিতান্ত আসক্ত হওয়া ও অপরিমিত ব্যয় করা একান্ত অনুচিত।
“রাজা ব্যসনাসক্ত হইলে নিয়ত পরাভূত হয়েন এবং নিতান্ত বিদ্বেষী হইলে প্রজাদিগকে উত্তেজিত করেন। গর্ভবতী স্ত্রী যেমন আপনার প্রিয় মনোরথ পরিত্যাগ করিয়া গর্ভেরই হিতসাধন করে, তদ্রূপ ধৰ্ম্মপরায়ণ নরপতিগণের স্বীয় সুখস্বাচ্ছন্দ্য পরিত্যাগপূৰ্ব্বক প্রজাদিগের হিতসাধন করাই বিধেয়।।
“হে ধৰ্ম্মরাজ! তুমি কদাচ ধৈৰ্য্য পরিত্যাগ করিও না। ধৈর্য্যশালী চতুরঙ্গ-বলসমাযুক্ত নরপতির কখনই ভয় উপস্থিত হয় না। ভৃত্যদিগের সহিত হাস্য-পরিহাস করা বিধেয় নহে। কারণ, তাহা হইলে উপজীবীরা প্রশ্রয়যুক্ত হইয়া স্বামীর অবমাননা করে। আপনার কর্ত্তব্য কার্য্যে মনোযোগ করে না। কোন কার্য্যসম্পাদনে আদেশ করিলে উহা যথার্থ করিতে হইবে কি না, মনে করিয়া সন্দিহান হয়; গোপনীয় বিষয় জানিবার চেষ্টা করে; অনুচিত বিষয়ে প্রার্থনা ও প্রভুর ভোজ্যদ্রব্য ভোজন করে, অনেক সময় স্বামীর প্রতিও ক্রুদ্ধ হইয়া উঠে; উৎকোচ[ঘুষ] গ্রহণ ও বঞ্চনার দ্বারা কাৰ্য্যহানি করিতে ত্রুটি করে না; কৃত্রিম পত্রপ্রেরণদ্বারা রাজাকে বিনষ্ট করে; অন্তঃপুররক্ষকগণের সমান বেশ ধারণ করিয়া অন্তঃপুরমধ্যে প্রবেশে উৎসুক হয়। প্রভুর সমক্ষে বায়ুনিঃসারণ ও নিষ্ঠীবনে[থুথু ফেলিতে] লজ্জিত হয় না; সতত প্রভুর বাক্যের প্রত্যুত্তর করে এবং তাঁহাকে অনাদর করিয়া তাঁহার অশ্ব, হস্তী ও অভিমত রথারোহণে প্রবৃত্ত হয়; সুহৃদ্ব্যক্তির ন্যায় সভাস্থ হইয়া, ‘মহারাজ! ইহা তোমার পক্ষে নিতান্ত দুষ্কর, ইহা তোমার অতি কুকর্ম্ম’ বলিয়া তিরস্কার করিতে থাকে। স্বামীকে ক্রুদ্ধ দেখিয়া পরিহাস করে; আপনারা সম্মানিত হইয়াও আহ্লাদিত হয় না; সতত কেবল হাস্য-পরিহাস করিয়াই কালক্ষেপ করে; রাজার মন্ত্রণা ও দুষ্কর্ম্মসমুদয় প্রকাশ করিয়া দেয়; নির্ভয়ে অবজ্ঞাসহকারে প্রভুর আজ্ঞা প্রতিপালন করে; প্রভু অলঙ্কার, ভোজনদ্রব্য বা স্নানীয় অনুলেপন আহরণ করিতে কহিলে নির্ভয়ে তাঁহার সমক্ষে দণ্ডায়মান থাকিয়া আপনাদিগের কাৰ্য্যের নিন্দা ও উহা পরিত্যাগ করে; বেতনলাভে সন্তুষ্ট না হইয়া আবার রাজকর অপহরণ করে; সূত্রবদ্ধ পক্ষীর ন্যায় প্রভুকে লইয়া ক্রীড়া করিতে উৎসুক হয় এবং লোকসমাজে ‘রাজা আমাদিগের বাধ্য’ বলিয়া গৰ্ব্ব প্রকাশ করে। নরপতি আমোদপরায়ণ ও মৃদুস্বভাব হইলে এইরূপ নানাপ্রকার দোষ প্রাদুর্ভূত হইতে থাকে।”