৫৬তম অধ্যায়
পাণ্ডবগণের বলবৰ্ণন
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “সঞ্জয়! পাণ্ডবগণের প্রতি প্রতিবশতঃ আমাদিগের সেনাগণের সহিত সংগ্রাম করিবার নিমিত্ত কোন কোন বীরগণ সমাগত হইয়াছে, অবলোকন করিলে?”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! দেখিলাম, বৃষ্ণি ও অন্ধকবংশের প্রধান বাসুদেব ও চেকিতান আগমন করিয়াছেন; সুবিখ্যাত মহারথ পুরুষমানী যুযুধান ও সাত্যকি উভয়ে পৃথক পৃথক অক্ষৌহিণীসমভিব্যাহারে পাণ্ডবগণের সহিত মিলিত হইয়াছেন; পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ, সত্যজিৎ, ধৃষ্টদ্যুম্ন ও শিখণ্ডী প্রভৃতি পুত্ৰগণসহ অক্ষৌহিণী সেনায় পরিবৃত হইয়া সমুদয় সৈন্যের শরীর আচ্ছাদিত করিয়া পাণ্ডবগণের মানবৰ্দ্ধনপূর্ব্বক উপস্থিত হইয়াছেন; পৃথিবীপাল বিরাট, শঙ্খ ও উত্তরপ্রভৃতি পুত্র, ভ্রাতৃগণ এবং এক অক্ষৌহিণী সেনাসমভিব্যাহারে অজাতশত্রুকে আশ্রয় করিয়াছেন; পৃথক পৃথক অক্ষৌহিণীপরিবৃত মগধরাজ জরাসন্ধানন্দন ও চেদিরাজ ধৃষ্টকেতু পাণ্ডবগণের অনুগত হইয়াছেন; লোহিতধ্বজ কেকায়েরা পঞ্চভ্রাতা অক্ষৌহিণী লইয়া তাঁহাদিগের সহিত মিলিত হইয়াছেন।
“মনুষ্য, দৈব, গন্ধর্ব্ব ও আসুর বৃহবেত্তা মহারথ ধৃষ্টদ্যুম্ন সেনাগণের অগ্রে অবস্থান করিবেন। শান্তনুনন্দন ভীষ্ম শিখণ্ডীর অংশে পরিকল্পিত হইয়াছেন; বিরাটরাজ মৎস্যদেশীয় যোদ্ধৃগণের সহিত সেই শিখণ্ডীর সাহায্য করিবেন। বলবান মাদ্রাধিপতি যুধিষ্ঠিরের অংশে [*প্রতিযোদ্ধৃরূপে নির্ব্বাচিত—যুধিষ্ঠির-শল্যে যুদ্ধ হইবে] পরিকল্পিত [*] হইয়াছেন। কেহ কেহ এই ব্যবস্থা অসদৃশ হইয়াছে বলিয়া উল্লেখ করিতেছে। দুৰ্য্যোধন, তাঁহার শতভ্রাতা ও প্রাচ্য ও দক্ষিণাত্য বীরগণ, ভীমসেনের অংশে কল্পিত হইয়াছেন। কর্ণ, অশ্বত্থামা বিকৰ্ণ, সিন্ধুরাজ জয়দ্ৰথ প্রভৃতি যত শূরাভিমানী অজেয় বীরপুরুষ আছেন, ধনঞ্জয় তাঁহাদের সমুদয়কেই আপনার অংশে কল্পনা করিয়াছেন। মহাধনুৰ্দ্ধর কেকায়েরা পঞ্চভ্রাতা কৈকয়গণকে সমভিব্যাহারে লইয়া যুদ্ধ করিবেন; মালব ও শাম্বকগণ এবং সংসপ্তক বলিয়া বিখ্যাত ত্ৰিগর্ত্তদেশীয় বীরদ্বয় তাঁহাদের অংশে কল্পিত হইয়াছেন। দুৰ্য্যোধন ও দুঃশাসনের পুত্ৰগণ এবং রাজা বৃহদ্বল সুভদ্ৰানন্দনের অংশে পতিত হইয়াছেন। সুবৰ্ণধ্বজ মহাধনুৰ্দ্ধর দ্ৰৌপদেয় ও ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রভৃতি বীরগণ দ্রোণাচাৰ্য্যকে আক্রমণ করিবেন। চেকিতান সোমন্দত্তের সহিত দ্বৈরথ-যুদ্ধে সমুৎসুক হইয়াছেন। যুযুধান ভোজরাজ কৃতবর্ম্মার সহিত সংগ্রাম করিবেন। ইন্দ্ৰসম যোদ্ধা সহদেব স্বয়ং আপনার শ্যালক শকুনির সহিত যুদ্ধ করিবার সংকল্প করিয়াছেন। কৈতব্য উলুক ও সারস্বতগণ নকুলের ভাগে পরিকল্পিত হইয়াছেন। এতদ্ভিন্ন আর যেসকল রাজা যুদ্ধে গমন করিবেন, তাহাদিগের নাম নির্দ্দেশপূর্ব্বক স্ব স্ব অংশে কল্পনা করিয়াছেন। ইহাদিগের সেনাগণ এবম্প্রপ্রকার ভাগানুসারে বিভক্ত হইয়াছে, এক্ষণে আপনার ও যুবরাজদিগের যাহা কর্ত্তব্য,
পাণ্ডবভীত ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি দুৰ্য্যোধনসান্ত্বনা
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! আমার দ্যূতপরায়ণ ব্যসনাসক্ত মূঢ়মতি পুত্ৰগণ রণক্ষেত্রে বলবান ভীমসেনের সহিত যুদ্ধঘটনা হইলে কখনই জীবিত থাকিবে না। যেমন পতঙ্গগণ পাবকে প্রবেশ করে, সেইরূপ সমুদয় ভূপালগণ কালধৰ্মকর্ত্তৃক সংস্কৃত হইয়া গান্ডীবাগ্নিতে প্রবিষ্ট হইবে। আমার সেনাগণ কৃতবৈর পাণ্ডবগণের যুদ্ধে পলায়ন করিলে কে তাহাদের পশ্চাৎ গমন করিবে? পাণ্ডবগণ সকলেই অতিরণ, শৌৰ্য্যশালী, কীর্ত্তিমান, প্রতাপবান, সূৰ্য্য ও পাবকের ন্যায় তেজস্বী এবং সমরবিজয়ী। যুধিষ্ঠির যাঁহাদিগের নেতা, মধুসূদন রক্ষাকর্ত্তা এবং অর্জ্জুন, ভীম, নকুল, সহদেব, ধৃষ্টদ্যুম্ন, তাঁহার ভ্রাতৃগণ, সাত্যকি, দ্রুপদ, দুৰ্জয়, যুধামন্যু, শিখন্তী, ক্ষত্রদেব, বিরাটনন্দন উত্তর এবং বভ্রু, কাশী, চেদি, মৎস্য, সৃঞ্জয়, পাঞ্চল ও প্রভদ্রকগণ যাঁহাদিগের যোদ্ধা, দেবরাজও যাঁহাদিগের অধিকৃত পৃথিবী হরণ করিতে সমর্থ হয়েন না এবং যাঁহারা অনায়াসে পর্ব্বতশ্রেণীও বিদীর্ণ করিতে পারেন, আমার দুরাত্মা পুত্ৰগণ সেই সর্ব্বগুণসম্পন্ন অলৌকিক প্রতাপশালী পাণ্ডবগণের সহিত যুদ্ধ করিতে ব্যগ্র হইয়াছেন।”
দুৰ্য্যোধন কহিলেন, “তাত! পাণ্ডব ও কৌরব উভয় পক্ষই একজাতীয় এবং উভয় পক্ষই মনুষ্য; তবে আপনি কি নিমিত্ত কেবল পাণ্ডবগণেরই জয়লাভ আশঙ্কা করিতেছেন? পাণ্ডবগণের কথা দূরে থাকুক, দেবরাজ সমস্ত দেবগণের সহিত মিলিত হইয়াও ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, দুৰ্জয়, কৰ্ণ, জয়দ্ৰথ, সোমদত্ত ও অশ্বত্থামা, এই সমস্ত মহাধনুৰ্দ্ধর মহাতেজাঃ বীরগণকে জয় করিতে সমর্থ নহেন। শৌৰ্য্যশালী আৰ্য্য ভূমিপালগণ আমার নিমিত্ত শস্ত্র গ্রহণ করিলে অবশ্যই পাণ্ডবগণের সহিত যুদ্ধ করিতে সমর্থ হইবেন। পাণ্ডবেরা আমার সৈন্যগণকে প্রতিবীক্ষণ [দর্শন] করিতে সমর্থ হইবে না। প্রত্যুত আমি স্বপ্রভাবে তাহাদিগের সহিত যুদ্ধ করিব। আমার প্ৰিয়চিকীর্ষ পার্থিবগণই তাহাদিগকে রুদ্ধ করিবেন। পাঞ্চাল ও পাণ্ডবগণ আমার প্রকাণ্ড রথখণ্ড ও শরজালদ্বারা অভিভুত হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।”
ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে সঞ্জয়! আমার এই পুত্র উন্মত্তের ন্যায় প্ৰলাপবাক্য উচ্চারণ করিতেছেন, ইনি যুদ্ধে যুধিষ্ঠিরকে পরাজয় করিতে পরিবেন না; পাণ্ডব ও তাঁহাদিগের পুত্ৰগণ যে প্রকার বলবান, ভীষ্ম তাহা অবগত আছেন; এই নিমিত্ত সেই মহাত্মাগণের সহিত যুদ্ধ করা তাঁহার অভিপ্রেত নয়। সে যাহা হউক, পুনরায় তাঁহাদিগের বিচেষ্টিসকল [অধ্যাবসায়] কীর্ত্তন কর। কোন ব্যক্তি সেই মহাধনুৰ্দ্ধর পাণ্ডবগণকে সন্দীপিত করিতেছেন? কোন ব্যক্তি ঘৃতাহুতি প্রদানপূর্ব্বক সেই প্ৰজ্বলিত পাবকরাশি সন্ধুক্ষিত [প্রজ্বালিত] করিতেছেন?”
সঞ্জয় কহিলেন, “হে ভারত! ধৃষ্টদ্যুম্ন সর্ব্বদাই পাণ্ডবগণকে এই বলিয়া সমুত্তেজিত করিতেছেন যে, “হে পাণ্ডবগণ! যুদ্ধ করুন, ভীত হইবেন না; যেমন তিমি উদকমধ্য হইতে মৎস্যগণকে গ্ৰহণ করে, সেইরূপ যে কোন বীর দুৰ্য্যোধনকর্ত্তৃক সংবৃত হইয়া সেই শস্ত্রসঙ্কুল তুমুল যুদ্ধে আগমন করিবে, আমি একাকী তাহাদিগকে ও তাঁহাদের অনুবর্ত্তীদিগকে আক্রমণ করিব। যেমন বেলাভূমি মকরালয়কে [সমুদ্র] নিরুদ্ধ করে, সেইরূপ আমি ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, কর্ণ, দ্রোণি [অশ্বত্থামা], শল্য ও সুযোধনকে নিরুদ্ধ করিব।”
পাণ্ডবপক্ষের সমরে ঔৎসুক্য
“ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠির তাঁহার বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “হে বীর! পাঞ্চাল ও পাণ্ডবগণ সকলেই তোমার ধৈৰ্য্য ও বীৰ্য্যের উপর নির্ভর করিয়া আছে। তুমি আমাদিগকে সংগ্রাম হইতে উদ্ধার কর, আমরা তোমাকে ক্ষাত্রধর্মে দৃঢ়তর পক্ষপাতী বলিয়া অবগত আছি। সমরসমুৎসুক কৌরবগণ রণমুখে অগ্রসর হইলে তাহাদিগকে নিগৃহীত করিবার নিমিত্ত একমাত্র তোমারই পরাক্রম পৰ্য্যাপ্ত হইবে। তুমি যাহা করিবে, তাহা আমাদিগের শ্রেয়স্কর। নীতিজ্ঞেরা কহিয়াছেন, যাহারা সমরে ভঙ্গ দিয়া শরণার্থী হইয়া পলায়ন করে, যে বীর তাহাদিগকে সাহস প্ৰদান করিয়া অগ্ৰে পৌরুষ প্রদর্শনপূর্ব্বক দণ্ডায়মান হয়েন, সহস্ৰগুণ মূল্য প্রদান করিয়া তাঁহাকে ক্রয় করিবে। তুমি সেইরূপ শৌৰ্য্যশালী, বীর্য্যবান ও পরাক্রান্ত; তুমিই সমরসময়ে ভয়ার্ত্তগণের পরিত্রাতা হইবে।”
‘ধর্ম্মাত্মা যুধিষ্ঠির এইরূপ কহিতেছেন এবং আমারও অন্তঃকরণ ভয়ে ব্যাকুল হইতেছে, এমন সময়ে ধৃষ্টদ্যুম্ন আমাকে কহিলেন, “হে সূত! তুমি গমন করিয়া জনপদবাসী যোদ্ধা বাহ্লীক, কৌরব ও প্রতীপেয়গণ [বিপক্ষ-পক্ষাশ্রয়ী প্রতীপবংশধরগণ], কৃপ, দ্রোণ, অশ্বত্থামা, কৰ্ণ, জয়দ্ৰথ, দুঃশাসন, বিকৰ্ণ, ভীষ্ম ও রাজা দুৰ্য্যোধনকে বল, তাঁহারা শীঘ্র আগমন করুন, কোন মতে বিলম্ব না করেন।”
“মহারাজ! দেবরক্ষিত ধনঞ্জয় যেন আপনাদিগকে বধ না করেন, এই নিমিত্ত কোন সাধু ব্যক্তি রাজা যুধিষ্ঠিরের নিকটে গমন করুন। আপনারা ধর্ম্মরাজের রাজ্য ধর্ম্মরাজকে প্রদান করিবার নিমিত্ত তাঁহার নিকট শীঘ্র প্রার্থনা করুন। সত্যবিক্রম সব্যসাচীর ন্যায় যোদ্ধা পৃথিবীতে বিদ্যমান নাই; তিনি ঈদৃশ পরাক্রান্ত যে, দেবগণ তাঁহার দিব্যরথ বরণ করিয়াছিলেন। কোন মনুষ্য তাঁহাকে জয় করিতে সমর্থ হইবে না; অতএব আপনারা যুদ্ধাভিলাষ পরিত্যাগ করুন।”