৫৫তম অধ্যায়
কৃষ্ণবাক্যে যুধিষ্ঠিরের প্রতি ভীষ্মের অভয়বাণী
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! মহাত্মা মধুসূদন এই কথা কহিলে মহাবীর ভীষ্ম কহিলেন, “বাসুদেব! তুমি সর্ব্বভূতের আত্মা ও নিত্য পদার্থ। তোমার প্রসাদে আমার বাক্য ও মন দৃঢ় হইয়াছে; অতএব আমি অবশ্যই ধর্ম্মের বিষয় কীৰ্ত্তন করিব। এক্ষণে যে মহাত্মা রাজ্যভার গ্রহণ করাতে বৃষ্ণিগণ আনন্দিত হইয়াছেন; কৌরবগণের মধ্যে যাঁহার তুল্য ধর্ম্মপরায়ণ ও যশস্বী আর কেহই নাই; যিনি ধৈৰ্য্য, দম, ব্রহ্মচর্য্য, ক্ষমা, ধৰ্ম্ম, তেজ ও বলের অদ্বিতীয় আধার; যিনি আত্মীয়, কুটুম্ব, অতিথি ও আশ্রিত ভৃত্যগণকে যথোচিত সৎকার ও সম্মান করিয়া থাকেন; সত্য, দান, তপস্যা, শৌর্য্য, দক্ষতা ও নির্ভীকতা যাঁহাতে প্রতিনিয়ত বর্ত্তমান রহিয়াছে; যিনি কাম, ক্রোধ, ভয় অথবা অর্থের নিমিত্ত অধৰ্ম্মকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করেন না; লোকে যাঁহাকে সত্যপরায়ণ, জ্ঞানী, ক্ষমাবান্ ও অতিথিপ্রিয় বলিয়া অবগত আছে এবং যিনি সদ্ব্যয়শীল, যজ্ঞানুষ্ঠাননিরত ও শান্তস্বভাব বলিয়া জনসমাজে বিখ্যাত রহিয়াছেন; সেই ধর্ম্মপরায়ণ যুধিষ্ঠির আমার নিকট প্রশ্ন করুন। তাহা হইলেই আমি পরম প্রীত হইয়া সমুদয় ধর্ম্ম কীৰ্ত্তন করিব।”
তখন বাসুদেব কহিলেন, “কৌরবনাথ! ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির পরমপূজ্য, মান্য, ভক্ত, গুরু, আত্মীয়, বন্ধুবান্ধব ও অন্যান্য লোকের প্রাণসংহারপূর্ব্বক নিতান্ত লজ্জিত হইয়াছেন। এক্ষণে তিনি অভিশাপভয়ে ভীত হইয়া আপনার সম্মুখীন হইতে সমর্থ হইতেছেন না।” ভীষ্ম কহিলেন, “বাসুদেব! ব্রাহ্মণদিগের দান, অধ্যয়ন ও তপস্যা যেমন প্রধান ধৰ্ম্ম, ক্ষত্রিয়দিগের যুদ্ধে শত্ৰুসংহার করাও তদ্রূপ। যে ক্ষত্রিয় অকারণে সংগ্রামে প্রবৃত্ত পিতা, পিতামহ, গুরু, ভ্রাতা, সম্বন্ধী ও বান্ধবগণের, সমরত্যাগী পাপপরায়ণ লুব্ধস্বভাব গুরুর এবং লোভপরতন্ত্র ধৰ্ম্মত্যাগী পামরগণের প্রাণসংহার করেন, আর যে ক্ষত্রিয় যুদ্ধকালে পৃথিবীকে শোণিতরূপ জল, কেশরূপ তৃণ, গজরূপ শৈল ও ধ্বজরূপ পাপে পরিশোভিত করিতে পারেন, তিনিই যথার্থ ধৰ্ম্মজ্ঞ। মনু কহিয়া গিয়াছেন যে, সংগ্রামে আহূত হইলেই ক্ষত্রিয়কে যুদ্ধ করিতে হইবে। যুদ্ধদ্বারাই ক্ষত্রিয়গণের যশ, ধৰ্ম্ম ও স্বর্গলাভ হইয়া থাকে।”
হে মহারাজ! তখন ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ভীষ্মকর্ত্তৃক এইরূপ আশ্বাসিত হইয়া তাঁহার সমীপে গমনপূর্ব্বক বিনীতভাবে চরণ বন্দনা করিলেন; ধনুর্দ্ধরাগ্রগণ্য মহাত্মা ভীষ্মদেবও আনন্দিতমনে ধৰ্ম্মরাজের মস্তকাঘ্রাণপূৰ্ব্বক তাঁহাকে উপবেশন করিতে অনুজ্ঞা করিয়া কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! তোমার ভয় নাই, তুমি বিশ্রদ্ধচিত্তে আমাকে ধর্ম্মতত্ত্ব জিজ্ঞাসা কর।”