৫৪তম অধ্যায়
দময়ন্তীর নলানুরাগ
বৃহদশ্ব কহিলেন, “মহারাজ! দময়ন্তী হংসমুখে এই সকল কথা শ্রবণ করিয়া নলবিরহে একান্ত অধীর হইয়া উঠিলেন। তাঁহার মুখকমল বিবৰ্ণ, শরীর শীর্ণ ও পাণ্ডুবৰ্ণ হইয়া উঠিল। তিনি নলচিন্তায় নিতান্ত নিমগ্না হইয়া বারংবার দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন; কখন বা উৰ্দ্ধে দৃষ্টিনিক্ষেপ করিয়া ধ্যান করিতেন; কখন বা কন্দর্পবাণে আহত হইয়া বিচেতন্যপ্ৰায় হইতেন; কখন বা তাঁহাকে উন্মত্তার ন্যায় বোধ হইত। শয়ন, অশন ও অন্যান্য বিষয়োপভোগে তাঁহার কিছুমাত্র অনুরাগ ছিল না। নিদ্রা-সহচরী কি দিবা কি বিভাবরী কোন সময়েই সেই কামিনীর নয়নাবলম্বিনী হইত না। তিনি কেবল অনবরতবিগলিতবাষ্পকুললোচনে ‘হা হতোহস্মি’ বলিয়া রোদন করিতে লাগিলেন। তখন তাহার সখীগণ আকার-ইঙ্গিতদ্বারা বিলক্ষণ বিরহলক্ষণ নিরীক্ষণ করিয়া মহারাজ ভীমের নিকট সমুদয় বৃত্তান্ত নিবেদন করিল। বিদর্ভাধিপতি সখীমুখে স্বীয় দুহিতার অস্বাস্থ্যসংবাদ শ্রবণ করিয়া ভাবিলেন, “এক্ষণে কি করি, এ এক বিষম ব্যাপার উপস্থিত; দময়ন্তী সহসা কেনই বা অসুস্থপ্রায় হইল?” পরে তনয়াকে যৌবনসীমায় অবতীর্ণ দেখিয়া শীঘ্র স্বয়ংবরের উদযোগ করাই কর্ত্তব্য ইহা নিশ্চয় করিলেন।
দময়ন্তীর স্বয়ংবর
“অনন্তর বিদর্ভাধিপতি স্বীয় তনয়ার স্বয়ংবর সংবাদ প্রচার করিয়া মহীপালগণকে নিমন্ত্ৰণ করিলেন। ভূপালেরা দময়ন্তীর স্বয়ংবরবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া ভীমের আদেশানুসারে তৎসন্নিধানে আগমন করিতে লাগিলেন। তাহাদিগের মাতঙ্গগণের বৃংহিতধ্বনি, অশ্বের হেষারব ও রথের ঘর্ঘর-শব্দে পৃথিবী পরিপূর্ণ হইল। বিচিত্ৰ মাল্য ও বহুবিধ অলঙ্কারে অলঙ্কৃত মনোহর সৈন্যমণ্ডলী দিঙ্মণ্ডুল আচ্ছাদন করিল। অভ্যাগত ভুপালেরা মহাবাহু ভীমকর্ত্তৃক বিবিধ উপচারে যথাযোগ্য পূজিত হইয়া তথায় বাস করিতে লাগিলেন। এই অবসরে দেবর্ষি নারদ ও মহাতপাঃ পর্ব্বত যদৃচ্ছাক্রমে পৰ্যটনপূর্ব্বক ইন্দ্ৰলোকে উপস্থিত হইলেন। দেবরাজ ইন্দ্র তাহাদিগকে সৎকার করিয়া উভয়ের সর্ব্বাঙ্গীণ কুশল ও সর্ব্বস্থানগত অনাময় জিজ্ঞাসা করিলেন। নারদ কহিলেন, “হে দেবরাজ! আমরা কুশলে আছি এবং ত্ৰিলোকগত ভূপালগণেরও মঙ্গল।’ ইন্দ্ৰ কহিলেন, “হে দেবর্ষে যে-সকল ধর্ম্মপরায়ণ ধরাপতিরা জীবিতাশা পরিত্যাগপূর্ব্বক সমরে অপরাঙ্মুখ হইয়া শস্ত্ৰপ্ৰহারে নিধনপ্রাপ্ত হয়েন, তাঁহারা মদীয় কামধুক সুরলোকসদৃশ অক্ষয়লোক লাভ করিয়া থাকেন। এক্ষণে সেই সকল মহাবীর ক্ষত্ৰিয়েরা কোথায়? আমি বহুদিবস সেই সকল প্ৰিয়তম অতিথিদিগকে এ স্থানে আসিতে দেখি নাই।” দেবর্ষি নারদ ইন্দ্ৰকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া কহিলেন, “হে দেবরাজ! আপনি যে কারণে তাঁহাদিগকে এখানে অবলোকন করিতে পান না, তাহা শ্রবণ করুন। বিদর্ভাধিপতি ভীমের দময়ন্তীনামী কন্যা অলোকসামান্য-রূপলাবণ্যে পৃথিবীস্থ সমস্ত ললনাগণকে অতিক্রম করিয়াছে; আজি শুনিলাম, তাহার স্বয়ংবর অতি শীঘ্রই সম্পন্ন হইবে; এই নিমিত্ত রাজা ও রাজকুমারেরা কায়মনোবাক্যে সেই সকললোকললামভূতা কন্যারত্ন কামনা করিয়া দিগদিগন্ত হইতে তথায় গমন করিতেছেন। সুতরাং সমরানল তাহাদিগের স্বৰ্গলাভের সহিত একেবারে অন্তর্হিত হইয়া গিয়াছে।”
নলের স্বয়ংবর উদ্দেশ্যে বিদৰ্ভদেশযাত্ৰা
“উভয়ে এইরূপ কথোপকথন করিতেছেন, এই অবসরে লোকপালগণ তথায় উপস্থিত হইয়া দেবর্ষি নারদমুখে দময়ন্তীস্বয়ংবরবৃত্তান্ত শ্রবণপূর্ব্বক অতিমাত্র হৃষ্ট ও সন্তুষ্টচিত্তে কহিলেন, “হে দেবর্ষে! আমরাও দময়ন্তী-স্বয়ংবরে গমন করিব।” অনন্তর তাহারাও স্বীয়গণ ও স্ব স্ব বাহন-সমভিব্যাহারে বিদৰ্ভাভিমুখে যাত্ৰা করিলেন। এদিকে নালরাজও দময়ন্তী-স্বয়ংবিরোদ্দেশে রাজসমাগম শ্রবণ করিয়া অদীনমনে ভৈমী [ভীমাত্মজ-দময়ন্তী]—লাভ—প্ৰত্যাশায় তথায় প্ৰস্থান করিলেন। অন্তরীক্ষাগামী দেবগণ রূপে রতিপতি ও তেজে দিনপতির ন্যায় বিরাজমান নলরাজকে ধরা পৃষ্ঠে অবলোকনপূর্ব্বক বিস্ময়াবিষ্টচিত্তে কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া রহিলেন। অনন্তর তাঁহারা বিমানবেগ প্রতিরোধ করিয়া গগনমণ্ডল হইতে অবতীর্ণ হইয়া নলকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে নিষধরাজেন্দ্র! তুমি ধর্ম্মপরায়ণ ও সত্যপ্রিয়, অতএব দৌত্যকর্ম্ম স্বীকার করিয়া আমাদিগের সাহায্য কর।”