পশিয়া লঙ্কার মধ্যে যুক্তি করি সার।
বিদ্যুৎজিহ্ব নিশাচরে কহে বার বার।।
শুন বলি বিদ্যুৎজিহ্ব নানা মায়াধারী।
মন্ত্রেতে গড়িয়া দেহ রামের সুন্দরী।।
জনক-নন্দিনী যে প্রকার রূপ ধরে।
সেইরূপ সীতা নির্ম্মাইয়া দেহ মোরে।।
মায়া-সীতা কাটি আজি রামের গোচর।
পত্নীশোকে মরিবেক রাম ধনুর্দ্ধর।।
অনায়াসে হইবেক রামের মরণ।
রামের মরণে মরিবেক সে লক্ষ্মণ।।
পলাইবে সুগ্রীব সে গণিয়া প্রমাদ।
বিনা যুদ্ধে রাম সঙ্গে ঘুচিবে বিবাদ।।
অনুজ্ঞা পাইবামাত্র প্রফুল্ল হৃদয়।
মায়াসীতা নির্ম্মাইতে করিল নিশ্চয়।।
সীতার যেমন রূপ যেমন আকার।
বিদ্যুৎজিহ্ব সেইমত রচিল তাহার।।
মায়াসীতা গড়িলেক মায়ার আকার।
মন্ত্র পড়ি করে তার জীবন সঞ্চার।।
বিদ্যুৎজিহ্ব সে সীতারে পড়ায় তখন।
শ্রীরাম তোমার স্বামী দেবর লক্ষ্মণ।।
দশরথ শ্বশুর জনক তোর বাপ।
রাবণ আনিল তোরে পেয়ে বড় তাপ।।
ইন্দ্রজিৎ রথে তোমায় তুলিবে যখন।
রাম রাম শব্দে তুমি করিহ রোদন।।
মায়াসীতা দিল ইন্দ্রজিতের গোচর।
শিরোপা বিদ্যুৎজিহ্ব পাইল বিস্তর।।
তাড়বালা পাইল কত মাণিক্য রতন।
পঞ্চশব্দ বাদ্য পাইল অনেক বাজন।।
মায়াসীতা তুলিয়া রথের একভিতে।
পশ্চিম দ্বারেতে উপনীত ইন্দ্রজিতে।।
অশ্ববাড়ি মারে মায়াসীতার শরীরে।
অঙ্গে ফুটি সীতার যে রক্ত পড়ে ধারে।।
মরি মরি বলি সীতা কান্দে উভরোলে।
হাতে খাণ্ডা ইন্দ্রজিৎ সীতার ধরে চুলে।।
দেখে হনুমান বীর ধায় উভরড়ে।
দুই চক্ষে মারুতির বারিধারা পড়ে।।
ইন্দ্রজিৎ -রথে সীতা হনুমান দেখে।
বৃক্ষ হাতে রহে তার বাক্য নাহি মুখে।।
এক হস্তে ধরিয়াছে বৃক্ষ আর পাথর।
আর হাতে আঁখিজল সম্বরে বানর।।
ডাক দিয়া কহে হনু মেঘনাদ বীরে।
পাপেতে ডুবিলি বেটা নরক ভিতরে।।
স্ত্রীবধ দুষ্কর বড় পরম পাতক।
অনেক দিবস বেটা ভুঞ্জিবি নরক।।
অঙ্গে মাংস নাহি সীতার অস্থিচর্ম্ম সার।
এ নারী কাটিলে তোর নাহিক নিস্তার।।
ইন্দ্রজিৎ বলে তুই পশু দুরাচার।
কেমনে জানিবি বেটা ধর্ম্মের বিচার।।
স্ত্রী কাটিলে শোকে পুড়ে মরে যদি বৈরী।
শাস্ত্রমত হেন স্ত্রীকে কাটিবারে পারি।।
আগে সীতা কাটি পাছে শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
সুগ্রীবে কাটিব আর যত কপিগণ।।
ইন্দ্রজিতে ঘেরিতে ধাইল কপিগণে।
আগু হৈতে নাহি পারে ইন্দ্রজিত-বাণে।।
ইন্দ্রজিতে মারি সীতা কেড়ে লৈতে চাহে।
যম সম নিশাচর সামান্য ত নহে।।
আগু হৈতে নাহি পারে পবন-নন্দন।
মায়া করি মায়া সীতা যুড়িল ক্রন্দন।।
হা হা প্রভু রঘুনাথ দেবর লক্ষ্মণ।
এ সময়ে একবার দেহ দরশন।।
রাজার নন্দিনী আমি রামের বনিতে।
বিপাকে হারানু প্রাণ রাক্ষসের হাতে।।
কোথায় জনক ঋষি জনক আমার।
বিপাকে মরিনু আসি সমুদ্রের পার।।
কৌশল্যা শাশুড়ী শোকে ভাসে অশ্রুজলে।
না করিলাম তাঁর সেবা আসিবার কালে।।
সেই অপরাধে মোর হলো এ দুর্গতি।
রাক্ষসেতে বধে প্রাণ রাখ রঘুপতি।।
রক্ষা কর হনুমান পবন-নন্দন।
এত বলি মায়াসীতা করিছে ক্রন্দন।।
ক্রোধ করি ইন্দ্রজিৎ খড়্গ-লয় হাতে।
তুলিয়া মারিল মায়া-সীতার অঙ্গেতে।।
ব্রাহ্মণের গলেতে যেমন থাকে পৈতা।
সেই মত করিয়া কাটিল মায়াসীতা।।
দুই খান হয়ে সীতা পড়ে ভূমিতলে।
পলায় বানরগণ আ-উদর চুলে।।
হনুমান বলে কপি রণে হও স্থির।
ভূমিতে লোটায় যেন ইন্দ্রজিৎ-শির।।
সীতারে কাটিয়া হর্ষে ইন্দ্রজিৎ নাচে।
ইন্দ্রজিৎ মরিলে সকল দুঃখ ঘুচে।।
হনুমান-বাক্যে ফিরে সকল বানর।
লাফে লাফে প্রবেশিল রণের ভিতর।।
অসংখ্য বানরে মারে কোটি কোটি গাছ।
বড় বড় রাক্ষস পড়িল বাছের বাছ।।
বানরের যুদ্ধে ত্রাস পেয়ে ইন্দ্রজিৎ।
লঙ্কার ভিতরে গিয়া উত্তরে ত্বরিত।।
হনুমান কহিতেছে সকল বানরে।
সীতাদেবী কাটা গেল যুঝি কার তরে।।
শ্রীরামের স্থানে মোরা কহি গিয়া পরে।
শ্রীরামের যেমন আজ্ঞা সেইমত হবে।।
শ্রীরামের স্থানে চলে যত কপিগণ।
জাম্ববানে কহিছেন রাজীব-লোচন।।
যুদ্ধ করে হনুমান মহাশব্দ শুনি।
রণে ভাল মন্দ কিবা কিছুই না জানি।।
তুমি যাহ আপনার সৈন্যগণ লয়ে।
হনুর সৈন্যেতে থাক অনুবল হয়ে।।
তব বিদ্যমানে যদি হনু-সৈন্য ভাগে।
তার ভাল মন্দ দায় তোমারে সে লাগে।।
আজ্ঞামাত্র জাম্ববান চলে ততক্ষণ।
পথে হনুমান সঙ্গে হৈল দরশন।।
হনুমান বলে কেন যুঝিতে গমন।
সীতাদেবী কাটা গেল, কি করিবে রণ।।
আগে গিয়া কহি রঘুনাথের গোচর।
সীতার বিহরে রাম কি দেন উত্তর।।
সৈন্যসহ দুই জনা গেল রাম-স্থান।
কান্দিতে কান্দিতে কহে বীর হনুমান।।
হনুমান বলে, প্রভু কর অবধান।
ইন্দ্রজিৎ কাটে সীতা সবা বিদ্যমান।।
শুনিয়া ত রঘুনাথ হইলা মূর্চ্ছিত।
জলের কলস কপি যোগায় ত্বরিত।।
নির্ম্মল উৎপল জল গন্ধে সুবাসিত।
শ্রীরামের মস্তকে ঢালিল যথোচিত।।
স্পন্দহীন বিষণ্ণ শ্রীরাম অচেতন।
বিলাপ করেন আর কহেন লক্ষ্মণ।।
ত্রিলোকের নাথ তুমি ধর্ম্ম-নিকেতন।
ধর্ম্ম-লাগি রাজ্য-ত্যাগী বাকল বসন।।
ফল-মূলাহারী শিরে জটা-জুটধারী।
স্ত্রী লাগিয়া দুঃখ পাও যেমন সংসারী।।
রাজভোগে থাকিতেন দিব্য সিংহাসনে।
দুষ্ট দশানন সীতা দেখিত কেমনে।।
আপনার দোষেতে হইলা দেশান্তরী।
জন্মের মত হারালে সীতা হেন নারী।।
পিতা মাতা বন্ধু আদি সকলি অলীক।
বৃক্ষমূলে যেন মিলে ক্ষণেক পথিক।।
স্ত্রী পুত্র সকলি মিথ্যা কেহ কারো নয়।
পথিকে পথিকে যেন পথে পরিচয়।।
সংসার অসার ভাই কপটের মেলা।
সূতা-সঞ্চারিয়া যেন নাচায় পুতুলা।।
বিবিধ উৎপাত পড়ে, বিবিধ প্রমাদ।
জ্ঞানীলোকে তাহে কিছু না করে বিষাদ।।
স্ত্রীর শোকে প্রভু কেন হয়েছ কাতর।
মহাজন সম্বরে সে বিপদ-সাগর।।
তোমার কিসের ভার্য্যা, কেবা বাপ ভাই।
তোমার সমান নাই জগতে গোঁসাই।।
সকলের প্রাণ তুমি, সব তব ছায়া।
তোমা ছাড়া কেহ নহে, সব তব মায়া।।
জীয়ে কি না জীয়ে সীতা করহ বিচার।
স্ত্রী লাগিয়া অচেতন একি ব্যবহার।।
মহামুনি বশিষ্ঠ যে কুল-পুরোহিত।
স্বর্গবাসে গেলা তিনি শরীর সহিত।।
স্বর্গে গিয়া তিনিও যে দারা পুত্রশোকে।
স্বর্গভ্রষ্ট হইয়া আইলা মর্ত্ত্যলোকে।।
তপস্যা করিয়া ইন্দ্র হৈলা দেবরাজ।
শোকেতে কাতর হও, কিছু নহে কাজ।।
শ্রীরাম বলেন কিবা বুঝাও লক্ষ্মণ।
ভার্য্যাশোকে নহে ভাই কভু বিস্মরণ।।
স্ত্রী পুরুষে দোঁহে জন্মে এ ছার সংসারে।
স্ত্রী হইতে পুত্র হয় বাড়ে পরিবারে।।
ইষ্ট বন্ধু কুটুম্ব ঘরের যত লোক।
সবা হৈতে ভাইরে ভার্য্যার বড় শোক।।
দেশে দেশে পাই ভাই কামিনী অশেষ।
গুণবতী স্ত্রী মরিলে মরণ বিশেষ।।
স্ত্রী বিনা পুরুষ সুখী কোথাও না শুনি।
স্ত্রী-শোক এড়ায় যেই সে পরম জ্ঞানী।।
রাজ্যহীন পিতৃহীন সে সব পাসরি।
হারাইয়া নারী ভাই পাসরিতে নারি।।
সীতা না দেখিলে আমি না পারি রহিতে।
সীতার মরণে ক্ষমা দিব কিসে চিতে।।
হইলেক কান্দিয়া শ্রীরাম অচেতন।
রামের ক্রন্দন শুনি এল বিভীষণ।।
সকলেতে শোকাকুল দেখে উড়ে প্রাণ।
বিভীষণ কহে বার্ত্তা কহ হনুমান।।
কেন রামের কোমলাঙ্গ ধূলায় ধূসর।
কাতর হইয়া কেন কান্দিছে বানর।।
শ্রীরাম বলেন, শুন মিত্র বিভীষণ।
সীতারে কেটেছে আজি রাবণ-নন্দন।।
যত পরিশ্রম সব হলো অকারণ।
বৃথা কেন করিলাম সাগর বন্ধন।।
বিমাতা হইয়া বৈরী পাঠাইয়া বনে।
হারাইলাম প্রাণের জানকী এতদিনে।।
কাননে চলিত যবে জানকী আমার।
ফিরে চেয়ে দেখিতাম তিলে শতবার।।
ননীর পুতলী সীতা আতপে মিলায়।
চলে যেতে কুশাঙ্কুর ফোটে যদি পায়।।
চম্পক-বরণী সীতা রাজার দুহিতে।
স্বামী হয়ে সঁপিলাম রাক্ষসের হাতে।।
মায়ামৃগ ধরিবারে কেন গেলাম বনে।
কারে বিলাইয়া দিনু সীতা হেন ধনে।।
দুষ্ট ইন্দ্রজিৎ যখন কাটিল জানকী।
না জানি কান্দিলা কত সীতা শশিমুখী।।
সীতার বিহনে প্রাণ ত্যজিব এখন।
অযোধ্যাতে ফিরে যাহ প্রাণের লক্ষ্মণ।।
বিভীষণ বলে রাম না কর ক্রন্দন।
সীতারে কাটিতে দেখিয়াছে কোন্জন।।
রাম বলে দেখিয়াছে পবন-নন্দন।
বিভীষণ বলে হনু পশুতে গণন।।
বনজন্তু বানর সে বুদ্ধি নাহি ঘটে।
মহালক্ষ্মী মা জানকী কার সাধ্য কাটে।।
আর এক কথা বলি শুন রঘুমণি।
পরমাসুন্দরী সীতা ভুবন-মোহিনী।।
মজাইল লঙ্কাপুরী জানকীর তরে।
তবু সে তোমার সীতা না দিল তোমারে।।
সীতারে রেখেছে লয়ে অশোকের বনে।
ইন্দ্রজিতের সাধ্য কি যে সীতাদেবী আনে।।
দশ হাজার কিঙ্করী সীতারে আছে ঘেরে।
অন্য পুরুষেতে সেথা যাইতে না পারে।।
সীতাদেবী রাবণের লেগেছে নয়নে।
ইন্দ্রজিৎ হেন সীতা পাইবে কেমনে।।
মায়াসীতা কাটি বেটা কৈল দুই খান।
সে মায়াতে ভুলেছে বানর হনুমান।।
প্রত্যয় না কর যদি আমার কথায়।
হনুমান গিয়া দেখে আসুক সীতায়।।
এতেক শুনিয়া সবে হৈল হরষিত।
অশোকের বনে হনুমান উপনীত।।
দেখিল বসিয়া আছে রামের মহিষী।
রঘুনাথে সমাচার হনু দিল আসি।।
কুশলে আছেন সীতা অশোকের বনে।
ইন্দ্রজিৎ মায়াসীতা কাটিলেক এনে।।
বিভীষণে কোল দিলা রাম রঘুবর।
রামজয় ধ্বনি করে সকল বানর।।