৫৩তম অধ্যায়
দময়ন্তীর জন্মবৃত্তান্ত
বৃহদশ্ব কহিলেন, “মহারাজ! নিষধদেশে বীরসেনসূত নলনামে পরামরূপবান, সর্ব্বগুণান্বিত, মহাবলপরাক্রান্ত এক নরপতি ছিলেন। তিনি ত্ৰিদশাধিপতি ইন্দ্রের ন্যায় নৃপতিগণের অগ্রগণ্য, তেজঃপ্রভাবে প্রভাকরের ন্যায় সর্বোপরি বিরাজমান, অশ্বপরীক্ষায় দক্ষ, ব্ৰহ্মপরায়ণ ও বেদবেত্তা। দ্যূতক্রীড়ায় তাহার সাতিশয় অনুরাগ ছিল। তিনি অতি উদারস্বভাবসম্পন্ন, সত্যবাদী, জিতেন্দ্রিয়, সকল ধনুর্দ্ধরের শ্রেষ্ঠ ও নরনারীগণের অভষ্টি ছিলেন ও সাক্ষাৎ মনুর ন্যায় প্রজারঞ্জন করিতেন।
“বিদর্ভদেশে ভীমপরাক্রম ভীমনামে সর্ব্বগুণমণ্ডিত এক মহীপাল ছিলেন। তিনি নিঃসন্তান, সুতরাং সন্তানলাভের নিমিত্ত নিরন্তর যত্ন করিতেন। এইরূপে কিয়দ্দিন অতীত হইলে, একদা দমন-নামক ব্ৰহ্মার্ষি তাহার নিকট উপস্থিত হইলেন। রাজা মহিষীর সহিত সন্তান-কামনায় বিবিধ উপচারে তাহাকে অৰ্চনা করিয়া সন্তুষ্ট করিলেন। মহর্ষি দমন নৃপতিবিহিত উপাচারে প্রীত ও প্রসন্ন হইয়া কহিলেন, “মহারাজ! আমার বর-প্রভাবে তোমার এক কন্যারত্ন ও তিনটি কুমার জন্মিবে।” ইহা বলিয়া মহর্ষি দমন স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন। অনন্তর রাজার দম, দান্ত ও দমন-নামক সর্ব্বগুণালঙ্কৃত মহাবলপরাক্রান্ত তিনটি পুত্র ও দময়ন্তীনামী এক কন্যা জন্মিল। সেই কন্যা অসামান্য-রূপলাবণ্য, তেজ ও যশোদ্বারা সৌভাগ্যশালী লোকদিগের মধ্যে উৎকৰ্ষলাভ করিয়াছিলেন। তিনি পরিবদ্ধিত হইয়া যৌবন-সীমায় পদার্পণ করিলে শত শত দাসী ও সখীগণ শচীর ন্যায় তাহার পরিচর্য্যা করিতে লাগিল। যেমন সৌদামিনী কাদম্বিনীর মধ্যে শোভমান হয়, তদ্রূপ সর্ব্বাভরণভূষিতা দময়ন্তী তখন সখীগণমধ্যে শোভমানা হইলেন। তিনি লক্ষ্মীর ন্যায় আলোকসামান্য রূপলাবণ্যসম্পন্না ও আয়তলোচনা ছিলেন। দেব, যক্ষ, মনুষ্য বা অন্যান্য লোকমধ্যেও এতাদৃশী রূপবতী রমণী কাহারও দৃষ্টিগোচর হয় নাই। দময়ন্তীকে দেখিলে চিত্ত প্ৰসন্ন হইত; অধিক কি, দেববৃন্দেরাও র্ত্তাহাকে সুন্দরী বলিয়া গণনা করিতেন। নরশাৰ্দ্দল নলের তুলনা পৃথিবীতে নিতান্ত দুর্লভ। র্ত্তাহাকে দেখিলে বোধ হয়, যেন অনঙ্গদেব অঙ্গ পরিগ্রহ করিয়া ধরাতলে অবতীর্ণ হইয়াছেন। এই নিমিত্ত সকলে কুতুহল-পরতন্ত্র হইয়া দময়ন্তী-সমীপে নলের প্রশংসা ও নলের সমীপে দময়ন্তীর প্রশংসা করিত। তখন পরস্পর গুণানুবাদ শ্রবণ করিলে, অদৃষ্টচর ভগবান রতিপতিও সেই অবকাশে তীহাদিগের হৃদয়শায়ী হইয়া ক্রমশঃ পরিবদ্ধিত হইতে লাগিলেন।
হংসমুখে নলের দময়ন্তী-প্ৰশংসা শ্রবণ
“নালরাজ হৃদয়ে কন্দর্পভার ধারণ করিতে অসমর্থ হইয়া অন্তঃপুরোপকণ্ঠে নির্জ্জন ক্রীড়াকাননে বাস করিতে লাগিলেন। ইতিমধ্যে সেই বনে সুবৰ্ণ-পক্ষপরিচ্ছদ কতকগুলি হংসকে ইতস্ততঃ সঞ্চরণ করিতে দেখিয়া তাহাদের অন্যতম একটি হংসকে স্বহস্তে ধরিলেন। হংস তৎক্ষণাৎ নলকে সম্বোধন করিয়া কহিতে লাগিল, “হে রাজন! আপনি আমাকে বধ করিবেন না; আমি প্ৰাণপণে আপনার প্রিয়কাৰ্য্য-সাধন করিব। আমি দময়ন্তীসন্নিধানে আপনার কথা উত্থাপন করিয়া এরূপ গুণানুবাদ করিব, যাহাতে তাঁহার অন্তঃকরণ অন্য পুরুষাভিলাষী না হইয়া নিরন্তর আপনাতেই সাতিশয় অনুরক্ত থাকে।” নলরাজ হংসের এইরূপ আশ্বাসবাক্যে বিশ্বস্ত হইয়া তৎক্ষণাৎ তাহাকে পরিত্যাগ করিলেন।
“অনন্তর হংসেরা নভোমণ্ডলে উড্ডীন হইয়া বিদর্ভনগরাভিমুখে গমনপূর্ব্বক ক্ৰমে দময়ন্তী-সন্নিধানে অবতীর্ণ হইল। সখীগণপরিরতা দময়ন্তী তাহাদিগের লোকাতীত রূপলাবণ্য নিরীক্ষণ করিয়া হৃষ্টান্তঃকরণে সত্বর গ্রহণ করিবার উপক্ৰম করিলেন। পরিচারিকারা সকলে ধরিবার নিমিত্ত হংসদিগের পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইলে তাহারা ভীতিপ্ৰায় হইয়া প্রমদাবনে [নারীমণ্ডলীর] ইতস্ততঃ ভ্ৰমণ করিতে লাগিল। ইত্যবসরে দময়ন্তী যে হংসের অনুসরণ করিতেছিলেন, সেই হংস মনুষ্যবাক্যে দময়ন্তীকে সম্বোধন করিয়া কহিল, “হে রাজকুমারি! নিষধদেশে নলনামে এক মহীপাল আছেন। তিনি রূপে অশ্বিনীকুমার সদৃশ, মর্ত্যলোকে তাহার তুল্য রূপবান আর কেহই নাই। যদি আপনি তাঁহার মহিষী হইতে পারেন, তাহা হইলে আপনার জন্ম সফল ও সৌন্দৰ্য্য সার্থক হয়। আমরা দেব, গন্ধর্ব্ব, মনুষ্য, উরগ ও রাক্ষস প্রভৃতি সকলকে নিরীক্ষণ করিয়াছি, কিন্তু নলের তুল্য রূপলাবণ্যসম্পন্ন পুরুষ কুত্ৰাপি অবলোকন করি নাই। আপনি অবলাগণের মধ্যে রত্নস্বরূপ; নীলরাজিও পুরুষশ্রেষ্ঠ; অতএব তাঁহার সহিত আপনার মিলন হইলে পরমসৌভাগ্যের বিষয় হয়; যেহেতু, উৎকৃষ্টের সহিত উৎকৃষ্টের সঙ্গতি সাতিশয় গুণপ্ৰসবিনী হইয়া থাকে, সন্দেহ নাই।” দময়ন্তী হংসকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া কহিলেন, “হে মরালবর! তুমি অবিলম্বে এই কথা নলের কৰ্ণগোচর কর।” হংস “যে আজ্ঞা” বলিয়া দময়ন্তীর নিকট বিদায়গ্রহণপূর্ব্বক নিষধদেশে উপস্থিত হইয়া নলসন্নিধানে আদ্যোপান্ত সমস্ত বৃত্তান্ত নিবেদন করিল।”