যে বীর পাঠাই নর-বানরের রণে।
সবে মরে, ফিরে নাহি আসে একজনে।।
দিনে দিনে টুটে বল মনে পাই শঙ্কা।
নর-বানর মেরে কেবা রাখে পুরী লঙ্কা।।
স্বর্গেতে গন্ধর্ব্ব এক চিত্রসেন নাম।
চিত্রাঙ্গদা কন্যা তার রূপেতে সুঠাম।।
রাবণ হরিয়া তারে আনে লঙ্কাপুরী।
পরমাসুন্দরী কন্যা যেন বিদ্যাধরী।।
বিষ্ণুর বরেতে এক সন্তান প্রসবে।
তাহার গুণের কথা কহি শুন তবে।।
রাক্ষস-ঔরসে জন্ম বীরবাহু নাম।
দেব গুরু ভক্ত বড় সদা জপে রাম।।
জন্মিয়া ব্রহ্মার সেবা করে নিরন্তর।
কতদিনে ব্রহ্মা তবে তারে দিলা বর।।
ব্রহ্মা বলে বীরবাহু যাহ নিজ স্থান।
এই হস্তী লহ ঐরাবতের সমান।।
এই হস্তী সহায়ে জিনিবে ত্রিভুবন।
হস্তী মারা গেলে হবে তোমার পতন।।
বিষ্ণুভক্ত হবে তুমি বিষ্ণু-পরায়ণ।
বিষ্ণুসেবা যতনে করিবে সর্ব্বক্ষণ।।
তোমায় সন্তুষ্ট আমি, যাহ তুমি ঘরে।
মম বরে অন্তে যাবে বৈকুণ্ঠ-নগরে।।
ধর্ম্মশীল হবে সর্ব্ব শাস্ত্রেতে পণ্ডিত।
বর পাইয়া পিতার নিকটে উপনীত।।
রাবণ জিজ্ঞাসে তুমি হও কোন্ জন।
কোথায় বসতি কর কাহার নন্দন।।
বীরবাহু বলে পিতা হৈলে পাসরণ।
চিত্রাঙ্গদা-গর্ভে জন্ম তোমার নন্দন।।
তপে তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা দিয়াছেন বর।
পাইয়াছি হস্তী ঐরাবতের সোসর।।
হস্তী-আরোহণে আমি যদি করি মনে।
ত্রৈলোক্য জিনিতে পারি একদিনের রণে।।
এত শুনি দশানন পুত্রে কৈল কোলে।
শিরে চুম্ব দিয়ে তোষে সকরুণ বোলে।।
রাবণ বলে বীরবাহু থাক এখানে।
লঙ্কারাজ্য ভোগ কর মেঘনাদ সনে।।
বীরবাহু বলে পিতা করি নিবেদন।
মাতামহ-রাজ্যে আমি থাকিব এখন।।
তব প্রয়োজন-কালে আসিব হেথায়।
এত বলি বীরবাহু হইল বিদায়।।
মাতামহ-রাজ্য ছিল গন্ধর্ব্বলোকেতে।
যুদ্ধের বারতা শুনি আইল লঙ্কাতে।।
মনে জানে নররূপা দেব নারায়ণ।
সফল হইবে দেহ করে দরশন।।
উদ্দেশে ব্রহ্মার পদে নমস্কার করি।
হস্তীপৃষ্ঠে বীরবাহু গেল লঙ্কাপুরী।।
নিরবধি বিষ্ণু বিনা অন্যে নাহি মন।
পরম ধার্ম্মিক বীর রাবণ-নন্দন।।
লঙ্কায় আসিয়া দেখে ছিন্ন ভিন্ন সব।
নাহিক সে নৃত্য গীত বাদ্যভাণ্ড-রব।।
মহাশব্দে কলরব করিছে বানর।
কেহ বলে মার মার কেহ বলে ধর।।
মৃতদেহ রাশি রাশি রাক্ষস বানরে।
সমুদ্র গিয়াছে বাঁধা বৃক্ষ আর পাথরে।।
দগ্ধ বড় বড় ঘর লঙ্কার ভিতর।
দেখিয়াত বীরবাহু সভয় অন্তর।।
কুম্ভকর্ন আদি যত রাক্ষ প্রচণ্ড।
এক ঠাঁই স্কন্ধ পড়ে আর ঠাঁই মুণ্ড।।
শকুনি গৃধিনী আর কুক্কুর শৃগাল।
মহানন্দে কলরব কলে পালে পাল।।
লক্ষ লক্ষ রমণীর রোদনের শব্দ।
ভয়ঙ্কর কর্ম্ম দেখে ভয়ে হলো স্তব্ধ।।
অন্তরীক্ষে ফিরে বীর হস্তীর উপরে।
তিন দ্বারে ফিরি গেল পশ্চিমের দ্বারে।।
দেখিল বসিয়া আছেন শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
যোড়হাতে রহিয়াছে খুড়া বিভীষণ।।
ভল্লুক বানর কত বড় বড় বীর।
নিরখিয়া বীরবাহু কম্পিত শরীর।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণে দেখে রাবণ নন্দন।
উদ্দেশেতে বন্দিলেন দোঁহার চরণ।।
বিভীষণ খুড়াকে প্রণাম কৈল মনে।
প্রণমিল ভক্তবৃন্দ যত কপিগণে।।
বিষ্ণু-অবতার রাম দেখিল নয়নে।
জানিল রাক্ষসবংশ ধ্বংস এত দিনে।।
এতেক ভাবিয়া গেল পুরীর ভিতর।
সিংহাসন ত্যজি ভূমে বসে লঙ্কেশ্বর।।
কান্দিছে তরণী-শোকে হইয়া কাতর।
কুড়ি চক্ষে বারিধারা বহে নিরন্তর।।
দাণ্ডায়াছে পাত্র মিত্র চতুর্দ্দিকে ঘেরে।
রাবণ বলে যুদ্ধে আর পাঠাইব কারে।।
বীর নাহি লঙ্কাতে, ভাণ্ডারে নাহি ধন।
কুম্ভকর্ণ মরিল, না মৈল বিভীষণ।।
মারিল আপন পুত্রে আপন সাক্ষাতে।
মজালে কনক-লঙ্কা নর-বানরেতে।।
জিনিবে বানর-নরে কে আছে এমন।
লঙ্কাতে আইল রাম হইয়া শমন।।
কারে পাঠাইব রণে ভাবে দশানন।
হেনকালে বীরবাহু বন্দিল চরণ।।
বীরবাহু দেখিয়া উঠিল দশানন।
আলিঙ্গন করে দিল রত্ন-সিংহাসন।।
রাবণ বলে বীরবাহু কর অবগতি।
দেখিলে আপন চক্ষে লঙ্কার দুর্গতি।।
স্বর্গ মর্ত্ত্য পাতাল জিনিনু ত্রিভুবন।
নর-বানরের হাতে সংশয় জীবন।।
বীরবাহু বলে পিতা কহত সংবাদ।
নর-বানরের সনে কিসের বিবাদ।।
রাবণ বলে, শুন পুত্র কহি যে তোমারে।
দশরথ রাজা ছিল অযোধ্যা-নগরে।।
তার বেটা রাম লোকমুখে শুন্তে পাই।
রাজ্য ভাই বনবাসী সঙ্গে লয়ে নারী।।
দুই ভাই বনবাসী সঙ্গে লয়ে নারী।
পঞ্চবটী বনে ছিল হয়ে জটাধারী।।
সূর্পণখা গিয়েছিল পুষ্প-অন্বেষণে।
নাক কাণ কাটে তার অনুজ লক্ষ্মণে।।
আমি হরে আনিলাম তাহার সুন্দরী।
বানর লইয়া রাম এল লঙ্কাপুরী।।
কুম্ভকর্ণ আদি বীর পড়িয়াছে রণে।
কে আর যুঝিবে নর-বানরের সনে।।
বীরবাহু বলে, শঙ্কা না কর রাজন।
ইঙ্গিতে মারিয়া দিব শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।
এত বলি বীরবাহু ভাবে মনে মন।
বিষ্ণুহস্তে মৈলে যাব বৈকুণ্ঠ-ভুবন।।
বীরবাহু বলে পিতা তুমি জান ভালে।
ইন্দ্র আদি দেব কাঁপে আমারে দেখিলে।।
বিদায় করহ যাব রণের ভিতর।
এত বলি বীরবাহু চলিল সত্বর।।
নানা রত্ন দান রাজা দিল পুত্র তরে।
হার ও নূপুর তাড় নানা অলঙ্কারে।।
প্রতাপে প্রচণ্ড বীর সংগ্রামে সুধীর।
বাপের আজ্ঞায় সেজে চলে মহাবীর।।
হেনকালে তার মাতা দূত-মুখে শুনে।
দ্রুতগতি ধেয়ে আসে পুত্র দরশনে।।
কার বোলে যাহ পুত্র করিবারে রণ।
বড় বড় বীর সব হইল নিধন।।
বীরশূন্যা হইল কনক-লঙ্কাপুরী।
তুমি যুদ্ধে গেলে আমি প্রাণ পরিহরি।।
কুম্ভকর্ণ হেন বীর রণে গিয়া মরে।
আতিকায়ে মারিয়াছে নর ও বানরে।।
মায়ের বচন শুনি বীরবাহু হাসে।
মধুর বচন কহি জননীরে তোষে।।
চরণের ধূলি লয় মাথার উপর।
হাসিতে হাসিতে করে মায়েরে উত্তর।।
অবোধ অবলা জাতি নাহি বুঝ কার্য্য।
আমি যুদ্ধ না করিলে কে রাখিবে রাজ্য।।
মাতা তুমি আশীর্ব্বাদ কর এক চিতে।
তোমার প্রসাদে রণ জিনিব ইঙ্গিতে।।
সংগ্রামে রামের হাতে হইলে নিধন।
রথে চড়ি যাব আমি বৈকুণ্ঠ-ভুবন।।
মায়ের প্রবোধ করি হস্তীস্কন্ধে চড়ে।
বিদায় হইয়া বীর যুঝিবারে নড়ে।।
বীরবাহু রণে চলে হয়ে সেনাপতি।
হস্তী ঘোড়া বহু ঠাট চলিল সংহতি।।
চলিল ধূম্রাক্ষ বীর রথেতে চড়িয়া।
মার মার শব্দে ধায় নানা অস্ত্র লৈয়া।।
সবার পশ্চাতে রণে ভস্মাক্ষ দুর্জ্জয়।
চর্ম্মে ঢাকি রথখান সবামধ্যে রয়।।
যার মুখ দেখে, সেই হয় ভস্মময়।
সংসারে কাহার মুখ নাহি নিরীক্ষয়।।
হেন মহাবীর নড়ে রণ করিবারে।
সম্মুখ-সংগ্রামে কেবা জিনিবে তাহারে।।
তাহার সহিত এল কত শত বীর।
হস্তীপরে বীবাহু সুন্দর শরীর।।
মনে মনে বীরবাহু চিন্তে অনুক্ষণ।
কেমনে পাইব আমি রাম দরশন।।
প্রথমেতে উত্তরিল বানর গোচর।
মার মার শব্দ করি ধাইল বানর।।
ভস্মাক্ষেরে ডাকি তবে বরিছে তখন।
যুঝিতে দিলেন আজ্ঞা রাবণ-নন্দন।।
বীরবাহু আজ্ঞা যদি দিলেক তাহাকে।
ভস্মাক্ষ চলিল তবে রামের সম্মুখে।।
চর্ম্মে ঢাকিয়াছে রথ চক্ষে চর্ম্মঠুলি।
রামের আগে চলিল ভস্মাক্ষ মহাবলী।।
যেখানেতে শ্রীরাম সুগ্রীব বীরগণ।
বিভীষণ বলে দেব রক্ষ নারায়ণ।।
যোড়হাতে রাম অগ্রে বলে বিভীষণ।
প্রমাদ ঘটিল বড়, রক্ষ নারায়ণ।।
দেখহ ভস্মাক্ষ বীর উপনীত আসি।
যাহারে দেখিবে, সেই হবে ভস্মরাশি।।
চর্ম্মে আচ্ছাদিত রথ দেখ বিদ্যমান।
ইহার ভিতরে আছে শমন সমান।।
ভস্মাক্ষ ইহার নাম বড়ই দুর্দ্ধর।
করিল কঠোর তপ সহস্র বৎসর।।
তপোবলে ব্রহ্মা যবে দিতে এল বর।
রাক্ষস বলিল আমায় করহ অমর।।
ব্রহ্মা বলে অন্য বর চাহ নিশাচর।
সৃষ্টিনাশ হবে তুমি হইলে অমর।।
নিশাচর বলে তবে করি নিবেদন।
সেই ভস্ম হবে যার হেরিব বদন।।
ব্রহ্মা বলে দিনু যাহা এল তব মুখে।
ঘরে গিয়া বসে থাক ঠুলি দিয়া চক্ষে।।
বর পেয়ে রাক্ষস হইল আনন্দিত।
সত্য মিথ্যা কেমনেতে যাইবে প্রতীত।।
সংহতি রাক্ষস তাহার ছিল যত জন।
মুখ নিরখিতে ভস্ম হইল তখন।।
বর পেয়ে নিশাচর হরিষ অন্তর।
স্ত্রী পুত্র না রহে ওই পাপিষ্ঠ গোচর।।
হেনই পাপিষ্ঠ রণে হৈল আগুয়ান।
উহার সংগ্রামে প্রভু হও সাবধান।।
বিভীষণ-বচনে বিস্ময় হয়ে মনে।
পুনরপি শ্রীরাম কহেন বিভীষণে।।
রণে ভঙ্গ নাহি দিব যুঝিব অবশ্য।
আমি ভস্ম হই কিংবা ঐ হবে ভস্ম।।
বিভীষণ বলে গোঁসাই না করিহ ভয়।
করহ উপায় চিন্তা মরিবে নিশ্চয়।।
আছয়ে মন্ত্রণা এক শুন নারায়ণ।
উহার সম্মুখে দেহ ধরিয়া দর্পণ।।
যখন আসিবে তব মুখ দেখিবারে।
দর্পণে আপন মুখ পাবে দেখিবারে।।
দর্পণে আপন মুখ দেখি নিশাচর।
আপনি হইবে ভস্ম না করিহ ডর।।
হেন উপদেশ যদি কহে বিভীষণ।
মিত্র মিত্র বলি রাম দিলা আলিঙ্গন।।
শ্রীরাম বলেন সৈন্য হও এক পাশ।
যাবৎ রাক্ষস দুষ্ট না হয় বিনাশ।।
শ্রীরাম দর্পণ-অস্ত্র যুড়িলা ধনুকে।
ছুটিয়া রামের বাণ রহিল সম্মুখে।।
আছিল রামের সঙ্গে যত কপিগণ।
বাণেতে সবার মুখে হইল দর্পণ।।
হেনকালে সেই দুষ্ট সংগ্রামে পশিল।
রাম-অগ্রে দু-চক্ষের ঠুলি খসাইল।।
দর্পণাস্ত্রে রঘুনাথ কৈলা আচ্ছাদন।
সব বানরের মুখে হইল দর্পণ।।
দেখিল ভস্মাক্ষ বীর যাহার বদন।
মুখ দেখা নাহি গেল দেখিলা দর্পণ।।
মুখ দেখা নাহি গেল কুপিল নিশাচর।
শ্রীরামে ডাকিয়া তবে করিছে উত্তর।।
রাক্ষস বলিছে তুমি প্রাণেতে কাতর।
ডর যদি কর পলাইয়া যাহ ঘর।।
রাম বলে, রাক্ষসা কি ইচ্ছিলি মরণ।
এখনি পাঠাব তোরে যমের সদন।।
রামের বচন শুনি কোপে নিশাচর।
রথ চালাইয়া দিল রামের গোচর।।
রামে দেখিবারে বীর মেলিল লোচন।
রাক্ষস-সম্মুখে রাম ধরিলা দর্পণ।।
দর্পণ ভিতরে দেখি আপনার আস্য।
নিজ মুখ দেখিয়া আপনি হৈল ভস্ম।।
ভস্ম হয়ে পড়ে বেটা রথের উপরে।
ভস্মাক্ষের পতনে রাক্ষস পলায় ডরে।।
ভস্মাক্ষ পড়িল যদি রাক্ষসের ভঙ্গ।
রাক্ষসের ভঙ্গ দেখি বানরের রঙ্গ।।
ভস্মাক্ষের মৃত্যু দেখি রাক্ষস পলায়।
দূর হৈতে বীরবাহু দেখিবারে পায়।।
ক্রোধিত হইয়া বীর চাহে ঘনে ঘন।
হাতে ধনু কহিতেছে রাবণ-নন্দন।।
রাক্ষসের ভঙ্গ দেখি বানর হর্ষিত।
হস্তী-পৃষ্ঠে বীরবাহু চলিল ত্বরিত।।
শ্বেতবর্ণ-হস্তী যেন পর্ব্বত প্রমাণ।
দুর্জ্জয় দশন ঐরাবতের সমান।।
হস্তী-পৃষ্ঠে নানা অস্ত্র মুষল মুদগর।
ঐরাবতোপরে যেন এল পুরন্দর।।
রাক্ষসের ভঙ্গ দেখি কহিছে তখন।
আশ্বাস-বচনে রাখে রাবণ-নন্দন।।
না পলাহ রাক্ষস সংগ্রামে এস ফিরে।
এখনি মারিব রণে নর আর বানরে।।
বীরবাহু-বোলে ধায় নিশাচরগণ।
পুনরপি রণে আইল করিয়া তর্জ্জন।।
দেখিয়া রাক্ষসগণে বীরবাহু বলে।
হস্তী চালাইয়া বীর দিল রণস্থলে।।
বীরবাহু বলে সবে দুই দণ্ড থাক।
বানর কটকে রণে দেখাব বিপাক।।
চালাইয়া দিল হস্তী সংগ্রাম ভিতর।
দেখিয়া রুষিল রণে যতেক বানর।।
কোপেতে অঙ্গদ বীর বালির নন্দন।
সিংহনাদ শব্দ করি করিছে তর্জ্জন।।
রুষিল রাজার বেটা কার সাধ্য থাকে।
কপিগণ সংগ্রামে চলিল একে একে।।
নল নীর কুমুদ সম্পাতি আদি করি।
মহেন্দ্র দেবেন্দ্র আর সুষেণ কেশরী।।
গয় গবাক্ষ শরভাদি দ্বিবিদ বানর।
দীর্ঘাকার পর্ব্বত-প্রমাণ কলেবর।।
সুগ্রীবের সৈন্য নড়ে দেখিতে অপার।
বিংশতি বানরে অঙ্গদের আগুসার।।
আগুদলে অঙ্গদের হৈল আগমন।
রাক্ষসের সনে যায় করিবারে রণ।।
দশ যোজন পর্ব্বত সে নিলেক উপাড়ি।
রাক্ষস উপরে ফেলে অতি তাড়াতাড়ি।।
সন্ধান পূরিয়া বীরবাহু যোড়ে বাণ।
পর্ব্বত কাটিয়া বীর করে খান খান।।
পাঁচ বাণ হানিলেক অঙ্গদের বুকে।
পড়িল অঙ্গদবীর রক্ত উঠে মুখে।।
রাজপুত্র রণে পড়ে দেখে হনুমান।
শালগাছ উপাড়িল দিয়া এক টান।।
হস্তীর মাথাতে মারে দুহাতিয়া বাড়ি।
হস্তীর মাথায় ঠেকে বৃক্ষ হৈল গুঁড়ি।।
বৃক্ষ গোটা ব্যর্থ গেল কোপে হনুমান।
আর বৃক্ষ উপাড়িল দিয়া এক টান।।
আর এক বৃক্ষ আনে পঞ্চাশ যোজন।
বৃক্ষের ছায়াতে ঢাকে রবির কিরণ।।
এড়িলেন বৃক্ষ গোটা ধরি বাহুবলে।
করিয়া বিষম শব্দ বৃক্ষ গোটা চলে।।
হস্তীর মাথায় বৃক্ষ গুঁড়া হয়ে যায়।
রুষিয়া দারুণ হস্তী ক্রোধভরে ধায়।।
ক্রোধভরে বীরবাহু এড়ে দশ বাণ।
বাণ ফুটে ভূমিতে পড়িল হনুমান।।
শরাঘাতে হনুমান অচেতন হৈল।
নল নীর কুমুদ রণেতে প্রবেশিল।।
মহেন্দ্র দেবেন্দ্র আর সুষেণ কেশরী।
নয় বীর যুঝিবারে এলো আগুসরি।।
নয় বীরে দেখি তবে এড়ে নয় শর।
বিন্ধিয়া বানরগণে করিল জর্জ্জর।।
দশ দশ বাণ প্রতি বানরের বিন্ধে।
বিন্ধিল বানরগণে বসি গজস্কন্ধে।।
গয় গবাক্ষ শরভাদি ও গন্ধমাদন।
বাণে অচেতন হয়ে পড়ে পঞ্চজন।।
বানর কটক বিন্ধি করে খান খান।
পলায় বানরগণ লইয়া পরাণ।।
ধাইয়া বানর কহে শ্রীরামের ঠাঁই।
বীরবাহু বাণে প্রভু কারো রক্ষা নাই।।
কালান্তক যম যেন এসে করে রণ।
পড়িয়াছে হনুমান আদি কপিগণ।।
কুম্ভকর্ণ হাতে সবে পেয়েছি নিস্তার।
আজিকার রণে হয় সকলে সংহার।।
এতেক রণের কথা শুনি দাশরথি।
চলিলেন রঘুনাথ লক্ষ্মণ সংহতি।।
চলিল রামের পিছে সুগ্রীব বিভীষণ।
বৃক্ষ পাথর হাতে করে ধায় কপিগণ।।
হস্তীর স্কন্ধেতে থাকি করেছি সংগ্রাম।
বিভীষণে জিজ্ঞাসা করেন প্রভু রাম।।
শ্রীরাম বলেন শুন মিত্র বিভীষণে।
কোন্ বীর আসিয়াছে হস্তী-আরোহণে।।
ঐরাবত সম গজ অতি ভয়ঙ্কর।
নানা অস্ত্র তুলিয়াছে গজের উপর।।
প্রচণ্ড ধনুক বাণ খরতর জাঠা।
পরন্দর সম গজস্কন্ধে এল কেটা।।
বিভীষণ বলে প্রভু কর অবধান।
বীরবাহু নাম ধরে রাবণ-সন্তান।।
চিত্রাঙ্গদা নামে এক গন্ধর্ব্ব-কুমারী।
যুদ্ধ জিনি রাবণ আনিল তারে হরি।।
তাহার গর্ভেতে জন্মে সুন্দর সুঠাম।
দেব-দ্বিজ-গুরুভক্ত বীরবাহু নাম।।
চিত্রাঙ্গাদা মাতা, রাবণ উহার বাপ।
নাম ধরে বীরবাহু দুর্জ্জয় প্রতাপ।।
করিল তপস্যা বীর কঠোর বিস্তর।
তপের কারণে ব্রহ্মা দিতে এল বর।।
ব্রহ্মা বলে হবে তোর সংগ্রামে বিজয়।
দিলা এক হস্তী ঐরাবতের তনয়।।
গজরাজ দিয়া ব্রহ্মা বলিল বচন।
এ গজের মরণেতে তোমার মরণ।।
অবশ্য মরিব তার সন্দেহ যে নাই।
যুদ্ধ করে মরে যেন নারায়ণ পাই।।
ব্রহ্মা বলে নররূপী হবে নারায়ণ।
ইচ্ছাসুখে তাহে দহে করিবে পাতন।।
সেই বীরবাহু এই দুর্জ্জয় শরীর।
বীরবাহু-তেজে রণে কেহ নহে স্থির।।
বীরবাহু জিনিলে রাবণ-রাজা জিনি।
সমুদ্র তরিলে যেন গোষ্পদের পানি।।
বীরবাহু ইন্দ্রজিৎ বীর নাহি আর।
ইহারা মরিবে হবে রাবণ সংহার।।
শ্রীরাম বলেন মিত্র ভরসা তোমার।
তব উপদেশে হৈল সকলে সংহার।।
রাম বিভীষণে এই কথোপকথন।
ডাক দিয়া কহিতেছে রাবণ-নন্দন।।
বীরবাহু বলে শুন শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
আমা সনে তোমরা যুঝিবে কোন্ জন।।
রাম বলে তোমাতে আমাতে আজি রণ।
আজিকার যুদ্ধে তোর বধিব জীবন।।
বানর-কটক সব হও একভিত।
দুজনে করিব যুদ্ধ যেমন প্রমিত।।
এত শুনি বীরবাহু করিছে সমর।
মাথায় টোপর বীর হাতে ধনুঃশর।।
গজস্কন্ধে থাকি ভীর নেহালে শ্রীরাম।
কপটে মনুষ্য-দেহ দূর্ব্বাদলশ্যাম।।
চাঁচর চিকুর শোভে চৌরস কপাল।
প্রসন্ন শরীর প্রভু পরম দয়াল।।
ধ্বজ-বজ্রাঙ্কুশ চিহ্ন অতি মনোহর।
ভুবনমোহন রূপ শ্যামল সুন্দর।।
রামের হাতের ধনু বিচিত্রগঠন।
সকল শরীরে দেখে বিষ্ণুর লক্ষণ।।
নারায়ণ-রূপ দেখি রাবণ-কুমার।
নিশ্চয় জানিল রাম বিষ্ণু-অবতার।।
হাতের ধনুকবাণ ভূমেতে ফেলায়ে।
গজ হৈতে নামি কহে বিনয় করিয়ে।।
ধরণী লোটায়ে কহে যুড়ি দুই কর।
আকিঞ্চনে কর দয়া রাম রঘুবর।।
প্রণমামি রামচন্দ্র সংসারের সার।
সত্যবাদী জিতেন্দ্রিয় রাম-অবতার।।
আদি অনাদি তুমি পুরুষ-প্রধান।
নাশিতে অজেয় অরি শমন সমান।।
পুরুষ প্রকৃতি তুমি, তুমি চরাচর।
তোমার একাংশ ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর।।
অনাথের নাথ তুমি সংসার-তারণ।
সুরাসুর তুমি সৃষ্টি সংহার-কারণ।।
বহু স্তুতি করি বলে রাবণ-নন্দন।
অনুক্ষণ জপে ধ্যানে দেব ত্রিলোচন।।
সাম ঋক্ যজু অথর্ব্ব তোমা হইতে।
অসীম মহিমা গুণ নারি সীমা দিতে।।
হেন পাদপদ্ম দেখিলাম অনায়াসে।
পরিপূর্ণ হইল আমার অভিলাষে।।
তব পাদপদ্মে যেবা নাহি মাগে বর।
বৃথাই জনম তার অবনী ভিতর।।
আপনি করেছে আজ্ঞা না হয় খণ্ডন।
ও পদ স্মরণে হয় পাপ বিমোচন।।
এ ভব সংসার দেখি অকূল পাথার।
রাম-নাম-তরণী করিয়ে হব পার।।
তুমি নারায়ণ ধর্ম্ম ব্রহ্মা-সনাতন।
রাক্ষস-বিনাশকারী ভুবন-মোহন।।
উৎপত্তি প্রলয় তুমি অচিন্ত রতন।
তোমারে চিনিতে প্রভু পারে কোনজন।।
অধম রাক্ষস আমি বড়ই পাপিষ্ঠ।
এ দুঃখে তারিতে প্রভু তুমি মহা ইষ্ট।।
চিরদিন মহাপাপ করেছি অপার।
বৈষ্ণব-অস্ত্রেতে আমার কর হে সংহার।।
এতেক বলিল যদি রাবণ-নন্দন।
রণ ত্যজি রঘুনাথ বসিলা তখন।।
রাম বলে দেখিলাম তব ব্যবহার।
তোমা বধ করা নহে উচিত আমার।।
যাউক জানকী, মোর রাজ্য যাক্ বয়ে।
পুনঃ বনে যাই আমি তোরে লঙ্কা দিয়ে।।
বীরবাহু বলে যে গোসাঞি পরিহার।
তুমি যারে দয়া কর লঙ্কা কোন্ ছার।।
অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড গোসাঞি তোমার শরীরে।
ক্ষুদ্র লঙ্কাপুরী দিয়ে ভাণ্ডিবে আমারে।।
লঙ্কা দিয়ে রঘুনাথ না ভাণ্ডিহ মোরে।
না পারিবে কদাচন এই দুরাচারে।।
এতেক বলিয়া তবে রাবণ-নন্দন।
মনে মনে ভাবে তখন আপন মরণ।।
তুমি না মারিলে আমার না হবে উদ্ধার।
দয়া করে করহ আমার প্রতিকার।।
রণ করে পড়ি যদি প্রভু তব বাণে।
বিষ্ণুদূতে লয়ে যাবে বৈকুণ্ঠ-ভুবনে।।
যাহা লাগি মুনি ঋষি নানা তীর্থে ফিরে।
যাহা লাগি সাধুজন নানা যজ্ঞ করে।।
অনায়াসে পাব আমি হেন গুণনিধি।
বিনা জাতি ব্যবহারে নহে কার্য্যসিদ্ধি।।
এতেক ভাবিয়া মনে রাবণ-কুমার।
এক লাফ দিয়া উঠে গজে আপনার।।
প্রচণ্ড ধনুক ছিল গজের উপরে।
দৃঢ়মুষ্টি অস্ত্র লয়ে বিন্ধে রঘুবীরে।।
হেদে রে তপস্বী বেটা, ভণ্ড বনচারী।
মরণ এড়াতে চাহ করে ভারি-ভূরি।।
কালসর্প সম অস্ত্র দেখহ সর্ব্বথা।
লব শোধ যত দুঃখ পায় মম পিতা।।
মম ইষ্টদেবে আমি করেছি স্তবন।
তুমি মনে করেছ আপনি নারায়ণ।।
বীরবাহু কৈল যদি দুরক্ষর বাণী।
ক্রোধেতে হইল রাম জ্বলন্ত আগুনি।।
সত্ত্বগুণে তমোগুণে বড়ই বিষম।
ক্রোধেতে হইলা রাম কালান্তক যম।।
মার মার বলি রাম যুড়িলেন বাণ।
হাসিয়া ধনুক ধরে রাবণ-সন্তান।।
দুই জনে লাগিল বাণের হানাহানি।
উঠিল আকাশে বাণ-শব্দ ঠনঠনি।।
বাণে বাণে কাটাকাটি উঠিল আগুনি।
স্বর্গেতে দেবতা কাঁপে অসম্ভব গণি।।
দূরে থাকি দেখে কপি উভয়ের রণ।
বাণের বিষম শব্দ উঠিল গগন।।
দুই জনে কাটাকাটি হৈল বাণে-বাণে।
দুজনার উপরেতে দুই জনে হানে।।
অগ্নিবাণ বীরবাহু যুড়িল ধনুকে।
বজ্র সম আসে বাণ রামের সম্মুখে।।
অগ্নিবাণে করে বীর অগ্নি-অবতার।
বরুণ বাণেতে রাম করিল সংহার।।
মহাকোপে বীরবাহু এড়ে দশ বাণ।
শ্রীরামের বুকে ফুটে বজ্রের সমান।।
শরাঘাতে শোণিতে ভাসিল রঘুনাথ।
ভূমিতে পড়িল যেন সূর্য্য হয় পাত।।
পড়িলেন রামচন্দ্র সর্ব্বজন দেখে।
মুখেতে উঠল রক্ত ঝলকে ঝলকে।।
ব্যথা সম্বরিয়া রাম যুড়িলেন বাণ।
বীরবাহু কাটিতে চাহেন ধনুখান।।
তীক্ষ্ণ বাণ মারে রাম ধনুক কাটিতে।
ধনুকে ঠেকিয়া বাণ পড়ে এক ভিতে।।
বীরবাহু বলে, অবধান রঘুনাথ।
আমার ধনুকে মিথ্যা করিছ আঘাত।।
ধনুক কাটিতে না পারিবে রঘুনাথ।
বীরবাহু কহিতেছে করি যোড়হাত।।
অক্ষয় ধনুক আমি করিয়াছি হাতে।
ত্রিভুবনে কার সাধ্য কে পারে কাটিতে।।
ধনু কাটা নাহি গেল শ্রীরাম লজ্জিত।
অর্দ্ধচন্দ্র-বাণ রাম যুড়েন ত্বরিত।।
এড়িলেক বাণ রাম তারা যেন ছুটে।
বাণে বীরবাহুর ধনুক বাণ কাটে।।
ধনুর্ব্বাণ গেল, বীরবাহু উল্লাসিত।
এত দিনে বুঝি বা পূরিল মনোনীত।।
মনেতে জানিলাম আজি নাহি অব্যাহতি।
শ্রীরামের বাণে পড়ে পাইব নিষ্কৃতি।।
একমনে বীরবাহু করিছে স্তবন।
ধনুর্ব্বাণ কাটা গেল অবশ্য মরণ।।
ধনু কাটা গেল বীর আর ধনু লয়।
শরজাল বাণ এড়ে রাবণ-তনয়।।
বাণে আচ্ছাদিল রঘুনাথের উপর।
বাণ দেখে রঘুনাথ হইল ফাঁফর।।
মনে মনে রঘুনাথ করে অনুমান।
ঐষিক-বাণেতে রাম পূরিলা সন্ধান।।
শ্রীরাম ঐষিক-বাণ বসাইলা চাপে।
রাক্ষসের বাণ কাটিলেন বীরদাপে।।
শ্রীরাম কাটেন বাণ মনের কৌতুকে।
দাঁড়ায়ে বানরগণ দূর হৈতে দেখে।।
রাম বলে বীরবাহু তুমি বড় বীর।
তব বাণে মম সৈন্য না হয় সুস্থির।।
বীরবাহু বলে রাম ক্ষণেক থাকহ।
যত দুঃখ দিলে তার প্রতিফল লহ।।
রাক্ষসের বাক্য শুনি কুপিল লক্ষ্মণ।
রাক্ষস উপরে করে বাণ বরিষণ।।
লক্ষ্মণের বাণে বীরবাহু সক্রোধিত।
এড়িল দুর্জ্জয় বাণ অগ্নি প্রজ্জ্বলিত।।
চলিল লক্ষ্মণ-বাণ তারা যেন ছুটে।
এক বাণে রাক্ষসের অগ্নিবাণ কাটে।।
পঞ্চ বাণ লক্ষ্মণ যে যুড়িল ধনুকে।
সন্ধান পূরিয়া মারে বীরবাহু-বুকে।।
বাণাঘাতে বীরবাহু হইল কম্পিত।
লক্ষ্মণ উপরে মারে বাণ আচম্বিত।।
অষ্ট বাণ বীরবাহু যুড়িল ধনুকে।
সন্ধান পূরিয়া মারে লক্ষ্মণের বুকে।।
বীরবাহু-বাণ লক্ষ্মণের ফুটে বুকে।
ঘুরিয়া পড়িল বীর রক্ত উঠে মুখে।।
কতক্ষণে লক্ষ্মণ হইল সচেতন।
পুনরপি দুইজনে হৈল মহারণ।।
লক্ষ্মণে মারিতে বীরবাহু মনে চিন্তি।
বায়ুবেগে হ্স্তী চালাইল শীঘ্রগতি।।
আইসে দুর্জ্জয় হস্তী ত্বরিত গমন।
লক্ষ্মণে মারিল জাঠা রাবণ-নন্দন।।
অতি বেগে এড়ে জাঠা চলে শীঘ্রগতি।
দেখিয়া চিন্তিত বড় হৈলা দাশরথি।।
জাঠার উদ্দেশে রাম এড়িলেন বাণ।
তিন বাণে জাঠারে করিলা খান খান।।
জাঠারে কাটিয়া রাম রাখিলা লক্ষ্মণ।
ডাক দিয়া বলে তবে রাবণ-নন্দন।।
সাক্ষী হও জাম্ববান খুড়া বিভীষণ।
সাক্ষী হও কপিবৃন্দ পবন-নন্দন।।
ক্ষত্রিয়ের ধর্ম্ম এই যুদ্ধে আছে পণ।
যার সঙ্গে যুদ্ধ করে মারে সেই জন।।
আমি জাঠা মারিলাম লক্ষ্মণ উপরে।
তুমি কেন সে জাঠা কাটিলে অবিচারে।।
একের সঙ্গেতে যুদ্ধে অন্যে দেয় হানা।
ধর্ম্মশাস্ত্রে তারে নাহি বলে বীরপণা।।
শ্রীরাম বলেন, শুন রাবণ-নন্দন।
লক্ষ্মণে আমাতে ভিন্ন বলে কোন্ জন।।
বীরবাহু বলে রাম আমি তাহা জানি।
ব্রহ্মাণ্ডে তোমাতে ভিন্ন আছে কোন্ প্রাণী।।
বীরবাহু-বাক্য শুনি লজ্জিত শ্রীরাম।
পুনরপি দুইজনে বাজিল সংগ্রাম।।
গগন ছাইয়া দোঁহে বাণ বরিষণ।
বাণে বাণে কাটাকাটি উঠিছে আগুন।।
দশ বাণ রঘুনাথ যুড়িলা ধনুকে।
বজ্র সম বাজে বাণ বীরবাহু-বুকে।।
বুকে বাণ বাজে, রক্ত উঠে অনিবার।
অচৈতন্য হয়ে পড়ে রাবণ-কুমার।।
রক্তধারে বীরবাহুর ভাসে কলেবর।
গড়াগড়ি যায় বীর গজের উপর।।
বীরবাহু লয়ে গজ উঠিলা গগন।
যোড়হাতে শ্রীরামের বলেন লক্ষ্মণ।।
লক্ষ্মণ বলেন প্রভু করি নিবেদন।
ব্রহ্ম-অস্ত্র মেরে উহার বধহ জীবন।।
রাম বলে এ বেটা রাক্ষস মহাবীর।
ধর্ম্মেতে ধার্ম্মিক বড় সবুদ্ধি সুধীর।।
করিয়ে অন্যায় যুদ্ধ না মারি উহারে।
মারিব ধর্ম্মতঃ যুদ্ধে বীরবাহু বীরে।।
কতক্ষণে রাক্ষস হইল সচেতন।
হরিষ হইয়া বীর কহিছে তখন।।
আরবার এস দেখি রণের ভিতর।
জানিলাম বীর বট তুমি রঘুবর।।
এত বলি ধনুক ধরিল বাম করে।
দেখিয়া রুষিল তবে সুগ্রীব বানরে।।
সুগ্রীব বলেন শুন জগৎ-গোঁসাই।
শুনিয়াছি হস্তী সঙ্গে ইহার প্রমাই।।
হস্তী মৈলে বীরবাহু মরিবে নিশ্চয়।
হস্তীরে মারিয়া কর রাক্ষসের ক্ষয়।।
এত বলি সুগ্রীব পবনগতি ধায়।
দূরে থাকি পাথর সে দেখিবারে পায়।।
দশ যোজন পাথর তুলিয়া লয় হাতে।
দানবে রুষিল যেন দেব জগন্নাথে।।
বীরদর্প করি বীর হানিল পাথর।
দন্ত দিয়া পাথর ধরিল গজবর।।
খান খান করিলেক দন্তের তাড়নে।
শালগাছ সুগ্রীব উপাড়ে একটানে।।
দুর্জ্জয় সে শালবৃক্ষ বিংশতি যোজন।
বৃক্ষের ছায়াতে ঢাকে সূর্য্যের কিরণ।।
অব্যর্থ পাথর গেল সুগ্রীব লজ্জিত।
হানিলেক শালগাছ হইয়া কুপিত।।
গজের মাথায় মারে দুহাতিয়া বাড়ি।
হস্তীর মাথায় গাছ হয়ে গেল গুঁড়ি।।
শুঁড়ে জড়াইয়া হস্তী সুগ্রীবেরে ধরে।
আছাড় মারিয়া তার অস্থি চূর্ণ করে।।
ভূমিতে পড়িয়া রাজা করে ধড়ফড়।
দেখিয়া বানরগণ উঠে দিল রড়।।
মুখে রক্ত উঠে রাজার ঝলকে ঝলকে।
সুগ্রীব মরিল বলি কপিগণ দেখে।।
অনেক যতনে রাজা পাইল চেতন।
রামেরে ডাকিয়া বলে রাবণ-নন্দন।।
একজন উপরেতে দুইজন রোষে।
ধর্ম্ম নাহি সহে তাহা, মরে নিজ দোষে।।
তুমি আমি যুদ্ধ করিতেছি দুই জনা।
বানর আসিয়া কেন মাঝে দিল হানা।।
বনজন্তু যুদ্ধে কিন্তু আম্বা দেখি বাড়া।
সেই পাপে হস্তীতে আছাড়ে করে গুঁড়া।।
বীরবাহু-বাক্যেতে লজ্জিত রঘুবর।
ঈষৎ হাসিয়া রাম করেন উত্তর।।
বণেতে লক্ষ্মণ ছিল হয়ে ব্রহ্মচারী।
সূর্পণখা রাঁড়ী গেল বর বাঞ্ছা করি।।
সেই দোষে নাক কাণ কাটিল লক্ষ্মণ।
বিধবার ধর্ম্ম ভাল করিল পালন।।
তোর পিতা রাবণের এক লক্ষ বেটা।
চৌদ্দহাজার নারী তার বিভা কৈল কটা।।
পরম পাতকী বেটা লঙ্কা-অধিকারী।
জন্মাবধি চুরি করে আনে পরনারী।।
জ্যেষ্ঠ ভাই কুবের ধনের অধিপতি।
তার বধূ হরিয়া আনিল পাপমতি।।
ব্রহ্ম-অংশে জন্ম দেখ যত নিশাচর।
খাইয়া মানুষ পশু পূরয়ে উদর।।
এতদিনে লঙ্কাপুরী পাপে হৈল পূর্ণ।
পাঠাইব যমালয়ে, হবে দর্প চূর্ণ।।
এতেক বলিয়া রাম পূরয়ে সন্ধান।
মারিলা রাক্ষসগণে শত শত বাণ।।
সারিয়া রামের বাণ বীরবাহু বীর।
শত শত বাণে বিন্ধে রামের শরীর।।
বাণে বাণে কাটাকাটি করে দুই জন।
অগ্নিময় বাণ মারে রাবণ-নন্দন।।
বাণের মুখেতে অগ্নি পর্ব্বত প্রমাণ।
বীরবাহু-বাণে রাম হইল অজ্ঞান।।
সম্মুখ যুদ্ধেতে রাম হইলা মূর্চ্ছিত।
দেখিয়া বানরগণ হইল চিন্তিত।।
শীঘ্রগতি আসিয়া রাক্ষস বিভীষণ।
শ্রীরামের ধনুর্ব্বাণ লয়ে করে রণ।।
পঞ্চবাণ বিভীষণ যুড়িল ধনুকে।
সন্ধান পূরিয়া মারে বীরবাহু-বুকে।।
বাণের উপরে বাণ এড়ে বিভীষণ।
ফাঁফর হইল তবে রাবণ-নন্দন।।
বীণে ভীত বীরবাহু চাহে চারিভিতে।
রাম মূর্চ্ছা কেবা বাণ মারে আচম্বিতে।।
হেনকালে দেখে বীর খুড়া বিভীষণ।
বীরবাহু বলে খুড়া সার্থক জীবন।।
বংশ-চূড়ামণি তুমি আছ একজন।
দেব দ্বিজ গুরুভক্ত বুদ্ধে বিচক্ষণ।।
কুলে একজন হলে বিষ্ণুতে ভকতি।
সকল পুরুষ তার পায় দিব্যগতি।।
পরম পুরুষ রাম ব্রহ্ম-সনাতন।
সকল ত্যজিলা তুমি রামের কারণ।।
তোমার চরণে খুড়া করি দণ্ডবৎ।
আশীর্ব্বাদ কর যেন পূরে মনোরথ।।
বিভীষণ বলে বাছা তুমি ভাগ্যবান।
তোমার চরিত্র বাছা না হয় বাখান।।
এইরূপ দুইজনে কথোপকথন।
হেনকালে রঘুনাথ পাইলা চেতন।।
পুনরায় সংগ্রাম বাজিল দুই জনে।
বাণে বাণে কাটাকাটি উঠিল গগনে।।
দুই জনে বাণ মারে যার যত ক্ষিক্ষা।
প্রাণপণে এড়ে বাণ নাহি লেখাজোখা।।
অমর্ত্ত সমর্থ বাণ বলে মহাবল।
বিষ্ণুজাল অগ্নিজাল বাণ কালানল।।
বরুণমুখ উল্কামুখ অতি খরশান।
গ্রহাদি নক্ষত্র রুদ্র জ্যেতির্ম্ময় বাণ।।
শিলীমুখ সূচীমুখ ঘোর দরশন।
সিংহদন্ত বজ্রদন্ত বাণ বিরোচন।।
রিপুহন্তা বিশ্বহন্তা বিপক্ষ সংহার।
চন্দ্রমুখ সূর্য্যমুখ বাণ সপ্তহার।।
কালদণ্ড যমদণ্ড বাণ কর্ণিকার।
ইন্দ্রজাল ব্রহ্মজাল বাণ শতধার।।
গরুড় অসুরমুখ হংসমুখ বাণ।
ধূম্রমুখ কূর্ম্মমুখ শমন সমান।।
নীল হরিতাল বাণ বিকট দশন।
বিলাপ প্রলাপ বাণ মহা-পদ্মাসন।।
ভয়ঙ্কর দুষ্কর কামিনী মনোহর।
পাশুপত হয়গ্রীব দেখিতে সুন্দর।।
কুবের পবন-অস্ত্র অতি খরশান।
নবঘন উল্কা বাণ কে করে বাখান।।
শোষক অশোক বাণ অঙ্গ যে বিভঙ্গ।
ত্রিশূল অঙ্কুশ বাণ বিহ্বল মাতঙ্গ।।
বিকট সঙ্কট বাণ সাথকি পথিক।
মাল্যবাণ হীরাবন্ত শারঙ্গ ঐষিক।।
গজাঙ্কুশ শিলাচূর্ণ গভীর গরজে।
যাইতে বাণের মুখে জয়ঘণ্টা বাজে।।
এত বাণ দুই জনে করে অবতার।
সব লঙ্কাপুরী কৈল বাণে অন্ধকার।।
জিনিতে না পারে কেহ সমান দুজন।
দুই জনে মহাযুদ্ধ না যায় লিখন।।
ব্রহ্মার নিকটে পূর্ব্বে পেয়েছিল বাণ।
সেই বাণ বীরবাহু পূরিল সন্ধান।।
মন্ত্রেতে হইল বান অতি ভয়ঙ্কর।
মহাতেজে আসে বাণ রামের উপর।।
বিপরীত ব্রহ্ম-অস্ত্র দেখিয়া সম্মুখে।
তীক্ষ্ণ অস্ত্র রঘুনাথ যুড়িলা ধনুকে।।
শ্রীরামের বাণ ব্যর্থ রাক্ষসের শরে।
দেখিয়া সে রঘুনাথ চিন্তিল অন্তরে।।
রাক্ষসের বাণের মুখেতে অগ্নি জ্বলে।
দেখিয়া ত পুরন্দর পবনেরে বলে।।
শরভঙ্গ-মুনি স্থানে পাইলা যে শর।
সেই বাণ রাক্ষসেরে মারুন রঘুবর।।
এত যদি পুরন্দর কহে পবনেরে।
পবন গোপনে গিয়া কন রঘুবরে।।
যে বাণ পাইলে রাম শরভঙ্গ স্থানে।
বীরবাহুর ব্রহ্ম-অস্ত্র কাট সেই বাণে।।
এত বলি পবন পলায় উভরড়ে।
সেই বাণ তখন রামের মনে পড়ে।।
তূণ হৈতে সেই অস্ত্র লয়ে শীঘ্রগতি।
মন্ত্র পড়ি ধনুকে যুড়িলা রঘুপতি।।
আকর্ণ পূরিয়া বাণ যুড়িল ধনুকে।
ব্রহ্ম অগ্নি প্রজ্বলিত হৈল অস্ত্রমুখে।।
কোপে কম্পমান বাণ ছাড়ে দাশরথি।
বাণের প্রতাপে মহাকম্প বসুমতী।।
শ্রীরাম এড়িল বাণ বায়ুবেগে চলে।
রাক্ষসের ব্রহ্ম-অস্ত্র কাটে অবহেলে।।
পুনঃ শ্রীরামের বাণ গর্জ্জিয়া উঠিল।
কাটিয়া গজেন্দ্র-মুণ্ড ভূতলে পাড়িল।।
গজবর পড়িল দেখিতে ভয়ঙ্কর।
পর্ব্বত পড়িল যেন ধরণী উপর।।
এক ঠাঁই স্কন্ধ পড়ে, মুণ্ড আর ভিতে।
লাফ দিয়া বীরবাহু দাণ্ডায় ভূমিতে।।
কোপমনে শ্রীরাম মারেন পঞ্চ বাণ।
বীরবাহুর ধনুক করেন খান খান।।
ব্রহ্ম-অস্ত্রে ধনুক কাটেন রঘুনাথ।
কহিতেছে বীরবাহু করি যোড়হাত।।
জানিলাম রাম তুমি বিষ্ণু-অবতার।
অগতির গতি তুমি সংসারের সার।।
শ্রীচরণে অধীনের এই নিবেদন।
বৈষ্ণব-অস্ত্রেতে মোরে করহ নিধন।।
বীরবাহু কহিলেক করুণ বচন।
মনে বিষাদিত হৈল কমল-লোচন।।
বীরবাহু না মরিলে না মরে রাবণ।
এতেক ভাবিয়া রাম বিষণ্ণ বদন।।
দুর্জ্জয় বৈষ্ণব অস্ত্র ধনুকেতে যুড়ি।
আকর্ণ পূরিয়া গুণ বাণ দেন ছাড়ি।।
মহাবেগে যায় অস্ত্র শব্দ বিপর্য্যয়।
দেব দানব গন্ধর্ব্ব লোকেতে লাগে ভয়।।
চলিল বৈষ্ণব-অস্ত্র বিষ্ণু-অবতার।
রামের বাণেতে দীপ্ত হইল সংসার।।
অব্যর্থ বৈষ্ণব-বাণ কি কহিব কথা।
মুকুট সহিত কাটে বীরবাহু-মাথা।।
ভূমিতে পড়িয়া মুণ্ড রাম রাম বলে।
বিভীষণ দিল মুণ্ড রাম-পদতলে।।
বিষ্ণু-অস্ত্রে পড়ি বীরবাহু মুক্ত হয়।
রামের চরণে লাগে হয়ে জ্যেতির্ম্ময়।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ হনুমান বিভীষণ।
চারিজন দেখয়ে না দেখে কোন জন।।
রণ জিনি শ্রীরাম লক্ষ্মণ কোলাকুলি।
উচ্চৈঃস্বরে ডাকে কপি রামজয় বলি।।
বানর-কটক বলে করিলে নিস্তার।
আর যত বীর আছে মোসবার ভার।।
হাসিয়া চাহেন রাম বিভীষণ পানে।
এই মত বীর আর আছে কত জনে।।
বিভীষণ বলে প্রভু বীর নাহি আর।
রাবণ ও ইন্দ্রজিৎ রাবণ-কুমার।।
কৃত্তিবাস পণ্ডিতের মধুর ভারতী।
লঙ্কাকাণ্ডে পড়ে বীরবাহু যোদ্ধৃপতি।।