রোমে গিয়ে রোমানদের মতন আচরণ করাই বিধিসঙ্গত, এবং মোগলদের হাতে পড়লে মোগলাইখানা খাওয়াই উচিত হলেও ফ্রান্সে এসে ফরাসি ভাষার কথা বলার চেষ্টা করা খুব। একটা সুবিধাজনক নয়। ফরাসিরা ইংরেজি বোঝে না, কিংবা বুঝতে চায় না আর ভাঙা-ফরাসি শুনলে ভুরু একেবারে কপালের শেষ সীমায় তুলে আনে।
আমার এক বন্ধু ফ্রান্স ঘুরে এসে বলেছিল, প্যারিসের চ্যাম্পাস এলিসিস রাস্তাটা বড় সুন্দর। তাই শুনে আমরা হেসেছিলুম। আমরা জানি, ইংরেজি বানানে প্যারিসের ওই বিশ্ববিখ্যাত রাস্তাটির নাম ওই রকম হলেও, আসলে ওই রাস্তাটির নাম সাঁজেলিজে। কিন্তু আমাদের এই অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী সম্বল করে ফ্রান্সে এলে কোনও লাভ হয় না। পথে কোনও ফরাসিকে যদি জিগ্যেস করি, সাঁজেলিজে কোন দিকে, সে অমনি ভুরু দুটো ধনুক করে ফেলে। পাঁচবার বললেও বোঝে না। আসলে, সাঁ জে লি জে এই প্রত্যেকটা মাত্রার উচ্চারণ অন্য রকম, যা আমাদের জিভে চট করে আসে না। একটু উচ্চারণের হেরফেরে খুব চেনা জিনিসও দুর্বোধ্য হয়ে যায়। কী এক প্রসঙ্গে একজন ফরাসি আমাকে পাঁচবার ধরে বলল, হ্ৰাদিয়ো, হ্রাদিয়ে! তখন আমারও ভুরুর অবস্থা সেইরকম। কী করে বুঝব যে সে বলতে চাইছে রেডিও!
এক অক্ষর ফরাসি না জানলেও কিন্তু ফরাসিদেশের ট্রেনে চলাচল করতে কোনো অসুবিধে হয় না। এই চমৎকার ব্যবস্থা দেখে চমৎকৃত না হয়ে উপায় নেই। হাতে একটা ম্যাপ থাকলে কারুকে কিছু না জিগ্যেস করেও ইচ্ছে মতন যেকোনও ট্রেনে চলাফেরা করা যায়। শুধু একটু ধৈর্য লাগে, প্রথম দু-একবার হয়তো স্টেশন ভুল হয়ে যায়। কিন্তু তাতে ক্ষতি নেই, এদেশে একবার ট্রেনে চাপবার পর বারবার স্টেশন বদলাবদলি করলেও অতিরিক্ত পয়সা লাগে না।
হোটেলে থাকার পয়সা নেই, তাই উঠেছি এক বাঙালির বাড়িতে। অসীম রায় মশাইয়ের সঙ্গে আগে থেকে একটু চেনা ছিল, তিনি দয়া করে আশ্রয় দিয়েছেন। তাঁর বাড়ি একটু শহরতলিতে, প্যারিস থেকে কুড়ি-পঁচিশ মাইল দূরে। এদেশে শহরতলিতে থাকার তো কোনও অসুবিধে নেই, আমাদের কলকাতার মতন তো হাওড়া-শিয়ালদার দুই বিরাট সিংহ দরজা দিয়ে শহরে ঢুকতে হয় না লোকাল ট্রেন নামক আলুর বস্তায় বন্দি হয়ে!
অসীমবাবু প্রথম দিন একটু ট্রেনের ব্যবস্থাটা বুঝিয়ে দিলেন, তারপর থেকে আমি স্বাধীন। যখন খুশি যাই আসি। জানি যে, যে-কোনও স্টেশনে নেমে দাঁড়ালেই পনেরো-কুড়ি মিনিটের মধ্যে ট্রেন আসবেই। ট্রেনে জায়গা পাওয়ার কোনও সমস্যা নেই। যেকোনও স্টেশন থেকেই দু তিন বার ট্রেন বদলে আমার গন্তব্যস্থলে পৌঁছোতে পারব। এক টিকিটেই যতবার খুশি ট্রেন বদলানো যায়। প্রত্যেক স্টেশনেই বিভিন্ন লাইনের ট্রেনের সব স্টেশনের তালিকা লেখা আছে বড়-বড় অক্ষরে।
এক-একটা স্টেশনকে মনে হয় ভূতুড়ে স্টেশনের মতন। কুলি-কামিন তো নেই বটেই, ইস্টিশন মাস্টার নেই, টিকিট চেকার নেই, এমনকী টিকিট ঘরও নেই। টিকিট কাটার যন্ত্র আছে, সেখানে পয়সা ফেললে টিকিট বেরিয়ে আসবে। পাতলা কাগজের টিকিট। গেট দিয়ে ঢোকার মুখে একটা ফুটোর মধ্যে সেই টিকিটটা ঢুকিয়ে দিলেই একটু দূরের আর একটা ফুটো দিয়ে টিকিটটা বেরিয়ে আসবে। সেখানে যে লোহার ডান্ডাটা পথ আটকে ছিল, সেটাও সরে গিয়ে পথ করে দেবে সঙ্গে-সঙ্গে।
আগের দিনের একটা পুরোনো টিকিট ঢুকিয়ে দিলে কিন্তু সেটা আর বেরিয়ে আসবে না। ডান্ডাটাও সরে যাবে না। ঠিক চিনতে পারে। আবার এখানে সাত দিনের জন্য সিজন টিকিট কিনতে পাওয়া যায় বেশ সস্তা, সে-ও একখানাই পাতলা কাগজের টিকিট, আপাত দৃষ্টিতে দৈনিক টিকিট আর সিজন টিকিটের চেহারার কোনও তফাত নেই, গেটের ফুটোয় সেই টিকিট ঢোকালে গেটের যন্ত্র ঠিক বোঝে, দরজা খুলে টিকিটখানা ফেরত দেয়। সাত দিনের বেশি আট দিন ব্যবহার করতে গেলেই টিকিটখানা হজম হয়ে যাবে। আজব কাণ্ড একেই বলে।
স্টেশনে ঢোকবার গেট মাত্র কোমর সমান উঁচু। ডান্ডা খুলুক বা না খুলুক লাফিয়ে পেরিয়ে যাওয়া কিছুই শক্ত নয়। একটু হাই-জাম্প দিতে পারলেই হয়। তা ছাড়া দেখবার তো কেউ নেই। এমনও হয়েছে যে-কোনও দুপুরে আমি এরকম কোনও স্টেশনে দ্বিতীয় কোনও যাত্রী পর্যন্ত দেখিনি। সুতরাং টিকিট না কেটেও কেউ হয়তো কখনও এরকম লাফিয়ে গেট পার হয়ে যায়। আমি একবারও চেষ্টা করিনি। যা সব ময়দানবের কারবার এদেশে। লাফিয়ে ডিঙোতে গেলে ওই লোহার ডান্ডাটাও লাফিয়ে উঠে মাথায় মারে কি না তাই-ই বা কে জানে!
বাঙালি পাঠক মাত্রই জানে যে প্যারিস শহরের ট্রেনের নাম মেত্রো, এবং তা মাটির নীচে। শহরতলির ট্রেন কিন্তু বেশিরভাগ জায়গাতেই মাটির ওপর দিয়ে যায়, দু-ধারের সব দৃশ্য চোখে পড়ে। তবে শহরতলিতেও অনেক স্টেশনই বেশ উঁচুতে, সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে হয়। আমার স্টেশনটা সেই রকম। একদিকে সিঁড়ি, অন্যদিকে এলিভেটর। সে এলিভেটর সারা দিন আপনাআপনি চলছে, লোক থাকুক বা না-ই থাকুক। এমনও হয়েছে যে দুপুরবেলা ট্রেনে চেপে দেখেছি, গোটা ট্রেনে সবশুদ্ধ দশ-পনেরো জন যাত্রী, আমার কামরায় আমিই আলেকজান্ডার সেলকার্ক!
ভূতুড়ে স্টেশন এই জন্য বলছি যে, স্টেশন মাস্টার, কুলি, টিকিটবাবু এইসব কিছু নেই তো বটেই, সিগন্যাল বদলটদলও আপনা-আপনি হয়। সবই নাকি কমপিউটার নামক দৈত্যের কীর্তি। ট্রেন একেবারে কাঁটায়-কাঁটায় ঠিক সময় প্লাটফর্মের ঠিক নির্দিষ্ট জায়গায় এসে থামে। আপনা-আপনি দরজা খুলে যায়, ঠিক এক মিনিট পরে আবার আপনিই দরজা বন্ধ হয়ে যায়, ট্রেন চলতে শুরু করে। আমার ধারণা, এই সব ট্রেনের কোনও ড্রাইভার থাকে না, অন্তত তাদের চোখে দেখা যায় না। আমি তো কখনও দেখিনি।
কামরার দুপাশে বিরাট-বিরাট কাঁচের জানলা। এক-এক সময় মনে হয় পুরো ট্রেনটাই কাঁচ দিয়ে তৈরি। কাঁচের এত বেশি ব্যবহার যে সম্ভব, ভারতবর্ষের বাইরে না এলে বোঝা যায় না। আমস্টারডার্মের ভ্যানগগ মিউজিয়ামের চার-পাঁচতলা বাড়িটার সব দেয়ালই তো বলতে গেলে কাঁচের। পুরোনো মিউজিয়ামগুলোর সামনে বিশাল মোটা-মোটা থাম, পুরু দেওয়াল, অট্টালিকার সৌন্দর্যই প্রথমে চোখ টানে। মনে হয় রাজপ্রাসাদ। লুভর মিউজিয়াম তো এককালে ফরাসি সম্রাটদের রাজপ্রাসাদই ছিল। সেই তুলনায় আধুনিক শিল্প ভবনগুলি অতি ছিমছাম। প্যারিসের নবতম শিল্প ভবন, যেটি প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি পঁমপিদু-র নামে নামাঙ্কিত, সেই বাড়িটির স্থাপত্য নিয়ে তো দেশ-বিদেশে পক্ষে-বিপক্ষে বহু আলোচনাই হয়েছে। অনেকে এখনও খেদের সঙ্গে বলেন, ওটা দেখলে কি আর্ট গ্যালারি মনে হয়, না কারখানা?
দূর থেকে পঁমপিদু সেন্টার দেখে প্রথমে আমিও খানিকটা হতাশ হয়েছিলুম বটে, প্রথম নজরে কারখানার মতনই মনে হয়। কিংবা মনে হয় একটা অসমাপ্ত অট্টালিকা, এখনও অনেক কাজ বাকি; শুধুমাত্র কঙ্কালটা তৈরি হয়েছে। চতুর্দিকে মোটামোটা পাইপ, আর নানা রকম তার ঝুলছে, দেওয়াল-টেওয়াল তোলা হয়নি। পরে, ভালো করে ঘুরে দেখে আমি বাড়িটির প্রতি রীতিমতন মুগ্ধ হয়ে পড়ি। মনে হয় যেন ভবিষ্যৎকালের ভাস্কর্য, আগামী শতাব্দীর কোন প্রাসাদে এসেছি। অত বড় বাড়িতে সত্যিই কোনও দেওয়াল নেই, সবই জানলা, ইস্পাত আর কাঁচ ছাড়া সিমেন্ট কংক্রিটের ব্যবহারই হয়নি। বাড়িটাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে কাঁচের সুড়ঙ্গ, যার নাম স্যাটেলাইট, তারমধ্যে আছে চলন্ত সিঁড়ি। প্যারিসের নতুন বিমান বন্দরেও এই স্যাটেলাইটের খুব প্রাবল্য। প্রায় মাইলখানেকের পথ এক পা-ও না হেঁটে পার হওয়া যায়। যেকোনও মিউজিয়ামে বা আর্ট গ্যালারিতে ঘোরাঘুরি করতে-করতে পা ব্যথা হয়ে যায়, পঁমপিদু সেন্টারে সে অসুবিধে নেই, মানুষ দাঁড়িয়ে থাকে, সিঁড়ি দৌড়োয়।
প্যারিস-মুখী ট্রেনের কাঁচের জানলার ধারে বসে বাইরের দৃশ্য দেখতে-দেখতে নিজের দেশের কথা মনে পড়ে। বেশ মনে আছে, ছেলেবেলায় আমরা প্রায়ই ট্রেনের জানলা দিয়ে ওঠানামা করতুম। তখন অত আগে থেকে রিজার্ভেশানের ব্যবস্থা ছিল না, যে আগে উঠে দখল করতে পারে, তারই জায়গা। পুজোর সময় দেওঘর-মধুপুরে যাবার সময় প্রত্যেক কামরার কাছে ভিড় ঠেলাঠেলি, সেই সময় বাবা-কাকারা আমাদের মতন ছোটদের চট করে জানলা গলিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে দিতেন।
এখন সব ট্রেনের জানলায় লোহার গরাদ। তাতে জানলা দিয়ে লোকজনের ওঠানামা বন্ধ হয়েছে বটে কিন্তু আর একটা জিনিস বন্ধ করা যায়নি। বছরখানেক আগে আমি একদিন মেচেদা লোকালে চেপে হাওড়া ফিরছিলুম, তখন ঠিক দুপুর। কামরায় যথেষ্ট ভিড় থাকলেও আমি সৌভাগ্যবশত জানলার পাশে একটা সিট পেয়ে দুধারের পানা-পুকুর ও সদ্য ধানকাটা শূন্য প্রান্তরের সৌন্দর্য উপভোগ করছিলুম, এমন সময় থপ করে এক তাল গোবর আমার কানের পাশে ও ঘাড়ে এসে লাগল। এমনই চমকে উঠেছিলুম যে মনে হয়েছিল কেউ আমায় গুলি করেছে। সহযাত্রী অনেকেই হেসে উঠল, যারা দাঁড়িয়ে ঝুলতে-ঝুলতে যাচ্ছিল তাদের মনের ভাব যেন, খুব তো আরামে জানলার কাছে বসে যাওয়া হচ্ছিল, এবার হল তো? কয়েকজন বলল, তবু তো আপনার কিছু হয়নি, শুধু গোবর, এসব জায়গায় এই এত বড় সব থান ইট ছুঁড়ে মারে, এই তো পরশুদিনই একজনের মাথা ফেটে গেসল….।
এখানেও আমি এক দুপুরের ট্রেনের যাত্রী। এই কাঁচের ট্রেনে যদি কেউ ইট ছুঁড়ে মারে…কিন্তু কে মারবে, রাস্তায় তো একটাও লোক নেই! এই সব শহরতলি অঞ্চলে দুপুর কেন, সকাল বা সন্ধেবেলাতেও ক্বচিৎ পায়ে-হাঁটা মানুষ দেখা যায়। আর ফ্রান্সে এসে এ পর্যন্ত একটাও বাচ্চা ছেলে-মেয়ে দেখেছি কি না মনেই পড়ে না। ছোট ছেলেমেয়েদের যে এরা কোথায় লুকিয়ে রাখে তা কে জানে!
বাইরের দুধারের দৃশ্যকেও দৃশ্য না বলে কাল্পনিক ছবি বললেই ভালো মানায়। পুতুলের বাড়ির মতন সব রঙিন, চুড়োওয়ালা বাড়ি। আমরা সমতল ছাদ দেখতে অভ্যস্ত, এদের সব বাড়ির ছাদ ত্রিকোণ। ফ্রান্সে আকাশ-ঝাড় বাড়ি অর্থাৎ স্কাই-স্ক্র্যাপার এখনও তেমন বেশি নয়। প্যারিস শহরে কয়েকটি উঠতে শুরু করেছিল, পরে, শহরের সৌন্দর্য নষ্ট হবে বলে সেরকম বাড়ি তৈরি নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন শহরতলির দিকে সেরকম কিছু বাড়ি উঠলেও এখনও চোখকে তেমন পীড়া দেয় না। ট্রেনের জানলায় দুপাশে অধিকাংশ বাড়িই ছবির বাড়ির মতন। ফরাসিদের বাড়ির সামনে যাহোক ছোটখাটো একটা বাগান থাকবেই। সেই সব বাগানে প্রধান ফলের গাছ দুটি, আপেল ও ন্যাসপাতি। এ ছাড়া আঙুর, বেদানা, স্ট্রবেরি ইত্যাদি। আমরা বরাবর জানি, খুব অসুখ-বিসুখ করলে সান্ত্বনা হিসেবে ওই সব দামি ফল খেতে দেওয়া হয়। কিংবা হাসপাতালে কারুকে দেখতে গেলে নিয়ে যেতে হয়। কিন্তু সেই সব দুমূল্য ফল রাস্তার দুপাশে ঝুড়ি-ঝুড়ি ফলে আছে, এ কি আমাদের বাঙালি চোখে সহজে বিশ্বাস হয়।
এ ট্রেনের কামরায় আমি যখন উঠেছিলুম, তখন আর কেউ ছিল না। দু-স্টেশন পরে একজন বছরপঁয়তিরিশেক বয়েসের ভদ্রমহিলা উঠেছেন, তার তিন স্টেশন পরে একটি কুচকুচে কালো যুবক। তার শরীরটি এমনই মজবুত যে কয়েক পলক তাকিয়ে দেখতে হয়। মহিলাটি একটি রঙিন পত্রিকা খুলে রেখেছেন চোখের সামনে, আর যুবকটি পা ছড়িয়ে প্রায় ত্রিভঙ্গ মুরারি অবস্থায় বসে বেশ গলা ছেড়ে গান শুরু করে দিল। ব্যক্তি স্বাধীনতার দেশ, এ দেশে কারুর কোনও ব্যবহারেই কেউ বাধা দেয় না। অন্যের খুব একটা অসুবিধে না হলেই হল। ট্রেনের কামরায় গান জিনিসটা নিশ্চয়ই কোনও অসঙ্গত ব্যাপার নয়। আমি তো আমার দেশে যখন লোকাল ট্রেনে চাপি, তখন ভিড় আর গরমের মধ্যে যখন যখন ভিখারিরা এসে গান শোনায়, সেইটুকু সময়ই স্বস্তি পাই। আমাদের লোকাল ট্রেন খানিকটা সহনীয় করে রেখেছে ওইসব গায়করাই।
এই কালো ছেলেটির গানের গলা বেশ ভালো। এমন সুদেহী একজন যুবকের কণ্ঠস্বরও যে এত সুরেলা হবে, তা যেন ঠিক বিশ্বাস করা যায় না। হয়তো সে একজন পেশাদার গায়ক। গানের কথাগুলি ফরাসি, সুতরাং আমি ঠিক বুঝতে পারলুম না। কিন্তু সুরটা খুব বিষাদ মাখা। এই ছেলেটি ন্যাট কিং কোলের কোনও ভাইটাই নয়তো? প্রকৃতির কি বিচিত্র খেলা, গান আর ঘঁষোঘঁষির মতন দুটি পরস্পর বিরোধী ব্যাপার কুচকুচে কালো মানুষরাই প্রায় একচেটিয়া করে রেখেছে।
আবার নিজের দেশের কথা মনে পড়ল। তুলনাও এসেই যায়। ভাবা যায় কি, খড়দা কিংবা এঁড়েদা স্টেশান থেকে আমি লোকাল ট্রেনে চেপে শিয়ালদায় যাচ্ছি, কামরায় মাত্র তিনজন যাত্রী, তার মধ্যেও একজন আবার ন্যাট কিং কোলের ভাই, যে বিনা পয়সায় দুর্দান্ত গান শোনাচ্ছে। একটা দেশে যে কত লোক বেকার, তা বোঝা যায় দুপুরবেলার ট্রেনে বা রাস্তায় জনসংখ্যা দেখে। আমাদের দেশে তো প্রত্যেকটি নিশ্বাসের সঙ্গে-সঙ্গে কয়েক হাজার জনসংখ্যা বাড়ে। ফ্রান্সে নাকি জনসংখ্যা কমতির দিকে। এদেশে নাকি যে মা বেশি সন্তানের জন্ম দেয়, সেই মা সরকারের কাছ থেকে টাকা পায়। সত্য, সেলুকাস!
দুপাশের রৌদ্র ঝলমল প্রকৃতি ছেড়ে ট্রেনটা যখন অন্ধকারে ডুব দেয়, তখন বুঝতে পারি প্যারিস শহরের হৃৎপিণ্ডের কাছাকাছি এসে গেছি। দিনে-দুপুরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে ট্রেন যাত্রা আমি ঠিক পছন্দ করতে পারি না। এবারে নামবার জন্য তৈরি হই।
এক সময় প্যারিসে লে আল অঞ্চলে একটি বিখ্যাত কাঁচা বাজার ছিল। আগেকার অনেক গল্প-উপন্যাসে সেই নৈশ বাজারের বর্ণনা আছে। এখন সেই প্রাচীন বাজার ভেঙেচুরে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে সেখানে সব নতুন হৰ্ম আর বিপণি তৈরি হয়েছে। সেটাই তো যুগের নিয়ম। কিন্তু আমি ছেলেবেলায় একবার ক্যানিং শহরের রাতের বাজার দেখতে গিয়েছিলুম। প্রায় কুড়ি বছর পরে আবার ক্যানিং-এ গিয়ে দেখি, বাজারের চেহারা অবিকল একই রকম আছে, শুধু রাস্তাঘাট বেশি ক্ষয়ে গেছে আর জলকাদা বেড়েছে। কিন্তু গল্প-উপন্যাসে জলকাদা মাখা প্যারিসের লে আল বাজারের যে বর্ণনা পড়েছি সে তুলনায় এখনকার লে আল চিনতেই পারা যায় না।
লে আল নামে দুটি স্টেশন আছে। একটি শুধু লে আল আর অন্যটি সাতলে-লে আল। কিন্তু আমি যে ট্রেনে চেপেছি, তার কামরার নির্দেশনামা পড়ে দেখলুম, এ ট্রেন ও দুটো স্টেশনের কোনওটাই ছোঁবে না। যাবে শুধু সাতলে নামে আর একটি স্টেশনে। চিন্তার কিছু নেই, ওই সাতলে-তে নেমে ট্রেন বদলে আমার অভীষ্ট স্টেশনে চলে গেলেই হবে।
সবগুলো নয়। কিন্তু প্যারিসের মেত্রোর কয়েকটি স্টেশন এতই সুন্দর আর চাকচিক্যময় যে শুধু স্টেশনটাই ঘুরে-ঘুরে দেখতে ইচ্ছে করে। একতলা-দোতলা-তিনতলায় আলাদা-আলাদা লাইন তো আছে বটেই তা ছাড়া গঠন শৈলীও বড় অপরূপ। লুভর নামে স্টেশনটিতে নামলেই বোঝা যায় যে বিশ্ব বিখ্যাত মিউজিয়ামের পাড়ায় এসে পড়া গেছে। কারণ, স্টেশনেই সমস্ত বড় বড় শিল্পীদের কাজের নমুনা রয়েছে। কোনও কোনও স্টেশন যেন পালের রাজপুরী। এত আলো, এত সাজ সজ্জা, এত দোকানপাট যে মনেই থাকে না, মাটির দুতিন তলানীচে রয়েছি।
সাতলে স্টেশনটিও এরকম বৃহৎ ও সুসজ্জিত। সেখানে নেমে একটি বৃত্তান্ত জেনে চমৎকৃত হলাম। সেখান থেকে সাতলে-লে আল যেতে হলে ট্রেন বদলে যাওয়া যায়, অথবা দুই স্টেশনের মাঝখানে চলন্ত রাস্তা ও চলন্ত সিঁড়ি আছে। সেখানে গিয়ে দাঁড়ালে বিনা পরিশ্রমেই পৌঁছনো যাবে। ধরা যাক, আমাদের বালি আর উত্তরপাড়ার মতন কাছাকাছি স্টেশন, ইচ্ছে করলে ট্রেনেও যেতে পারি, অথবা চলন্ত রাস্তাই আমায় নিয়ে যাবে!
আমি মস্কো যাইনি এখনও। প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখে শুনেছি, মস্কোর পাতালরেল নাকি আরও সুন্দর, স্টেশনগুলি প্রত্যেকটিই অপরূপ, মনোহর। আগে মস্কো যাই একবার, তারপর নিজের চোখে দেখে বিশ্বাস করব। আমি বিলেতে একাধিকবার গেছি বটে, কিন্তু কার্যকারণবশত একবারও টিউবে চড়া হয়নি। কেন জানি না, বিলেতের লোকেরা আমাকে বোধহয় কোনও মহারাজা-টহারাজা বলে ভুল করে। সেই জন্য গাড়িতে-গাড়িতে ঘোরায়। যাই হোক, বিলেতের টিউব ট্রেন সম্পর্কেও খুব একটা আহামরি প্রশংসা শুনিনি কারুর মুখে। নিউ ইয়র্ক বা শিকাগো সাবওয়ে চাপলে সর্বক্ষণ মনে হয় দমবন্ধ হয়ে আসছে। তা ছাড়া বেশ নোংরা। নিউ ইয়র্কের সাবওয়ের প্রত্যেক ট্রেনের ভেতরে-বাইরে হিজিবিজি দাগ কাটা। স্টেশনগুলো নিছক কালো, নিষ্প্রাণ, রাতের দিকে নিরিবিলিতে গেলে গা ছমছম করে। নিউ ইয়র্কের একমাত্র গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশন ছাড়া আর কোনও স্টেশনেরই কোনও সৌন্দর্য নেই। নিউ ইয়র্ক কিংবা শিকাগোর শহরতলির ট্রেন অবশ্য বেশ জমকালো, শিকাগোতে দোতলা ট্রেনও আছে। কিন্তু ভাড়া ভয়ানক বেশি। আর, দু-একটা জিনিস দেখলে আমাদেরও হাসি পায়।
সাধারণভাবে মনে হতে পারে যে পৃথিবীর যে-কোনও দেশের তুলনায় আমেরিকার ট্রেন অনেক বেশি যন্ত্র নির্ভর হবে। কিন্তু ঠিক তার উলটো। শিকাগো বা নিউ ইয়র্কের শহরতলির ট্রেনে চাপা মাত্র চেকার এসে টিকিট দেখতে চায়। শহরতলির স্টেশনগুলো এঁড়েদা-খড়দার চেয়েও খারাপ। সব চেয়ে মুশকিল, রাত্তির বেলা ঠিক স্টেশন খুঁজে পাওয়া। স্টেশনগুলোতে টিমটিম করে আলো জ্বলে, কোথায় যে সে স্টেশনের নাম লেখা থাকে খুঁজেই পাওয়া যায় না। ফ্রান্সের মতন প্রত্যেক কামরায় পরপর সব স্টেশনের নাম লেখাও থাকে না। সেইজন্য, এই যন্ত্রযুগেও, প্রতিটি স্টেশন এলে ট্রেনের কন্ডাক্টরবাবু হেঁড়ে গলায় সেই স্টেশনের নামটা শুনিয়ে দেন। কিন্তু বাইরের লোকের পক্ষে সেই উচ্চারণ শুনে বোঝা অতি দুষ্কর। ‘ম্যা ভ্যানন’ শুনে কার বাপের সাধ্য বোঝে, যে সেটা মাউন্ট ভার্নন? নিউ ইয়র্ক থেকে মাত্র পঁচিশ মাইল দূরের স্টেশনে এখনও কাঠের সিঁড়ির ওভারব্রিজ আছে, প্যারিসে বসে যা বিশ্বাসই করা যায় না।
অবশ্য, গোটা আমেরিকাতেই এখন ট্রেন-ব্যবস্থা অতি মুমূর্ষ। অর্ধেক রেল-রুট এর মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে, দশ-পনেরো বছর পর হয়তো ট্রেন নামক প্রাণীটি এ দেশ থেকে একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সে দেশ এখন আকাশে উড়ন্ত। কোথাও-কোথাও বাস ভাড়ার চেয়ে প্লেন ভাড়া সস্তা।
আমি প্যারিস ও শহরতলির ট্রেন ব্যবস্থার কথা সবিস্তারে লিখলুম এই জন্য যে কয়েক বছর পরেই তো কলকাতার পাতালরেল চালু হচ্ছে। তখন মিলিয়ে দেখতে হবে। আমার তো ধারণা, কলকাতার পাতালরেল প্যারিসের চেয়ে, এমনকী, মস্কোর চেয়েও সুন্দর ও আধুনিক হবে অনেক বেশি।