৪৮তম অধ্যায়
অর্জ্জুনের অভ্যুদয়ে ধৃতরাষ্ট্রের উদ্বেগ
জনমেজয় জিজ্ঞাসা করিলেন, হে বিপ্ৰ! রাজা ধৃতরাষ্ট্র অমিততেজাঃ অৰ্জ্জুনের এই অত্যুদ্ভূত কর্ম্ম শ্রবণ করিয়া কি করিয়াছিলেন?
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে রাজন! মহাপ্রাজ্ঞ ধৃতরাষ্ট্র মহর্ষি দ্বৈপায়নের সমীপে অর্জ্জুনের ইন্দ্ৰলোকগমনবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া সঞ্জয়কে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “হে সূত! আমি ধীমান্ পার্থের সমুদয় কাৰ্য্য শ্রবণ করিয়াছি, বোধ হয়, তুমিও তাহা আনুপূর্ব্বিক অবগত হইয়াছ। হে সারথে! আমার পুত্ৰ দুশ্চরিত্র পাপমতি দুৰ্য্যোধন সর্ব্বদা গ্ৰাম্যধর্ম্মে প্ৰমত্ত, অতএব সে অতি শীঘ্রই রাজ্যচ্যুত হইবে। যে মহাত্মা স্বভাবতঃ সকল বিষয়েই সত্যকথা কহিয়া থাকেন ও ধনঞ্জয় যাহার যোদ্ধা, তিনিই ত্ৰৈলোক্যের অধিকারী হইবেন, সন্দেহ নাই। অৰ্জ্জুন নিশিত কণী ও তীক্ষ্ন নারাচ্য নিক্ষেপ করিলে কাহার সাধ্য তাঁহার সম্মুখীন হয়? জরাবর্জ্জিত যমও তাহা সহ্য করিতে পারেন না।
“দুৰ্দ্ধর্ষ পাণ্ডবগণের সহিত যুদ্ধ-ঘটনা হইলে আমার দুরাত্মা পুত্ৰগণই করাল কাল-কবলে কবলিত হইবে। আমি নিরন্তর অসন্ধান করিয়াও এমন কোন রখী দেখিতে পাই না যে, গান্তীবধন্বার সহিত যুদ্ধে অগ্রসর হইতে পারে। যদ্যপি সমরে দ্রোণ, কৰ্ণ বা ভীষ্ম গমন করেন, তাহা হইলেও জয়লাভের সম্ভাবনা নাই; কারণ, কৰ্ণ দয়ালু ও প্ৰমাদী এবং আচাৰ্য্য গুরুও স্থবির; কিন্তু ধনঞ্জয় অমৰ্ষী, বলবান ও দৃঢ়বিক্রম। উহারা সকলেই অস্ত্ৰপ্ৰয়োগদক্ষ, সকলেই শৌৰ্য্যশালী এবং সকলেই সমরবিখ্যাত; উহাদিগকে সমরে পরাজয় করা কোনক্রমেই সম্ভবপর নহে। উহারা সকলেই জয়লাভ করিয়া প্রাধান্যপ্ৰাপ্তির অভিলাষ করে। উহাদিগের অথবা অর্জ্জুনের বিনাশ না হইলে যুদ্ধের শান্তি হইবে না। কিন্তু অর্জ্জুনের বিনাশ বা তাহাকে জয় করিতে পারে, এমন ব্যক্তি এই জগতীতলে কেহই নাই। আমার প্রতি অর্জ্জুনের ক্ৰোধ জন্মিয়াছে, তাহা কিছুতেই নিবৃত্ত হইবে না। সেই ইন্দ্ৰসম মহাবীর খাণ্ডববনে অগ্নিকে পরিতৃপ্ত এবং রাজসূয়-মহাযজ্ঞে সমুদয় ভূপতিকে পরাজিত করিয়াছিল।
“হে সঞ্জয়! বাজ যেমন পর্ব্বতোপরি নিপতিত হইয়া তাহা সমূলে নির্ম্মল করে, তদ্রূপ কিরীটির শরজাল বিক্ষিপ্ত হইলে একেবারেই জগৎ নিঃশেষিত করিবে। দিনকর যেমন করনিকরদ্বারা চরাচর উত্তাপিত করেন, ধনঞ্জয়ের বাহু-বিনিঃসৃত শরজালও সেইরূপ আমার পুত্ৰগণকে পরিতাপিত করিবে এবং ভারতীসেনা সব্যসাচীর রথনির্ঘোষে ভয়বিহ্বল হইয়া ইতস্ততঃ ছিন্ন-ভিন্ন হইয়া পড়িবে। অর্জ্জুন শস্ত্ৰপাণি হইয়া শরসমূহ বিক্ষেপ করিতে আরম্ভ করিলে সর্ব্বান্তকারী অন্তকের ন্যায় নিতান্ত অসহনীয় হইয়া উঠিবে, তাহাতে সন্দেহ নাই।”