রামজয় শব্দে বানর ছাড়ে সিংহনাদ।
লঙ্কাতে রাবণ-রাজা গণিল প্রমাদ।।
রাবণ বলে দৈবগতি কে পারে নাড়িতে।
লঙ্কাপুরী বিনাশিবে নর-বানরেতে।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ মৈল যত সেনাপতি।
এখনি উঠিল বেঁচে না পোহাতে রাতি।।
মোর সেনা মরিলে না জীয়ে এক জন।
বারে বারে মরে বাঁচে শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।
হেন বীর নাহি মোর লঙ্কার ভিতর।
মারে রাম লক্ষ্মণ ও সুগ্রীব বানর।।
মরিয়া না মরে রাম এ কেমন বৈরী।
বীরশূন্যা হইল কনক-লঙ্কাপুরী।।
হেন ছার যুদ্ধে আর নাহি প্রয়োজন।
থাকিব কপাট দিয়া প্রাণ বড় ধন।।
প্রবেশিত লঙ্কাপুরে নাহি দিব বাট।
লঙ্কাপুরে চারি দ্বারে দেহ ত কপাট।।
রাজার আদশ পেয়ে যত নিশাচরে।
লঙ্কাপুরে কপাট দিলেক চারি দ্বারে।।
সোণার কপাট খিল ভয়ঙ্কর অতি।
নাহি তাহে চন্দ্র সূর্য্য পবনের গতি।।
পাঁচ দিন দ্বারের কপাট নাহি খুলে।
হাসিয়া সুগ্রীব রাজা সবাকারে বলে।।
দুয়ারে কপাট দিয়া রহিল রাবণ।
মনে কি ভেবেছে বেটা জিনিয়াছে রণ।।
এতেক ভাবিয়া মনে বানরের পতি।
পশ্চিম দুয়ারে গেল মন্দ মন্দ গতি।।
বসেছেন রঘুনাথ সমুদ্রের তটে।
চৌদিকে বানরগণ লক্ষ্মণ নিকটে।।
হনুমান জাম্ববান আর বিভীষণ।
কৃতাঞ্জলি হইয়া আছেন তিন জন।।
উপনীত হৈল আসি সুগ্রীব রাজন।
সম্ভ্রমে বন্দিলা আসি রামের চরণ।।
লক্ষ্মণের পাদপদ্ম বন্দিলেক শিরে।
জিজ্ঞাসেন শ্রীরাম সুগ্রীব মহাবীরে।।
কি মন্ত্রণা করিছে লঙ্কার অধিকারী।
চারি দ্বারে কপাট রেখেছে বন্ধ করি।।
পাঁচদিন হৈল কেন নাহি দেয় রণ।
কহ না সুগ্রীব মিতা ইহার কারণ।।
সুগ্রীব বলেন, প্রভু না জানি সংবাদ।
করেছে কপাট বন্ধ গণিয়া প্রমাদ।।
শ্রীরাম বলেন, শুন মন্ত্রী জাম্ববান।
চিন্তিয়া মন্ত্রণা কর যে হয় বিধান।।
জাম্ববান মন্ত্রণা কর যে হয় বিধান।
জাম্ববান বলে প্রভু পাঠায়ে বানরে।।
লঙ্কায় আগুন দেহ প্রতি ঘরে ঘরে।
এতেক শুনিয়া তবে সুগ্রীব রাজন।
বড় বড় বানরে পাঠায় ততক্ষণ।।
সুগ্রীবের আজ্ঞা পেয়ে অসংখ্য বানর।
লাফে লাফে পড়ে গিয়া লঙ্কার ভিতর।।
একে লঙ্কাপুরী তাহে বানরের জাতি।
আঁচড় কামড় মারে ধরিয়া যুবতী।।
অন্তঃপুরে নারী দেখে বানরের রঙ্গ।
কাপড় কাড়িয়া লয় করিয়া উলঙ্গ।।
অঞ্চলে ধরিয়া দন্ত খিঁচাইয়া উঠে।
বস্ত্র ফেলে যুবতী পালায় সবে ছুটে।।
কিচমিচ দন্ত করে খিল খিল হাসি।
ভাণ্ডার হইতে আনে ঘৃতের কলসী।।
কারে মারে লাথি কিল, কারে মারে চড়।
নারায়ণ তৈলের কলসী লয়ে রড়।।
বাহির আওয়াসে দিতে গেল সমাচার।
তিন লাফে প্রাচীর লইয়া আসে পার।।
নারায়ণ-তৈল ঘৃত কলসী কলসী।
আনে বস্ত্র পর্ব্বত প্রমাণ রাশি রাশি।।
এইরূপে দুর্জ্জয় বানর কোটি কোটি।
সন্ধ্যাকালে লক্ষ লক্ষ জ্বালিল দেউটি।।
একে চায় তাহে আজ্ঞা পাইল বানর।
লাফে লাফে প্রবেশিল লঙ্কার ভিতর।।
একেক বানর লয় দুই দুই মশাল।
অগ্নি দিয়া পোড়ায় লঙ্কার চালে চাল।।
অগ্নিতে পুড়িয়া পড়ে রড় বড় ঘর।
পরিত্রাহি ডাক ছাড়ে লঙ্কার ভিতর।।
উলঙ্গ হইয়া কেহ পলাইল ডরে।
লাফ দিয়া পড়ে কেহ জলের ভিতরে।।
অনেক পুড়িল ঘর আগুনের জ্বালে।
কেহবা পলায়ে যায় বাপ বাপ বলে।।
লঙ্কার ভিতরে যত ছিল বিদ্যাধরী।
জলেতে প্রবেশ করে, বলে মরি মরি।।
অঙ্গ ডুবাইয়া মুখ ভাসাইয়া জলে।
সরোবর শোভে যেন শত শতদলে।।
দুয়ারে থাকিয়া দেখে হনু মহাবলী।
দেউটির অগ্নি দিয়া পোড়াইল চুলি।।
জলেতে ডুবায়ে অঙ্গ জাগাইছে মুখ।
মুখে অগ্নি দিয়া হনু দেখিছে কৌতুক।।
ডুবিয়া থাকিল ত্রাসে জলের ভিতরে।
জল খেয়ে তারা সব পেট ফুলে মরে।।
ত্রিশ কোটি রমণীর পোড়ায়ে বদন।
লাফ দিয়া উঠে চালে পবন-নন্দন।।
আগে পাছে অগ্নি দেয় করে তাড়াতাড়ি।
বালক যুবক পোড়ে কত বুড়াবুড়ী।।
সৈন্য সামন্তের ঘর পোড়ে সারি সারি।
পাত্রমিত্রগণের পুড়িল কত পুরী।।
রত্নময় নির্ম্মাণ সুন্দর সব ঘর।
লেখাজোখা নাই ঘর পুড়িল বিস্তর।।
খাট পাট পালঙ্ক পুড়িল রত্ন ধন।
রত্নময় নির্ম্মিত অসংখ্য আভরণ।।
বহুদূর থাকিতে অগ্নির শব্দ শুনি।
বানর-কটক ঘরে দিতেছে আগুনি।।
পর্ব্বত প্রমাণ অগ্নি ভয়ঙ্কর দেখি।
পিঞ্জর সহিত পোড়ে পোষণিয়া পাখী।।
শারী শুক কাকাতুয়া সারস সারসী।
নানাজাতি বিহঙ্গ পুড়িল রাশি রাশি।।
হাতী ঘোড়া গেল পোড়া কত লাখে লাখ।
পলাতে না পারে ডাকে বিপরীত ডাক।।
কত শত ময়ূর পুড়িল ঝাঁকে ঝাঁক।
কুক্কুট আকৃতি হৈল পোড়া গেল পাখ।।
নানাজাতি পোষা জন্তু পালে পালে পোড়ে।
প্রাণভয়ে কেহ বা পলায় উভরড়ে।।
বানরেতে পর্ব্বত বরিষে ঝাঁকে ঝাঁকে।
শ্রবণ বধির হলো আগুণের ডাকে।।
অঙ্গদ বলেন, শুন পবন-কুমার।
চারি জন রাখহ লঙ্কার চারি দ্বার।।
বসে থাক চারি দ্বারে দেউটি জ্বালিয়া।
রাক্ষস আইলে দেহ মুখ পোড়াইয়া।।
ভিতরেতে আগুন বাহিরে যেতে চায়।
পলাইতে নারে মুখ বানরে পোড়ায়।।
রাক্ষস-অবস্থা দেখে বানরের হাস।
লঙ্কাকাণ্ডে গাহিল পণ্ডিত কৃত্তিবাস।।