পঞ্চচত্বারিংশ অধ্যায়
বংশধর সন্তানের প্রশংসা
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, এই সময়ে মহাতপা জরৎকারু মুনি বায়ুমাত্র-ভক্ষণে শীর্ণকলেবর হইয়া তপোনুষ্ঠান ও পুণ্যতীর্থে স্নান করিয়া, অবনীমণ্ডল পরিভ্রমণ করিতেন এবং যেস্থানে সায়ংকাল উপস্থিত হইত, সেই স্থানেই অবস্থিতি করিতেন। একদা তিনি পর্য্যটনক্রমে এক স্থানে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, নিরাহারে শীর্ণকলেবর, বায়ুমাত্রভোজী, পরিত্রাণেচ্ছু, অতি দীনভাবাপন্ন, স্বকীয় পিতৃগণ ঊর্দ্ধ্বপাদ ও অধোমস্তকে তন্তুমাত্রাবশিষ্ট উশীরস্তম্ব অবলম্বন করিয়া এক মহাগর্ত্তাভিমুখে লম্বমান রহিয়াছেন। ঐ গর্ত্তে এক প্রকাণ্ড মূষিক বাস করে। সে প্রতিদিন সেই বীরণস্তম্বের মূল সকল ক্রমে ক্রমে ছেদন করিতেছে। মহর্ষি জরৎকারু তাঁহাদিগকে নিতান্ত দীনভাবাপন্ন ও পরিত্রাণেচ্ছু দেখিয়া দয়ার্দ্রাচিত্তে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনারা কে এবং কি নিমিত্তই বা এই উশীরস্তম্ব অবলম্বন করিয়া ঊর্দ্ধ্বপাদে ও অধোমুখে মহাগর্ত্তাভিমুখে লম্বমান রহিয়াছেন? আপনারা যে উশীরস্তম্ব অবলম্বন করিয়া আছেন, উহার একমাত্র তন্তু অবশিষ্ট আছে; এই গর্ত্তনিবাসী মূর্ষিক তাহাও ক্রমে ক্রমে ছেদন করিতেছে। ইহা ছিন্ন হইলেই আপনারা এই গর্ত্তমধ্যে অধঃশিরে পতিত হইবেন। আপনাদের এই দুর্দ্দশা দর্শনে আমার যৎপরোনাস্তি দুঃখ হইতেছে। আজ্ঞা করুন, আপনাদের কি প্রিয়কার্য্য করিব? আমার তপস্যার চতুর্থভাগ বা তৃতীয়ভাগ অথবা অর্দ্ধভাগ লইয়া যদি আপনারা এই বিপদ হইতে মুক্ত হইতে পারেন, লউন। অধিক আর কি কহিব, যদি সমগ্র তপস্যা দ্বারাও আপনাদের এই দুঃসহ দুঃখ-নিবারণ হয়, তাহাতেও আমি সম্মত আছি।”
পিতৃগণ তাঁহার সেই বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “হে বৃদ্ধ ব্রহ্মচারিন্! তুমি তপঃপ্রভাবে আমাদিগকে পরিত্রাণ করিতে চাহিতেছ, কিন্তু তপস্যা দ্বারা আমাদিগকে উদ্ধার করিতে পারিবে না। আমাদিগেরও তপঃসিদ্ধি আছে; কেবল বংশক্ষয়োপক্রম হইয়াছে বলিয়া আমরা এই অপবিত্র নরকে নিপতিত হইতেছি। সর্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মা কহিয়াছেন, ‘সন্তানই পরম ধর্ম্ম।’ আমরা এই গর্ত্তে লম্বমান হইয়া হতজ্ঞান হইয়াছি, তন্নিমিত্ত তোমার পৌরুষ সর্ব্বলোক-বিশ্রুত হইলেও তোমাকে চিনিতে পারিতেছি না। তুমি আমাদিগের দুঃখদর্শনে সাতিশয় কাতর হইয়াছ, অতএব তোমাকে পরিচয় প্রদান করিতেছি, শ্রবণ কর। আমরা যাযাবর নামে ব্রতশীল ঋষি, সন্তানক্ষয়ের উপক্রম হওয়াতে এই পবিত্র লোক হইতে ভ্রষ্ট হইতেছি। আমাদের কঠোর তপস্যার ফল অদ্যাপিও বিনষ্ট হয় নাই। আমাদের জরৎকারু নামে এক সন্তান আছেন। তিনি বেদবেদাঙ্গ-শাস্ত্রে পারদর্শী, নিয়তাত্মা, ব্রতনিরত ও তপঃপ্রভাবসম্পন্ন; কিন্তু তাঁহার থাকা না থাকা উভয়ই সমান হইয়াছে। তাঁহার স্ত্রী-পুৎত্র বন্ধুবান্ধব কেহই নাই; কেবল কঠোর তপস্যা করিয়াই কালযাপন করেন। তিনি তপস্যা লোভে নিতান্ত আক্রান্ত হওয়াতেই আমাদিগের এই দুর্দ্দশা ঘটিয়াছে। এই যে উশীরস্তম্ব দেখিতেছ, ইহা আমাদের বংশবর্দ্ধক কুলস্তম্ব। আর ইহার যে সকল মূল দেখিতেছ, ইহা আমাদিগের কালকবলিত সন্তানসমূহ। অর্দ্ধভক্ষিত যে মূলটি আমরা অবলম্বন করিয়া আছি, উহা সেই তপোনিষ্ঠ জরৎকারু। আর এই যে মূষিক দেখিতেছ, ইনি মহাবলপরাক্রান্ত কাল। ইনি সেই তপোলুব্ধ মূঢ়মতি জরৎকারুকে ক্ষয় করিতেছেন। জরৎকারুর কঠোর তপস্যা আমাদিগকে রক্ষা করিতে পারিবে না। আমরা অতি মন্দভাগ্য, আমাদিগের মূল ছিন্নপ্রায় হইয়াছে। এই দেখ, আমরা কালোপহতচিত্ত [দৈববিড়ম্বিত] হইয়া দুরাত্মাদিগের ন্যায় অধঃপতিত হইতেছি। আমরা সবান্ধবে এই গর্ত্তে পতিত হইলে তাঁহাকেও কালনিয়ন্ত্রিত হইয়া নিরয় [নরক] গামী হইতে হইবে। হে ব্রহ্মন্! কি তপস্যা, কি যজ্ঞ, কি অন্যান্য পুণ্যকর্ম্ম, সন্তানের সদৃশ কিছুই দেখিতে পাই না। হে বৎস! এক্ষণে তুমি আমাদিগের নাথস্বরূপ। তোমার সহিত সেই মূঢ়মতি জরৎকারুর সাক্ষাৎকার হইলে তাহার নিকট আমাদিগের এই দুর্দ্দশা-বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত পরিচয় দিবে এবং কহিবে, তুমি ত্বরায় দারপরিরগ্রহ করিয়া সন্তানোৎপাদন দ্বারা তাহাদিগের পরিত্রাণ কর। সে যাহা হউক, তুমি যে আমাদের দুর্দ্দশা দেখিয়া পরম-বন্ধুর ন্যায় অনুতাপ করিতেছ, তন্নিমিত্ত আমরা শুনিতে ইচ্ছা করি, তুমি কে?”
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, জরৎকারু তাঁহাদের এই বাক্যশ্রবণে সাতিশয় শোকার্ত্ত হইয়া সবাষ্প-গদগদস্বরে কহিতে লাগিলেন, “হে মহর্ষিগণ! আপনারা আমারই পর্ব্বপুরুষ; আমিই আপনাদিগের সেই পাপাত্মা, নরাধম ও কৃতঘ্ন পুৎত্র; আমার নাম জরৎকারু। সম্প্রতি আপনাদিগের কি প্রিয়কার্য্য করিতে হইবে, আজ্ঞা করুন এবং আমার এই অপরাধের যথোচিত দণ্ডবিধান করুন।”