৪৪তম অধ্যায়
করুক্ষেত্রের প্রথম-দিবসীয় য়ুদ্ধ
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! অস্মাৎপক্ষীয় [আমাদের পক্ষের—দুৰ্য্যোধন পক্ষের] ও পাণ্ডবপক্ষীয় সৈন্যসমুদয় এইরূপে ব্যূহিত হইলে পর কৌরব-পাণ্ডবগণের মধ্যে কাহারা অগ্ৰে প্ৰহার করিয়াছিল?”
সঞ্জয় কহিলেন, “হে রাজন! উভয়পক্ষীয় সৈন্যগণ ব্যূহিত হইলে পর আপনার পুত্র দুঃশাসন ভ্রাতার বাক্যানুসারে ভীষ্মকে অগ্রসর করিয়া সেনাগণসমভিব্যাহারে সংগ্রামার্থ গমন করিতে লাগিলেন; ভীমসেনাপ্রভৃতি পাণ্ডবগণও ভীষ্মের সহিত সংগ্রাম করিবার মানসে হৃষ্টচিত্ত হইয়া সমরে গমন করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। উভয়পক্ষীয় সেনাগণের সিংহনাদ ও কিলকিলা শব্দ, ক্রাকচ, গোশূঙ্গ, ভেরী, মৃদঙ্গ ও মুরজের ধ্বনি এবং হস্তিগণের বৃংহিত ও অশ্বগণের হ্রেষারবে চতুর্দ্দিক প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল। সৈন্যগণ পরস্পর তর্জ্জনগর্জ্জনপূর্ব্বক ধাবমান হইল। এইরূপে কৌরব ও পাণ্ডবগণের সমাগম হইলে সেই বিপুল সৈন্যসমুদয় শঙ্খ ও মৃদঙ্গের[পাখোয়াজের] শব্দ শ্রবণে বায়ুবেগে বিকম্পিত বনরাজির ন্যায় প্রচলিত হইতে লাগিল। ঐ অশিব মুহুর্তে ভূপতি, হন্তী ও অশ্বে সমাকুল সৈন্যগণ বাতবেগে পরিচালিত সাগরের ন্যায় তুমুল নিনাদ করিতে লাগিল।
ভীমের ভীষণ যুদ্ধে কৌরবর্ভীতি
“সেই সাগরোপম সৈন্যসমুদয়ের তুমুল শব্দ সমুথিত হইলে মহাবল ভীমসেন বিপুল বলীবর্দের[বিশালদেহ বৃষ] ন্যায় গভীর নিনাদ করিতে লাগিলেন। ভীমসেনের ভীমরবে শঙ্খ ও দুন্দুভির নিৰ্ঘোষ, করিকুলের বৃংহিত ও সৈন্যগণের সিংহনাদ আচ্ছাদিত হইয়া উঠিল। হে মহারাজ! বৃকোদরের সেই অশনিনির্ঘোষসদৃশ ভীষণ রব শ্রবণে আপনার সমুদয় সৈন্যগণ বিত্ৰাসিত[ভয়প্রাপ্ত—ভীতিগ্রস্ত] হইল। যেমন মৃগগণ সিংহের ভীষণরব শ্রবণে বিষ্ঠা-মূত্র পরিত্যাগ করে, তদুপ বাহনগণ ভীমসেনের সিংহনাদ শ্রবণে ভীত হইয়া বিষ্ঠা-মূত্র পরিত্যাগ করিতে লাগিল। ভীমপরাক্রম ভীমসেন এইরূপ মহামেঘের ন্যায় ভীষণ গর্জ্জন করিয়া আপনার পুত্ৰগণকে ভীত করিয়া সৈন্যমধ্যে গমন করিতে লাগিলেন।
“কৌরবগণ সেই অসামান্য বলশালী বৃকোদরকে সৈন্যমধ্যে সমাগত দেখিয়া চতুর্দ্দিক হইতে তাঁহার উপর বাণ নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। বৃকোদার মেঘাচ্ছন্ন দিবাকরের ন্যায় শরজালে লুক্কায়িত রহিলেন। দুৰ্য্যোধন, দুমুখ, দুঃসহ দুঃশাসন, অতিরথ, দুর্ম্মষণ, বিবিংশতি, চিত্ৰসেন, বিকৰ্ণ, পুরুমিত্র, জয়, ভোজ ও সৌমদত্তি ইহারা, সকলে মহাচাপ কম্পন এবং নির্মোকত্যক্ত আশীবিষের ন্যায় নারাচ গ্ৰহণ করিতে লাগিলেন। পুরন্দর যেমন পর্ব্বতশৃঙ্গসমুদয়ের উপর বাজপ্রহার করেন, তদ্রূপ অভিমন্য, নকুল, সহদেব, ধৃষ্টদ্যুম্ন ও দ্রৌপদীর পুত্ৰগণ দুৰ্য্যোধনাদির উপর শরনিকর নিক্ষেপ করিয়া ধাবমান হইলেন। হে মহারাজ! সেই প্রথম সংগ্রামে ভীষণ জ্যানিস্বন ও তলধ্বনি শ্রবণ করিয়া কি আপনার পক্ষীয়, কি শত্রুপক্ষীয় সৈন্যগণ কেহই রণে পরাঙ্মুখ হইল না। আমি স্বচক্ষে নিমিত্তবোধী [লক্ষ্যভেদী] দ্রোণশিষ্যগণের ক্ষিপ্রকারিতা দেখিলাম। তৎকালে শরাসনের জ্যানিঘোষ মুহুর্ত্তমাত্রও নিবৃত্ত হইল না; প্ৰদীপ্ত শরনিকর আকাশ হইতে নিপতিত জ্যোতিষ্কসমূদয়ের ন্যায় বিচরণ করিতে লাগিল। অন্যান্য ভূপতিগণ প্রেক্ষকের[নিরপেক্ষ দর্শকের] ন্যায় সেই ভীষণ জ্ঞাতিযুদ্ধ দেখিতে লাগিলেন।
“অনন্তর সেই মহারথসকল ক্রুদ্ধ হইয়া পরস্পর স্পৰ্দ্ধা করিয়া যুদ্ধ করিতে লাগিলেন; তৎকালে সেই রণস্থলস্থিত হন্তী, অশ্ব, রথসমাকুল উভয়পক্ষীয় সৈন্যগণকে চিত্ৰপটস্থ [ছবিতে আঁকা মূর্ত্তি]বলিয়া বোধ হইতে লাগিল এবং ভগবান্ ভাস্কর সৈন্যসমুখিত ধূলিপটলে সমাচ্ছন্ন হইলেন। শরাসনধারী ভুপতিগণ রাজা দুৰ্য্যোধনের শাসনানুসারে সৈন্যগণসমভিব্যাহারে বিপক্ষপক্ষে নিপতিত হইলেন। সেই গজ, অশ্ব, ভেরী ও শরাসনসমাকুল সংগ্রামস্থলে ভূপতিগণ ধাবমান হওয়াতে ক্ষুব্ধ সমুদ্রনিস্বনাসদৃশ ঘোরতর শব্দ সমুথিত হইল। এ দিকে পাণ্ডবপক্ষীয় বহুসংখ্যক নরপতি যুধিষ্ঠিরের আদেশনুসারে সৈন্যসমূহসমভিব্যারে দুর্য্যোধনের সৈন্যসমুদয়ের উপর নিপতিত হইতে লাগিলেন। উভয়পক্ষীয় সেনাগণের তুমুল সংগ্রাম আরম্ভ হইল। সৈন্যগণ কখনো যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত, কখনো ভগ্ন ও কখনো প্রত্যাবৃত্ত হওয়াতে আত্মীয় ও পর এই উভয়ের কিছুই ইতরবিশেষ বোধ হইল না। হে মহারাজ! সেই মহাভয়াবহ তুমুল সংগ্রাম সময়ে মহাত্মা ভীষ্ম সমুদয় সৈন্যকে অতিক্ৰম করিয়া দেদীপ্যমান হইতে লাগিলেন।”