৪৪তম অধ্যায়
অভিমন্যুশরে বসাতীয় বধ
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! জয়লাভার্থী পাণ্ডবগণ সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ কর্ত্তৃক এইরূপে নিরুদ্ধ হইলে উভয় পক্ষে ঘোরতর সংগ্রাম হইতে লাগিল। তেজস্বী অভিমন্যু সৈন্যমধ্যে প্রবেশ করিয়া মকর বিক্ষোভিত মহাসাগরের ন্যায় সৈন্যগণকে ক্ষোভিত করিতে আরম্ভ করিলে কৌরবপক্ষ বীরগণ প্রাধান্যক্ৰমে অভিমন্যুর প্রতি ধাবমান হইলেন। তাঁহার সহিত তাঁহাদিগের দারুণ সম্মর্দ্দ হইতে লাগিল। কুরুবীরগণ নিরবচ্ছিন্ন শরনিকর বর্ষণ করিয়া রথসমূহ দ্বারা অভিমন্যুকে রুদ্ধ করিলে অভিমন্যু বৃষসেনের সারথিকে বিনাশ ও কাৰ্ম্মকচ্ছেদন করিয়া অশ্বগণকে বিদ্ধ করিলেন। বায়ুবেগগামী অশ্বগণ সহসা বৃষসেনকে রণস্থল হইতে অপসারিত করিল। এই অবসরে অভিমন্যুর সারথিও রথ লইয়া অন্যত্র প্রস্থান করিল। মহা রথগণ হৃষ্ট চিত্তে সাধু সাধু বলিয়া কোলাহল করিতে লাগিলেন।
অনন্তর মহাবীর বসাতীয় রোষাবিস্ট সিংহসদৃশ অভিমন্যুকে শরনিকরে শত্রু বিমর্দ্দনপূর্ব্বক নিকটে আগমন করিতে নিরীক্ষণ করিয়া দ্রুতবেগে তাঁহার অভিমুখীন হইয়া ষষ্টিশরে তাঁহাকে সমাচ্ছন্ন করিলেন এবং কহিলেন, ‘হে বীর! আমি জীবিত থাকিতে কদাচ তুমি জীবিতাবস্থায় আমার হস্ত গ্হ হইতে মুক্তিলাভ করিতে সমর্থ হইবে না। তখন সুভদ্রা নন্দন অভিমন্যু শরসমূহে সেই লৌহময় বৰ্ম্মধারী বসাতীয়ের হৃদয় বিদ্ধ করিলে তিনি তৎক্ষণাৎ গতাসু হইয়া ক্ষিতিতলে নিপতিত হইলেন। বসাতীয়কে গতাসু দেখিয়া নানা প্রকার কাৰ্ম্মুক বিস্ফারিত করত কৌরব পক্ষ ক্ষত্রিয়গণ অভিমন্যুকে বিনাশ করিবার নিমিত্ত চতুর্দ্দিকে বেষ্টন করিলেন। এই যুদ্ধ সাতিশয় ভয়ঙ্কর হইয়া উঠিল। অভিমন্যু ক্রোধাবিষ্ট হইয়া তাঁহাদিগের শর, শরাসন, শরীর ও মাল্যদামমণ্ডিত কুণ্ডলালঙ্কৃত মস্তক সকল ছেদন করিলেন। খড়্গ, অঙ্গুলিত্রাণ, পট্টিশ ও পরশু সম্পন্ন, সুবর্ণাভরণভূষিত, ছিন্ন, হস্ত সকল ইতস্তত নিরীক্ষিত হইতে লাগিল। তখন মাল্যদাম, আভরণ, বস্ত্র, ধ্বজদণ্ড, বৰ্ম্ম, চৰ্ম্ম, হার, মুকুট, ছত্র, চামর, উপস্কর, অধিষ্ঠান, ঈষাদণ্ড, বিমথিত অক্ষ, ভগ্ন চক্র, ভগ্ন যুগ, অনুকর্ষ, পতাকা, অশ্ব, সারথি, ভগ্নরথ ও হস্তী দ্বারা পৃথিবী পরিপূর্ণ হইল। রণস্থল মহাবল পরাক্রান্ত নানা জনপদের অধীশ্বর জয়াভিলাষী নিহত ক্ষত্রিয়গণে পরিপূর্ণ ও অতি ভীষণ হইয়া উঠিল। যখন অভিমন্যু ক্রোধাবিষ্ট হইয়া রণস্থলে দিক বিদিক্ ভ্রমণ করিতে লাগিলেন, তৎকালে তাঁহার রূপ আর কাহারও নয়নগোচর হইল না; কেবল কাঞ্চন বৰ্ম্ম, আভরণ, কাৰ্ম্মক ও শরনিকর নেত্রগোচর হইতে লাগিল। এইরূপে মহাবীর অভিমন্যু যখন দিবাকরের ন্যায় সমর মধ্যে অবস্থান পূর্ব্বক শরজালে যোদ্ধাদিগকে সমাচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন, তখন কেহই তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিতে সমর্থ হইল না।