চত্বারিংশ অধ্যায়
পরীক্ষিতের ব্রহ্মশাপ
শৌনক কহিলেন, হে সূতনন্দন! তুমি জরৎকারুনামা যে মহর্ষির বিবরণ কহিলে, তিনি কি নিমিত্ত জগতে জরৎকারু নামে বিখ্যাত হইয়াছিলেন এবং জরৎকারু শব্দের যথাশ্রুত অর্থই বা কি, তাহা আমি শুনিতে ইচ্ছা করি, বর্ণন কর।
উগ্রশ্রবাঃ কহিলেন, জরাশব্দের অর্থ ক্ষয়, কারু শব্দের অর্থ দারুণ। সেই মহর্ষির শরীর সাতিশয় দারুণ ছিল, তিনি কঠোর তপস্যা দ্বারা ক্রমে ক্রমে সেই দারুণ শরীরকে ক্ষীণ করিয়াছিলেন, তন্নিমিত্ত তাঁহার নাম জরৎকারু হইল এবং উক্ত কারণবশতঃ বাসুকির ভগিনী জরৎকারু নামে বিখ্যাত হইলেন।
মহর্ষি শৌনক তৎশ্রবণে কিঞ্চিৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, হাঁ, তুমি যাহা বলিলে. ইহা যুক্তিসিদ্ধ বটে। তুমি ইতিপূর্ব্বে যাহা যাহা কীর্ত্তন করিলে, তৎসমস্তই আমি শ্রবণ করিলাম। এক্ষণে আস্তীকের জন্মবৃত্তান্ত শ্রবণ করিতে বাসনা করি, বর্ণনা কর।
উগ্রশ্রবাঃ শৌনকের এই বাক্য শ্রবণ করিয়া শাস্ত্রানুসারে কহিতে লাগিলেন। মহামতি বাসুকি ভুজঙ্গমগণের প্রতি উক্তরূপ আদেশ দিয়া মহর্ষি জরৎকারুকে ভগিনী প্রদান করিতে উদ্যত হইয়া রহিলেন। বহুকাল অতীত হইল, তথাপি ঊর্দ্ধ্বরেতা স্বাধ্যায়নিরত সেই মহাত্মা দারপরিগ্রহে অভিলাষী হইলেন না। তিনি কেবল তপস্যাদি ধর্ম্মকর্মে নিতান্ত অনুরক্ত হইয়া নির্ভয়হৃদয়ে সমস্ত মেদিনীমণ্ডল পরিভ্রমণ করিতেন।
কিয়ৎকাল পরে কৌরববংশীয় পরীক্ষিৎ পৃথিবীর অধিরাজ হইলেন। তিনি স্বীয় প্রাপিতামহ পাণ্ডু রাজার ন্যায় অদ্বিতীয়
ধনুর্দ্ধর, যুদ্ধবিশারদ ও মৃগয়াপ্রিয় ছিলেন। মহারাজ পরীক্ষিৎ সর্ব্বদাই মৃগ, বরাহ, তরক্ষু [ব্যাঘ্র], মহিষ ও অন্যান্য বিবিধ প্রকার বন্যজন্তু শিকার করিয়া মহীমণ্ডল পরিভ্রমণ করিতেন। একদা তিনি স্বকীয় আনতপর্ব্ব শর দ্বারা এক মৃগকে বিদ্ধ করিয়া পৃষ্ঠে শরাসন ধারণপূর্ব্বক যজ্ঞরূপী মৃগের অনুযায়ী ভগবান্ ভূতনাথের ন্যায় সেই মৃগের অনুসরণক্রমে নিবিড় অরণ্যানী-মধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন। পরীক্ষিতের বাণে বিদ্ধ হইলে কোন মৃগই জীবিতাবস্থায় পলায়ন করিতে পারে না; কিন্তু এই মৃগ যে বাণবিদ্ধ হইয়াও পলায়ন করিল, উহা কেবল তাঁহার অচিরাৎ স্বর্গলাভের প্রতি হেতু হইয়া উঠিল।
রাজা পরীক্ষিৎ মৃগের অনুসরণ-প্রসঙ্গে ক্রমে ক্রমে অতি দূরদেশে উপনীত হইলেন। পরে সাতিশয় পরিশ্রান্ত ও পিপাসার্ত্ত হইয়া এক গোপ্রচারে [গোষ্ঠে–গোচারণ-স্থানে] উপস্থিত হইলেন এবং অবলোকন করিলেন, এক তপস্বী স্তন্যপায়ী বৎসগণের মুখনিঃসৃত ফেনপুঞ্জ পান করিয়া জীবন-ধারণ করিতেছেন। অত্যান্ত ক্ষুৎপিপাসান্বিত রাজা সেই মুনির সন্নিধানে সমুপস্থিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “হে মুনিসত্তম! আমি অভিমন্যুর পুৎত্র রাজা পরীক্ষিৎ, তোমাকে জিজ্ঞাসিতেছি, আমি এক মৃগকে বাণ দ্বারা বিদ্ধ করিয়াছিলাম, সে পলায়ন করিয়াছে, কোন্ দিকে পলায়ন করিল, তুমি কি দেখিয়াছ?” মুনিবর মৌনব্রতাবলম্বী ছিলেন, কোন কথাই কহিলেন না। তখন রাজা ক্রোধান্ধ হইয়া আপন ধনুর অগ্রভাগ দ্বারা এক মৃতসর্প উত্তোলন করিয়া মহর্ষির স্কন্ধদেশে অর্পণ করিলেন। ঋষি তাহাতে ক্রোধ করিলেন না এবং ভালমন্দ কিছুই বলিলেন না। রাজা তাঁহাকে তদবস্থ দেখিয়া ক্রোধ পরিত্যাগপূর্ব্বক ব্যথিতমনে আপন রাজধানীতে গমন করিলেন, কিন্তু সেই ঋষি তদবস্থই রহিলেন। ঐ ক্ষমাশীল মহামুনি রাজা পরীক্ষিৎকে স্বধর্ম্মনিরত বলিয়া জানিতেন; এই নিমিত্ত তৎকর্ত্তৃক অবমানিত হইয়াও তাঁহাকে অভিসম্পাত করিলেন না। কুরুবংশাবতংস [কুরুবংশের ভূষণস্বরূপ] মহারাজ পরীক্ষিৎও তাঁহাকে তাদৃশ ধর্ম্মপরায়ণ বলিয়া না জানিতে পারিয়াই তাঁহার তাদৃশী অবমাননা করিলেন।
ঐ মহর্ষির শৃঙ্গী নামে এক তরুণবয়স্ক পুৎত্র ছিলেন। শৃঙ্গী সাতিশয় রোষপরবশ। তিনি একবার ক্রুদ্ধ হইলে আর তাঁহাকে প্রসন্ন করা দুঃসাধ্য হইয়া উঠিত। তিনি সময়ে সময়ে সুসংযত হইয়া সর্ব্বভূতহিতৈষী ভগবান্ প্রজাপতির উপাসনা করিতে যাইতেন। একদা শৃঙ্গী সর্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মার উপাসনানন্তর তদীয় আদেশ লইয়া আপন আশ্রমে প্রত্যাগমন করিতেছেন, এমত সময়ে তাঁহার সখা কৃশ নামে এক ঋষিপুৎত্র হাসিতে হাসিতে তৎসন্নিধানে তদীয় পিতার অপমান-বৃত্তান্ত বর্ণন করিলেন। রুক্ষস্বভাব শৃঙ্গী কৃশ-মুখে পিতার অপমানবার্ত্তা শ্রবণ করিয়া ক্রোধে প্রজ্জ্বলিত হইয়া উঠিলেন। কৃশ হাসিতে হাসিতে কহিলেন, “তুমি অত্যন্ত তপোবলসম্পন্ন ও তেজস্বী, কিন্তু তোমার পিতা স্বীয় স্কন্ধদেশে মৃতসর্প বহন করিতেছেন, অতএব হে শৃঙ্গিন! যাও যাও, আর তুমি বৃথা গর্ব্ব করিও না এবং মাদৃশ সিদ্ধ ব্রহ্মবিৎ তপস্বী ঋষিপুৎত্রগণ কোন কথা কহিলে তাহাতে প্রত্যুত্তর প্রদান করিও না। হে শৃঙ্গিন্! কৈ, এক্ষণে তোমার সেই পুরুষত্বাভিমান এবং তাদৃশ সগর্ব্ব বাক্যই বা কোথায় রহিল? তোমার পিতা সেইরূপ অবমানিত হইয়াও ঔদাসীন্য অবলম্বনপূর্ব্বক রহিয়াছেন; তদ্বিষয়ে যাহা কর্ত্তব্য, কিছুই করেন নাই। আহা! ইহা দেখিয়া আমি অত্যন্ত দুঃখিত হইয়াছি?”